#ভর

 #ভর

তৃণময় সেন


ছপ্!

ইতিউতি ঘাসের নিচে এক অঞ্জলি জমা জল মিনতির পায়ের চাপে কাদা হওয়ার জানান দিলো। পায়ের পাতায় কিছুটা কাদাজল উঠে এসেছে, তবুও তেমন একটা বিরক্তি বোধ হলো না তার। গত সন্ধ্যার দমকা হাওয়া ক্রমে ঝিরিঝিরি বর্ষণ ও তারপরে টুংটাং শব্দে শিলাবৃষ্টি হয়ে সেদিনের মতো বিদায় জানিয়েছে। আজকের আকাশে তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। গর্জন-বর্ষণের বদরাগী চেহারার বদলে গায়ে আজ গাঢ় নীল চাঁদোয়া, গাছপাতা কচি নধর সবুজ আর ফাঁকে ফাঁকে কত নাম না জানা পাখির কলতান। মিনিট পাঁচেক আগে নানা বয়সী ডজনখানেক মানুষ শিব-গৌরীর সাথে এসে উঠোনের চারপাশে ভিড় করেছিল। রুপালি রং মাখা খালি গায়ের হাড়গুলো গোনা যাচ্ছিল শিব বাবাজির। রক্তিম চোখ-দুটোর নিচে একজোড়া পাতলা নকল গোঁফ, মাথায় পরচুলা, বাঘের ছালের আদলের নিম্নবস্ত্রটি কোমরে শক্ত করে বাঁধা লাল রঙের কৌপিনের জোরে আটকে আছে। গৌরীর বয়স তেরো-চৌদ্দর বেশি হবে না। বিস্তর হলুদ মাখা মুখখানি দারিদ্রের ছাপ ঢাকতে পারেনি। মাতালের মতো নাচের পর গৌরীর আঁচলে এক কৌটা চালের সাথে খুচরো পাঁচ টাকা ঢেলে দিয়েছে মিনতি। এই ভৈরব বাড়িতে এসেই গাঁজার কল্কেতে অগ্নিসংযোগ করে সুখটান দিয়েছে শিবের সাঙ্গপাঙ্গরা। এতক্ষণে বোধহয় ওরা আরও তিনটে উঠোন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু বাতাসে শুকনো নেশার গন্ধটা এখনও পুরোটা মিলিয়ে যায়নি। দূর থেকে এখনও ভেসে আসছে -

হরগৌরীর প্রাণনাথ,

মাথার উপরে জগন্নাথ

এবার উদ্ধার করো

শিবো শিবো শিবো হে...

পাতাঝরা বসন্ত ঠিক কতবছর আগে তাকে নিঃস্ব করেছিল, তা মনে করতে পারে না মিনতি। কচি আমপাতার মতো উজ্জ্বল গায়ের রঙ এখন তামাটে। মৌচাকের মতো জটপাকানো একমাথা ধূসর-কালো চুলে সাদা উঁকি দেওয়া শুরু করেছে। চোখের নিচে লেপ্টে থাকা কাজলে বড় মুখখানা আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে তার। এই রহস্যের ঘোর যেন এমনই চলতে থাকে। কেটে গেলেই মুশকিল...

--সাধুবেটি আছইননি গো?

বাইরের নারীকণ্ঠ বাস্তবে ফেরায় মিনতিকে। বারান্দায় ইতস্তত করছে চয়নের মা। তার বাম হাতের গ্লাস কলাপাতা দিয়ে ঢাকা। চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দায় পা বাড়াতেই হাতের গ্লাস মাটিতে রেখে মাথার ঘোমটা সুনিশ্চিত করে গড় হয়ে প্রণাম করে সে।

--কাইল বিয়ানিবালা আইলো তুফান। লাকড়ি তুলাত বারে বার অইছি তখন চখুত ধুইল হামাইছিল, আবো খুচার। কই আপনার কাছ থনে পানি পড়া থুড়া লইয়া যাই।

মুচকি হেসে গ্লাস হাতে তুলে আধবোজা চোখে মিনিট দুয়েক বিড়বিড় করে মিনতি। শ্রদ্ধা উপচে পড়ছে চয়নের মায়ের চোখেমুখে। হাতজোড় করে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

--দুইবার করি চখুত দেও। আর লগে গরম কাপড় দিয়া সেঁক দিও।

গ্লাস ফিরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে মহিলা। এইসব কাজে কোনো টাকা-পয়সা নেয় না মিনতি। তবে কাল বাদে পরশু হাতে করে দুটো ঝিঙে, আধ সের দুধ বা গোটাকয়েক আম নিয়ে চয়নের মা যে আবার আসবে, সেই ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিত সে। এই সামান্য দান-খয়রাত ছাড়া সাপ্তাহিক কীর্তনের প্রণামী আর ছোটখাটো পূজা-পার্বণে দেওঘরিগিরি করে ঠিক চলে যায় তার। মেজবাবু আজকাল আর তেমন আসেন না। তাই আর আজকাল বড় নোটের দেখা মেলে না। ভাবনার অতল সাগরে আবার ডুবে যায় মিনতি। সে যখন এখানে এসেছিল, তখন এই চয়নের মাকে 'সিতুর বউ' বলে ডাকতো সবাই। সেদিন ভীষণ ভারী চোখ দুটো খোলার পর অপরিচিত মুখগুলোর মধ্যে সবার পিছনে এই মুখটাও দেখতে পেয়েছিল মিনতি। নরম শাড়ির আঁচলে ঢাকা গর্ভ স্পষ্ট বোঝা যাওয়াটা চোখে পড়ার একটা কারণ ছিল হয়তো। ভৈরববাড়ির নামকরণ তখনও হয়নি। যদিও রুপসী গাছের নিচে লম্বাটে পাথরটাতে আশপাশের মহিলারা তেল-সিঁদুর ছোঁয়াতে আসতো। সেই দিনের ঘটনার পর থেকে হঠাৎ করে এই জায়গাটা জাগ্রত হয়ে উঠলো।

চয়ন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে রাজমিস্ত্রি বাপের সাথে ক'দিন কাজে গেছিলো, তারপর হঠাৎ একদিন বাড়ি ছেড়ে পালালো। হাউহাউ করে কেঁদে ভাসিয়েছিল তখন চয়নের মা। সাধুবেটির পায়ে পড়ে একখান লালপাড় শাড়ি মানত করেছিল সে। মাসখানেক বাদে টাটা সুমোর পিছনে লটকে চয়ন যখন বাড়ি ফিরলো, তখন তার হাবভাব দেখে তাজ্জব হয়ে গেছিলো। সে এখন মেজবাবুর ডানহাত। ওনার রাজনৈতিক দলের জন্য কাজ করে। বৃহস্পতিবার বিকেলের সাপ্তাহিক কীর্তন শেষে মনির মা, আকলবুড়ি, ঝলটুর বৌয়ের সাথে এসে গদগদ সুরে ছেলের গুণগান গাইছিল চয়নের মা। দু'মাসের মাথায় এককৌটা সিঁদুরের সাথে শাড়িটাও দিয়ে গিয়েছিলো। 

এই গ্রামের কেউই মিনতির আসল নাম জানে না। সবাই সাধুবেটি বলেই চেনে। এতো মহিলারা এখানে আসে অথচ মিনতিও কারও নাম জানে না। কারও বৌ, কারও মা, কারও বোন - এই নামেই মেয়েদের পরিচিতি গ্রামে। পুরুষদের নাম আছে। এই যেমন - মেজবাবুর নাম হীরক বিশ্বাস। তার দৌলতেই ইট-সিমেন্টের চার দেয়ালের ভিতর থাকতে পারছে মিনতি। বিনিময় হিসাবে অবশ্য দিতে হয়েছে অনেক কিছুই, কিন্তু তাতে তেমন একটা দুঃখ নেই মিনতির। প্রথম দিকে কষ্ট হলেও পূর্বজন্মের সেই দুঃখ-কষ্টের কাছে সেটা কিছুই ছিল না। শক্ত দু’হাতে শরীরের নরম বর্তুলাকার বস্তু দুটো দলনের পর হিড়হিড় করে শুষ্ক পথে প্রবেশ করতেন মেজবাবু। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে রইতো সে। চোখের জল নিঃশব্দে গাল গড়িয়ে বুক অবধি পৌঁছে যেত। পূর্বজন্মের ঘটনাগুলো কেমন করেই বা জানতে পেরেছিলেন তিনি? কেই বা তাকে বলেছিল এইসব ঘটনা? অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তা আজও উদ্ধার করতে পারেনি মিনতি ওরফে সাধুবেটি।

ওগো বাইবে রাধারমণ বলে

আমার মানব জীবন যায় বিফলে গো।

আমি না জাইনে রাংচার দরে

সোনা দিলাম গো।

কীর্তনের তালে তালে মাথা দোলায় মিনতি। কখনও কখনও দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সাধুবেটির ভাবসমাধি হলে তার চরণধূলি নিয়ে মাথায় ছোঁয়ায় গ্রামের মহিলারা। দু-পাঁচ টাকা কপালে ঠেকিয়ে ঢেলে দেয় তাঁর আঁচলে। মা কালী-ভৈরববাবার চরণে নিজেকে সমর্পিত করলেও কাঁসর করতালের ঝমঝম আওয়াজ যখন বুকের ভিতর বাজতো, তখন ভক্তির বদলে ভয়ঙ্কর অতীত যেন জেগে উঠতো তার ভিতরে। আর তখন দু'চোখ বেয়ে নামতো ব্যথিত শ্রাবণ। সাধারণ জনের কাছে তারই নাম ভাবসমাধি।

স্বপন আর সুষেণ তাকে পাঁজাকোলা করে একটা গাড়িতে নিয়ে শুইয়ে দিলো তারপর আর কিছু মনে নেই। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের কথা একা মাকে জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি। রোজ মদ খেয়ে বাড়ি ফেরার পর চলতো অকথ্য অত্যাচার। বিয়েতে কিছু না দিতে পারায় ওর মাকে অশ্রাব্য গালাগাল করতো স্বপন। তারপর একদিন যখন নিজের মাতাল বন্ধু সুষেণকে সাথে নিয়ে আসলো, সেদিন আর সহ্য করতে পারেনি সে। দুটো পুরুষের সাথে যথাসাধ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তার পরের দিন যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন বিশাল একটা গাছের নিচে নিজেকে উদ্ধার করলো সে। বড় একটা পাথরের গায়ে মাথা লেগে অনেকটা রক্ত বয়ে গেছে। পাথরটাও রক্তে ভিজে লাল হয়ে গিয়েছিলো। তারপরে কেমন করে যে রটে গেলো যে ভৈরববাবার দয়াতে নাকি সে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

সত্য ঘটনাটা কাউকে জানায়নি মিনতি। তার বদলে নিজেকে নিবেদন করেছে সে ঈশ্বরের চরণে। দুঃস্বপ্নেও অতীতের পথ আর মাড়াতে চায় না সে। নিজের গ্রামখানি এখান থেকে কতটা দূরে সেই ব্যাপারেও কোনো ধারণা নেই তার। তারপর ধীরে ধীরে আশেপাশের গ্রামের লোক আসা শুরু করলো এই পুণ্য স্থানে। জাগ্রত বলে বেশ নামডাক হওয়ার সাথে বছর দুয়েকের মাথায় সরকারি টাকায় পাকা মন্দির স্থাপন হলো। তার এককোণে গড়ে উঠলো ইঁট-পাথরের পোক্ত বসত। মিনতি ততদিনে সবার পরিচিত সাধুবেটি। তন্ত্র-মন্ত্র সে কিছুই জানে না, কিন্তু খেটে খাওয়া গ্রামবাসীর আকুতির কাছে সামান্য ছলচাতুরীতে এখন আর পাপবোধ হয় না তার। চোখ বন্ধ করে সামান্য বিড়বিড়ানিতে যদি কারও ব্যথা-দুঃখের উপশম হয়, তাহলে সেটাকে কি পাপ বলা যায়! প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় ঈশ্বরের কাছে কত প্রশ্ন শুধায় সে। মার্জনা চায় সকল অপরাধের। নয়নের জলে ধুয়ে যায় মনের মোহ-কালিমা যত।

কালো গাড়িটাকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারছিল মিনতি। গ্রামের সবাই এই গাড়িকে চেনে। কিন্তু আজকে তার পিছনে আরও দুটো সাদা গাড়ি আসছে দেখে থমকে গেলো সে। ধুলো উড়িয়ে চারপাশ ঘোলাটে করে মন্দিরের সামনে ব্রেক ধরেছে। নিরাপদ দূরত্বে অন্তত দু'ডজন পোলাপান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। কারও খালি গায়ের প্রতিটি খোপে অপুষ্টি দৃশ্যমান তো কারও অবাক চোখের তারায় খিদে আপাতত গৌণ।

--জয় ভৈরববাবা, জয় মাকালী।

গাড়ির দরজা খুলতেই মেজবাবুর ভরাট গলার সাথে দোহার দিলো তার চ্যালা-চামুন্ডারা। বেশ বড়সড় দল এসেছে সাথে। সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবির উপর নীল রঙের জওহর কোট। বামহাতে সোনালী ঘড়ি। ঢাউস পেটটা তার আধহাত আগে চলছে। কালো চশমা খুলে নিয়ে মন্দিরে মাথা ঠেকান মেজবাবু।

--ইবার সামনের অউ মাঠো চড়ক পূজার মেলা বইবো গো সাধুবেটি। তুমার উপরে সব দায়িত্ব।

জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিনতির উদ্দেশ্যে কথাটা ছুঁড়ে কপট হাসি হাসেন মেজবাবু। নানা বয়সী মানুষের ভিড়ে এতক্ষণে ছয়লাপ মন্দির চত্বর। সামনেই নির্বাচন তাই বুঝি এতো দৌঁড়-ঝাঁপ! গলা খাঁকরে আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার কথা ঘোষণা করেন তিনি। মাকালী-ভৈরববাবার জয়ধ্বনির সাথে মেজবাবুর নামও সামিল হয় এবার। আর তাতে গা-পিত্তি জ্বলে ওঠে মিনতির। মুখোশের আড়ালের জানোয়ারটাকে সবাই চিনলে কি আর জয়ধ্বনি দিতো! এতো রাগ তার কোনওদিন হয়নি। লোকটা বারবার যখন তাকে রাতের আঁধারে ক্ষতবিক্ষত করে দিতো, তখনও না। কিন্তু কেমন করে তার ব্যাপারে জানতে পেরেছিল এই মেজবাবু! জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। জিজ্ঞেস করলেও কি উত্তর পেতো!

 

বলদে চড়িয়া শিবে

শিঙ্গায় দিলা হাঁক,

আর শিঙ্গা শুনি মর্ত্যেতে

বাজিয়া উঠল ঢাক।

 

টাকার জোরে সবই হয়! প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে সপ্তাহখানেকের মাথায় মাঠজুড়ে বসে চড়কমেলা। জলভরা একটি পাত্রে বুড়োবাবাকে ভক্তিভরে স্থাপন করা হয়েছে। চড়কগাছে ভক্তকে লোহার হুড়কো পিঠে লাগিয়ে ঘোরানো দেখে চিৎকার করে ওঠে কচিকাঁচারা। এই ভক্ত বা সন্ন্যাসীরা ভিনগ্রাম থেকে এসেছেন। গ্রামের মানুষ এদের দেখেনি কখনও। চিরাচরিত অনুষ্ঠানের সাথে রকমারি মুখরোচক খাবারদাবার ছাড়াও বাঁশ ও তালপাতার রঙিন বাঁশি, বেলুন, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, চরকি, পুতুল, কাঁচের চুড়ি, পুঁতির মালা - এইসবের পসরা সাজিয়ে বসেছে ছোট ছোট দোকানিরা। একদিনের এই মেলাতে লোকজনও বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে। ভোটের মুখে পালে হাওয়া টানতে মেজবাবুর এই মোক্ষম চালের প্রশংসা করছে রাজনীতি সচেতন মানুষজন।

দিনের আলো ঢলে যাওয়ার সাথে সাথেই মন্দিরে এসে ধূপধুনা দিয়েছে মিনতি। দিনের বেলা প্রখর রোদে দৌঁড়ঝাঁপ করার কারণে মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পর গভীর ঘুমে ডুবে যায় সে। মাইকের আওয়াজ, ভেঁপুর শব্দ, শিশু-কিশোরদের কলতান কিছুই কানে আসে না তার। পথের দুপাশে লাগানো হ্যালোজেন আলোর বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। গ্রামগঞ্জে ন'টার পরেই মধ্যরাত। তাও মেলা চলে প্রায় দশটা পর্যন্ত। ঘুম ভাঙলে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে মিনতি। চোখ ধাঁধানো আলোয় চিরপরিচিত জায়গাটা কেমন যেন অপরিচিতের মতো দেখাচ্ছে। ঝাঁকড়া রুপসী গাছের জটিলতা ভেদ করে ঢুকে যেতে চাইছে ক্ষিপ্র আলো। রাত ঠিক ক'টা বাজে বোঝার উপায় নেই। দুটো বাতাসা দিয়ে একগ্লাস জল ঢকঢক করে গিলে আবার শুয়ে পড়ে সে।

ঘুম ভাঙে দরজায় বাজেভাবে কড়া নাড়ার শব্দে। চোখ খুলতেই দুটো ইন্দ্রিয় একসাথে সাড়া দেয়। আঁধার আর এই সুগন্ধ দুটোই খুব পরিচিত তার। আলোর খেলা ভোজবাজির মতো উবে গেছে কিন্তু এই গন্ধের অধীশ্বর এতোদিন পরে তার দুয়ারে! একটু অবাক হয় সে। দরজা খুলে দিতেই মেজবাবুর পেছন পেছন পাঁজাকোলা করে কাউকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় দু'জন যুবক। আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বাইরে যাওয়ায় নির্দেশ দেন হীরক বিশ্বাস। পিদিমের দপদপানির সাথে যুবতী মেয়ের চাপা গোঙানি স্পষ্ট শুনতে পায় মিনতি। যন্ত্রচালিতের মতো আদেশ পালন করে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় সে। ছেলেদুটো ছায়ামূর্তির মতো কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। ফিসফিসানিতেই তাদের একজনের গলা চিনতে পারে মিনতি। কান-মাথা এতোটাই গরম হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। ধীরে ধীরে কোমর থেকে চাবি খোলে সে। নিঃশব্দে মন্দিরে ঢুকে মা কালীর হাতের খড়গ নিজের হাতে তুলে নেয়। ছেলে দুটোর এদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, সিগারেটের সাথে আলাপ জমে উঠেছে। হাবভাবে মনে হয় এরকম ঘটনার আকছারই মুখোমুখি হয় তারা। দরজা খুলতেই বিরক্তি আর ক্রোধ একসাথে ধরা দেয় মেজবাবুর গলায়।

কার এত্তো সাহস!

--শালি রেন্ডি...

হাতে কিছু একটা নিয়ে মিনতিকে এগিয়ে আসতে দেখে ক্রোধে গর্জে ওঠা মাত্রই খড়গের কোপ সোজা তার কানের নিচে এসে পড়ে। ফিনকি দিয়ে বেরোনো উষ্ণ রক্ত ছিটকে এসে মুখ-চোখে পড়লেও মিনতিকে দমাতে পারে না। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝে বডিগার্ডরা দৌঁড়ে আসার আগেই উপর্যুপুরি কোপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে হীরক বিশ্বাসের মেদভরা দেহ। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মিনতির বীভৎস চিৎকার আর পিদিমের কাঁপা আলোয় গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ছেলেদুটোর। সাধুবেটির রক্তমাখা মুখে চোখ দুটো ভাঁটার মতো জ্বলছে। ভয়ে আতঙ্কে জ্ঞান হারায় একজন। ভয়াল দর্শন সাধুবেটিকে দেখে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না চয়নেরও। সেও বুঝি এখনই জ্ঞান হারাবে। ধপাস করে পায়ে পড়ে সাধুবেটির। আশেপাশের বাড়িতে ততক্ষণে টর্চ-লণ্ঠনের আলো জেগে উঠেছে। হুঁশ ফিরে পেলে বিছানার চাদর দিয়ে অর্ধনগ্ন তরুণীটির শরীর ঢেকে দেয় সে। এ কি করে ফেললো! এখন সব জানাজানি হয়ে গেলে যে তারও রক্ষে নেই। চয়ন বোধহয় পড়েই অজ্ঞান হয়ে গেছে। নাহ, এই ঘোর কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেলে চলবে না। রক্তে আঠা হয়ে যাওয়া খড়গ আবার হাতে তুলে চিৎকার করতে থাকে সে। ভয়ঙ্কর এই শব্দ কানে গেলে সে নিজেই শিউরে ওঠে। তাহলে দেবতার ভর কি সত্যিই পেয়ে বসেছে তাকে! বাইরে ধীরে ধীরে আলো ফুটছে। মন্দিরে মুহুর্মুহু শঙ্খ-উলুধ্বনিতে বসন্ত ভোরের বাতাস পবিত্রতর হয়ে ওঠে।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন