শোষক

 #শোষক

।।তৃণময় সেন।।
"চল কবাডি তারা,
নিতাই আমার শালা,
বংশী আমার গুণের ভাই,
টিকি জ্বালাইয়া তামাক খাই, তামাক খাই, তামাক খাই, তামাক খাই....."
রুদ্ধশ্বাসে পিঙ্কিকে ধাওয়া করছে রুশনা। ক্ষিপ্র বেগে ডান হাতটা ছুঁড়ে দিচ্ছে বারবার। দৌঁড়ানোর তীব্রতায় তার শরীরটা ধনুকের মতো সামনের দিকে উত্তুঙ্গ হয়ে আছে। কিশোরী শরীরের নারীত্ব হালকা হলেও বেশ স্পষ্টভাবেই ধরা দিচ্ছে। মাত্র কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান, পিঙ্কির জামা মধ্যমাটা বুঝি ছুঁয়েই ফেললো। কিন্তু আর দম ধরে রাখা যাচ্ছে না, গলার পাশের রগ ফুলে উঠেছে। দম ছেড়ে দিলে পিঙ্কিরা দলবলসহ ওকে ছুঁয়ে ফেলবে। বন্দী খেলার এটাই তো নিয়ম।
না, আর পারা যাবে না। অনেকক্ষণ ধরে দম ধরে রাখার দরুন সরল কৃষ্ণকায় মুখখানা থমথমে রক্তিমাভ হয়ে উঠেছে। পিঙ্কিকে ধাওয়া করা ছেড়ে পিছন ফিরে এইবার নিজের দলের বৃত্তে ফেরার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে রুশনা। শ্বাস ধরে রাখার ক্ষেত্রে এইবার আত্মসমর্পণ করে তার ছোট্ট ফুসফুস। "তামাক খাই, তামাক খাই"-এর মাঝে মিলিসেকেন্ডের শ্বাস নেওয়ার ব্যাপারটা ধরে ফেলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
-- উয়া ছাড়ছে রে, উয়া ছাড়ছে। টেঁপি-ভুতু-রমিজ আউগাও রে!!
চিৎকার-চেঁচামেচিতে পাড়া মাথায় করে রেখেছে কচিকাঁচারা। বলাই নমঃশূদ্রের বাড়ির বড় উঠোনে গোল্লা, বন্দীর প্রাত্যহিক আসর আজও জমজমাট হয়ে গেছে। দলনেত্রী পিঙ্কির আহ্বানে, রুশনাকে চারদিক থেকে আক্রমণ করে সবাই। নিজেকে বাঁচাতে আমগাছের পাশ ধরে দণ্ডকলস-কচু-ভাটির সবুজকে মাড়িয়ে পুকুরপাড়ের ছনবনের পেছনে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে রুশনা। পুকুরের এপার থেকে দেখলে ছনবনের ডগায় যেন চুমু খাচ্ছে ধূসর-গোলাপি মেঘ। সূর্যদেব কয়েক মিনিট আগেই বিদায় নিয়েছেন।
--তোর খেইড় আবো শেষ অইলো নানি রে বান্দীর পুড়ি? আন্ধাইর অইগেছে তেবো বাড়িত আইবার জানে কয় না, নানি!!
রুশনার মা জাহানারার আওয়াজে টানটান উত্তেজনায় ভাঁটার টান পড়ে। স্যাঁতসেঁতে উঠোনের কোণ থেকে মেয়ের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে ওঠে জাহানারা। দুই বাড়ির সীমানায় সমান্তরাল করে বেঁধে রাখা বেতি বাঁশের গায়ে সুপারির খোলের পলকা আচ্ছাদন। একটু উঁকি দিলেই পাশের বাড়ির উঠোন সাফ দেখা যায়। ওপারে দাঁড়িয়ে দাঁত পিষে যাচ্ছে জাহানারা। রুশনাটাকে দেখা যাচ্ছে না, মায়ের আওয়াজ শুনে লুকিয়ে গেছে হয়তো! আর চিল্লানোর জোর নেই গায়ে, ঢাউস পেটটার নিচে এক হাতে দিয়ে ধরে রেখেছে সে। উঠোনের এই দিকটা সবুজ শ্যাওলার সাম্রাজ্য। এই অবস্থায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে আর উপায় নেই।
-- হরুতা মানুষ, এবলা না খেল্লে আর কুনদিন খেলতো! অতো গালিয়াছ কেনে?
হুঁকো হাতে দাওয়ায় বসা শাশুড়ির দার্শনিক ভাষণ শুনে গা-পিত্তি জ্বলে যায় জাহানারার। আছমাটা দু’দিন থেকে জ্বরে ভুগছে। তিন বছরের রুকনকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আড্ডা আর পান-হুঁকোর সুখটান ছাড়া নিজে তো পরিবারটার কাজে মোটেই হাত লাগান না অথচ মুখে বড় বড় কথা।
-- আছমার শরীল ভালা নায় দুই দিন থনে, ইবায় রুকন ইগু আমাগইর দিয়া পুরখীর পারো যায় গিয়া। একলা মানুষ অইয়া আর কত বায় দেখতাম আমি!
-- তুইন দুনিয়ায় জমিনো একলা বেটি নি রে? হারা জীবন অতোগু বাচ্চাইনতরে মানু করলাম, তোর লাকান তো একদিনউ প্যাঁনদাইছি না।
-- অয়, হকল দুষ তো আমার! হারা দিন তাইর খেইড়, ভাই-বইন ইগুনতরে দেখলে তো আর গুণাহ অর না! বই খুলারও নাম নাই। কইয়া ভুল করছি আমি!
-- ইস্কুল খুলা থাকলে তো হিবায় রুজ অউ যায়। অতো পড়া পড়া না করিয়া দামান্দ খুঁজো। বেটিনতর জাত, বেশ পড়িয়া কিতা অইতো?
-- আমি বাঁচিয়া থাকতে মেট্রিক ফাসর আগে বিয়া দেইয়ার না। কচমা বয়সো পুড়িরে বিয়া দিলাইবার আগে আমারে জানে মারতে লাইগবো।
চাপা গলায় বলা কথাটা বারান্দা অবধি না পৌঁছানোয়, মাঝপথেই শেষ হয়ে যায় শাশুড়ি-বৌয়ের উষ্ণ বাক্যালাপ। মেয়ের জীবনটা কোনোভাবেই নিজের মতো হতে দেবে না, প্রতিজ্ঞা করেছে জাহানারা।
গ্রামটার নাম 'জলাগ্রাম' কেন পড়লো, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। যদিও গ্রামের প্রবীণতম ব্যক্তি সলিমউল্লাহ ওরফে সর্বজনবিদিত গাংপীরের মুখে শোনা স্বাধীনতার প্রাক্কালের ঘটনাটাই বিশ্বাস করে সিংহভাগ গ্রামবাসী। শহর শিলচরের পশ্চিম প্রান্ত ধরে এগোলে বাইশ-তেইশ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটিতে মনিপুরী মানুষরাই সংখ্যাগুরু। মেইন রোড হয়ে গ্রাম ‘তিনঘরি’ পেরিয়ে জলাগ্রাম ঢোকার মুখে "হিঙুলা" নালার পার ঘেঁষে কিছু মুসলমান মৎস্যজীবী ও বাঁশ-বেতের কাজ করা পাটনি-নমঃশূদ্র পরিবারের বাস। সতেরো-আঠারো পরিবারের মধ্যে হিন্দু থেকে মুসলিমই বেশি।
নালাপারের এই ছোট বস্তিতে ঢোকার রাস্তা বলতে হালি বিচারার সবচেয়ে বড় আলটিকে সবাই অগ্রাধিকার দেয়। পায়ে হাঁটা ছাড়াও নিরালা আলে সাইকেল নিয়েও দিব্বি চলাফেরা করা যায়। হালি বিচারার মাটি সাধারণ ক্ষেতের মাটির মতো বর্ষাতেও গলে না, বৃষ্টির জমা জল আস্তে আস্তে শুষে হজম করে নেয়। হালিচারা চাষ ছাড়া এই পাষাণ মাটিতে আর কোনো চাষবাস করা যায় না। গ্রামের লোক তাই এই মাটিকে ‘বাইন্জর বিচরা' মানে বাঁজা মাটিও বলে থাকে।
মাঠ বেয়ে আসার পর সামনে স্বয়ম্ভু নালা। খাল-বিল-বৃষ্টির জমা জল তিরতির করে বয়ে যায় হিঙ্গুলা নালা দিয়ে। বস্তুত, মোহনপুর থেকে তিনঘরির মাঠ বেয়ে আসা অযাচিত তরলই তার সৃষ্টির উৎস। জলাগ্রামের এই ছোট বস্তি ছাড়া আর কোথাও তার গা-ছুঁয়ে কোনো বসতি নেই। মাঠ-প্রান্তরের বুক চিরে সে চলে আপন মনে। সারা বছর কোনো দুর্বল সরীসৃপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া হিঙ্গুলা সময়-অসময়ের বর্ষণে ক্ষিপ্র অজগর হয়ে ওঠে। উদ্যত ফণা নিয়ে সে ঢুকে পড়ে জলাগ্রাম বস্তিটির দরিদ্র মানুষের আঙিনায়। ঘর-বাড়ি তছনছ করে দিয়ে যাওয়ার পথে সে রেখে যায় নানা ধরনের রোগ, তার মতো বুকে হাঁটা বিভিন্ন ধরনের সরীসৃপ, নোংরা পলির সাথে গ্রামের মানুষেরই নানা বর্জ্য পদার্থকে। বদমেজাজি হিঙ্গুলার হাত থেকে বাঁচতে প্রায় সবাই পুকুর পাড়ে আলকাতরা লেপা একখানা নৌকা রাখে। ঘর-বাড়িতে জল ঢুকে গেলে স্ত্রী-লোক, বাচ্চা-বুড়োদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে পুরুষরা নৌকায় সওয়ার হয়ে বাড়ি পাহারা দেয়।
নালা পেরিয়ে বাড়ি ঢোকার জন্য দুটো করে বরুয়া বা জাইলেম বাঁশ ফেলে বেশ শক্তপোক্ত অথচ ঝুঁকিপূর্ণ সেতু সবার বাড়ির সামনে আছে। সাধারণ মানুষ পেরোতে গেলে পা কাঁপবে, কিন্তু আজন্ম এই পরিবেশে থাকা মানুষ সার্কাসের কুশীলবের মতো তরতরিয়ে সেতু বেয়ে বাড়ি পৌঁছে যায়। বস্তিটি নানা প্রজাতির বাঁশবনে ঘেরা, তাই মেরামত বাবদ বৎসরে দু'বার সেতুর বাঁশ পাল্টাতে গেলে কোনো অসুবিধা হয় না। বন্যার সময় হিঙ্গুলার জল বাঁশের সেতুর ওপর দিয়ে বয়ে যায়। একে তো জলের তীব্রতা, তার ওপর বাঁশের মতো জিনিস জলের নিচে দু-তিনদিন পড়ে থাকলে পচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সারা রাজ্যে প্রতি বৎসর দু-একবার বন্যা হয়ে থাকলেও, জলাগ্রাম বস্তিতে সংখ্যাটা প্রতি বছর চার-পাঁচের মধ্যেই থাকে। তাই বৃষ্টি দেখলে রোমান্টিক হতে পারে না এখানকার মানুষ। প্রবাদ আছে “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়”। লাগাতার দু’দিনের প্রবল বর্ষণেই চোখ ছলছল হয়ে ওঠে গ্রামবাসীর।
ঘুরপথে আসলে আল ছাড়াও বস্তিতে ঢোকার আরেকটা পথ আছে বটে। কিন্তু একে তো দূরত্ব তার ওপর প্রাক্তন বিধায়কের নামে শিলান্যাস করা ওই পথের প্রায় তিনশ মিটার জুড়ে নুনছড়ি টিলার প্রচণ্ড আঠালো লালমাটি পড়ার পরে আর কোনো কাজ হয়নি। দু’চক্কর রোলার চালিয়ে নিলে হয়তো মাটিটা খাপ খেয়ে যেত। কিন্তু নির্বাচনের মাস কয়েক আগের অসম্পূর্ণ কাজটি কেউ যেন দেখেও দেখে না। ভোটের পরে সবাই নিস্তেজ হয়ে গেছে। নতুন বিধায়ক মন্ত্রী হয়ে গেলেও কোনো লাভ হয়নি। ভোটের বাক্সে এই অঞ্চলের লোকের কৃতকর্মের খতিয়ান ওনার ব্যক্তিগত সচিবের খাতায় কড়ায়-গণ্ডায় লেখা আছে। তাই জল-কাদা ডিঙিয়ে যাওবা একটু অটো-বাইক নিয়ে যাতায়াত করা যেত, অমন পিছলা লালমাটি ফেলার পর থেকে চলাচল প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়েছে।
-- দুলাভাই, ও দুলাভাই। কানো রেভো!
-- ও বেটা বারে থনে চিল্লারে কেনে রে! ঘরে দি আয়।
ফরিজের আওয়াজ এই বাড়ির সবাই চেনে। মাথায় ধবধবে সাদা টুপি, ধূসর পাঞ্জাবির সাথে নীল-সাদা লুঙ্গি পরিহিত ফরিজের মুখখানা নধর কালো দাড়িতে ঢাকা। অবিরত সুপারি চিবানোয় তার কষে ঠোঁট দুটো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত আঠারো-ঊনিশ বছরের তরুণ ফরিজের এতদঞ্চলে বেশ নাম-ডাক। কোরানের ত্রিশ পারা মুখস্ত করে সে এখন তিনঘরি দ্বিতীয় খন্ডের একজন সম্মানিত হাফেজ। পাকা মসজিদের ইমাম সাহেবের প্রিয়পাত্র। জাহানারার সেজো ভাই এই ফরিজ পিসির ছেলে নওশাদকে আগে 'ভাইসাব' বলে সম্বোধন করতো। বিয়ের পরে দুলাভাই করে ডাকে। বয়সে অনেক বড় নওশাদের সাথে তার ছোটবেলা থেকেই বন্ধুর মতো সম্পর্ক। একটা সময় ঝাঁকি জাল নিয়ে, নৌকা বেয়ে, মৌমাছির চাক ভাঙার মতো নানা অছিলা নিয়ে ওদের বাড়ি আসতো নওশাদ। বিয়ের পরে জাহানারাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর ওমুখো হয় না।
কোলে-কাঁখে করে বড় করলেও বোনের প্রতি খুব একটা টান নেই ফরিজের। তাই বোনের হাতে বানানো চায়ের সাথে ‘টা’ হিসেবে চানা বিরান-সিদ্ধ পিঠা-পোলাও আয়েশ করে উদরস্থ করেও শুধু দুলাভাইয়ের সঙ্গে গল্পে মশগুল থাকে সে। শ্বশুরবাড়িতে বোন কেমন আছে, তা জানতে বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই তার। হাফেজ সাহেবকে যত্ন-আত্তি করে নেকি অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না জাহানারার শাশুড়ি ফুলজান বিবি। তাই ফরিজ বাড়ি আসলেই হুঁকোতে টান দেওয়ার ফাঁকে রকমারি খাবার তৈরী করার নির্দেশ দিতে ভুলে যান না তিনি।
-- পানি তো বাড়ের দুলাভাই। কইয়ার কাইল বিয়ানে ফাঁসজাল ওখান লইয়া বার হইতায় নি?
-- বারইলে তো বারইল যার। নাও ওখানো থুড়া পুটিন মারতে লাগইবো।
-- তুমার জাল ইখান কোনো রাখছো? ইবার মনোহয় আর বার করছ না, নানি?
-- ফাঁসজাল দিয়া মাছ মারলে পুলিশে ধরে নু হুনলাম! ঝাঁকি জাল ওখান লইয়া বার অই, কিতা কছ?
-- যাও বা! হকল বায় অকন করোনার গফ আর আমরার ইবায়দি আইসে পানি। ইনো পুলিশ কান থনে আইতো!
ফরিজের মুখে মিথ্যে আত্মবিশ্বাসের চতুর হাসি। নওশাদকে চিন্তামুক্ত করতে নিজের কথাতে আরেকটু জোর দেয় সে।
-- হারা জীবন ফাঁসজাল লইয়া তিনঘরি-জলগ্রাম-খাম্বারবাজারোর ওবায় গিয়া মাছ ধরলাম। কেউ কুনতা কইলো না। তুমি হুদ্দাহুদ্দি ডরাইরায় বা দুলাভাই।
-- ঠিক আছে। তে তুই খলুই এগু লগে লইছ, আমার ইগু ভাঙ্গি গেছে।
-- আইচ্ছা ঠিক আছে। আতো, পাওয়ো কেরেছ লাগাইয়া বার অইয়ো। ঘুলা পানিত ভইসা জোঁক বড় জবর থাকে।
বর্ষার দিনে জমা জলের নিচে থাকা সবচেয়ে বেয়াড়া অথচ ভয়ংকর জীবের বিরুদ্ধে সতর্কতা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাড়িমুখো হয় ফরিজ।
জলাগ্রামের দক্ষিণে খাম্বারবাজার-বুরুঙ্গাতে অনেক সম্ভ্রান্ত লোকের বাস। খানদানি মুসলিম পরিবারের পাশাপাশি আছে অনেক বিষ্ণুপ্রিয়া-মৈতেই গোত্রের মণিপুরী মানুষ। বেশিরভাগ পরিবারের ছেলেরা সেনাবাহিনীতে আছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ওরা বেশ এগিয়ে। একটা করে হাইস্কুল এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রও আছে ওই এলাকাতে। জলাগ্রাম থেকে বুরুঙ্গা যাওয়ার পথে ডানদিকে ক্ষেতের মাঠ আর বামদিকে বাঁশের বেড়ায় ঘেরা পল্লী বাড়ি। প্রতিটা বাড়ির সামনে টলটলে জলের ছিমছাম পুকুর। বছর খানেক আগেও ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে লাজুক বধূর মতো সবুজ-সোনালী-হলুদ রঙে সেজেগুজে থাকতো মাঠখানা, কিন্তু এখন মাঝে মাঝেই যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে ইঁট-পাথরের ঘরগুলো। ক্ষেতের মাঠের মাঝে ইঁটভাটার বিশাল চিমনি দূর থেকেই দৃশ্যমান। ভাটার কাজ সারা বছর চলে না। বর্ষাপ্রবণ রাজ্যের এই প্রত্যন্ত এলাকার আকাশে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত উড়ে বেড়ায় চিমনির ধোঁয়া। হাজীসাহেবের এই সাবেকী ইঁটভাটাতে বছর ছয়-সাত ধরে কাজ করে আসছে নওশাদ।
গুণগত মানের জন্য ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর পুরানো ইঁটভাটার এই তল্লাটে বেশ সুনাম আছে। মোহনপুর, বারোপোয়া, হিলারা, খাম্বারবাজার, বিহাড়াসহ আরও অনেক জায়গায় 'এইচ এম আর' খোদাই করা ইঁট জনপ্রিয়। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে হাজী মতিউর রহমান যখন এই ভাটাটির কাজ শুরু করেছিলেন, তখন আশপাশের চার-পাঁচ মাইল জুড়ে হাতে গোনা পাকা ঘর ছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ছনের বাড়ি আর খেটে খাওয়া মানুষের খড়ের ছাউনি ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আজকাল আর খড়-ছনের ঘর দেখাই যায় না। টিন আর ইঁট-পাথরের কঠিন দেওয়ালের আড়ালে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে থেকে মাটির গন্ধ কর্পূরের মতো ধীরে ধীরে যেন উবে যাচ্ছে।
কাজের মরশুমে ইঁটভাটার শ্রমিকদের সাপ্তাহিক বেতন প্রতি জুম্মাবারে হয়। মরশুম শেষ হলে বোনাস হিসাবে নগদের সাথে উপহার নিজের হাতে বিতরণ করেন হাজীসাহেব। শরীর খুব একটা সুবিধের না থাকায় দু'বছর ধরে ওনার জায়গায় ছেলে দেখাশোনা করছে কারবার। কাজে স্বাধীনতা ছাড়াও এখন আর আগের মতো বোনাস বা উপহার কিছুই পাওয়া যায় না। লম্বা মতো নীল গাড়িতে চড়ে নতুন মালিক ইঁটভাটায় আসলে কারও না কারও কাজে খুঁত ধরবেনই। ওনার আগমনে তটস্থ থাকে ম্যানেজার সুদাম, সবার প্রিয় সিনহাদা। মনে মনে বিরক্ত হয়ে গেলেও নওশাদের কাছে কোনো উপায় নেই। সারা বছর তো আর মাছ ধরা, ক্ষেত-কৃষি করলে পরিবার চালানো যাবে না।
ঘরে তেল-নুন-মশলা বাড়ন্ত। তাই নাস্তা সেরে উদাসীন পায়ে আলপথ ধরে নওশাদ। উদ্দেশ্য, মেইন রোডের লাগোয়া লাদেনের গালামালের দোকান। আচমকা লক ডাউন ঘোষণা হওয়ায় এইবার মাস দেড়েক আগেই ইঁটভাটার কাজ বন্ধ হয়েছে। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে খোলার নির্দেশ পেলেও ছোটবাবু ভাট্টা খুলতে রাজি ছিলেন না। কাল-বৈশাখীর শেষে রোজ দু’বেলা করে ঝড়-বৃষ্টিও তার কারণ ছিল। অসময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এইবার আর বোনাসের নামে শ্রমিকদের কানাকড়িও দেওয়া হয়নি। কিছুদিন থেকে নজর এড়িয়ে চললেও আজ একান্ত বিপদে পড়ে দোকানমুখো হচ্ছে নওশাদ। বোনাস পেয়ে সাড়ে সাতশো টাকার দেনা শোধ করবে ভাবছিল। আজ কি জানি কি শুনতে হবে লাদেনের মুখ থেকে।
-- আও রেবা জমিদার বেটা। তুমারে আইজকাল দেখা যায় না। আতারে-পাথারে আটাআটি কর, ইবায় পাড়া খান মারো না!
তির্যক মন্তব্য শোনা প্রত্যাশিতই ছিল, তাই লাদেনের কথায় কোনো উচ্চবাচ্য করে না নওশাদ। লকডাউন উপলক্ষ্যে সারাটা দেশ জুড়ে নানা দূরভিসন্ধির সফলতায় যে যৎসামান্য ক'জন খুশি হয়েছে, তাদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্র পাল ওরফে লাদেন অন্যতম। জিনিসপত্রের আগুনপোড়া দাম নেওয়ার জন্য নামখানা 'লাদেন' হয়েছে। একটা সময় ছিল সবাই মনে মনে জানলেও মুখের ওপর কেউ ‘লাদেন’ বলতো না। কিন্তু একদিন গ্রামের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, হাইস্কুল শিক্ষক রমাপদ সিনহা মুখ ফসকে ওকে লাদেন বলার পর থেকে আর কেউ তোয়াক্কা করেনি।
একজোড়া গোঁফ আর কাঁচাপাকা চুলের অধিকারী লাদেনের বয়স সবেমাত্র পঞ্চাশের কোঠায় পড়েছে। চোখ-মুখে ধূর্ততার ছাপ। তার ডান-পা তুলনায় ছোট। রোজ সকাল আটটায় জং ধরা সাইকেলে চড়ে মোহনপুর থেকে আসে সে। সাইকেলটা এতোই পুরানো যে কোন কোম্পানির, তা ধরবার উপায় নেই। চেইন কভার লোহার তার দিয়ে বাঁধা। একটা স্কুটি কেনার স্বপ্ন মনে জিইয়ে রেখে সাধের মানব জনম হয়তো কাটিয়েই দেবে লাদেন। সড়কের আশপাশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মণিপুরী পরিবারগুলো রেশন-খরচ নেয় না বলে বড্ড অভিমান তার। জলাগ্রাম থেকে মিনিসিটিতে বসলে পৌনে ঘন্টায় শিলচর পৌঁছানো যায়। অপরিকল্পিত শহরের বুক ফুঁড়ে জন্ম নেওয়া সুপারমার্কেট-মলগুলোর বাণিজ্যিক হাতছানিতে হারিয়ে যাচ্ছে লাদেনদের অস্তিত্ব। তাছাড়া কালাইনেও নাকি একটা ফুড-মার্ট খুলেছে। বেশী খরচাপাতি করলে ওরা প্লাস্টিকের বালতি, জলের জগ, গামলা ইত্যাদি বিনামূল্যে দিচ্ছে গ্রাহকদের। দু'চাকা-চার চাকায় মিনিট দশেক চললেই কালাইন বাজার। তাই চলনসই পরিবারের নগদী ক্রেতারা লাদেনের দোকানের বদলে বাইরে থেকেই মাসকাবারী রেশন নিয়ে আসে। তার স্থায়ী গ্রাহক বলতে হিঙ্গুলা পাড়ের এই গরিব মানুষগুলো। নগদ গ্রাহক প্রায় নেই বললেই চলে। তাই কেরোসিন, মশলা, তেল, ডাল ইত্যাদির দাম খাতায় লেখার সময় একটু চড়া দরেই লিখে রাখে সে। লকডাউনের বিষয়টা আঁচ করতে পেরেই মহাজনের গোদামঘরে অটো-ট্রাক নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলো লাদেন। দোকানঘর টইটম্বুর করে মাল ভরেছে। আসার পথে পুলিশ স্টেশনে একখান লম্বা নোট ধরিয়ে দিয়ে আসার পর আগুনপোড়া দাম নিতে রমাপদ পন্ডিত থেকে শুরু করে গ্রাম পঞ্চায়েত মেম্বার আব্দুস ছাত্তার কাউকে রেয়াত করেনি লাদেন।
-- থোড়া জিনিস নিতাম আসলাম লাদেনদা ।
দু'শো টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে সসংকোচে বলে নওশাদ। টাকার দিকে হাত না বাড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড তার মুখপানে চেয়ে থাকে লাদেন। অস্বস্তিকর পরিবেশে লাদেনের চোখে চোখ পড়লে এদিক ওদিক দেখতে থাকে সে।
-- তুমার দুইশো টেকা লইয়া আমি কিতা করতাম বা! আইজ ছয় মাস সাড়ে সাত'শো দেয়ার না। ইলা করলে তো আমার দুকান বন্ধ করতে লাইগবো।
-- কিতা করতাম কও দাদা। ইবার ভাট্টাও আখতা করি বন্ধ অই গেলো। কয়টা টেকা পাইতাম আসলাম, পাইলাম না। না অইলে অতোদিন ধরি তুমার পয়সা দিলাম নানি ওনে কও চাইন?
--দেখো বা, বাকি দিতে আমি কোনোদিন না করছি না। কিন্তু এখন সময়টা ভালা নায়, তুমিও জানো।
আধালিটার খোলা তেল আর এক কিলো নুন নিতে নব্বই টাকা লেগে গেল। বাকি টাকাটা খাতায় জমা দেওয়ায় হলুদ, মুসুর ডাল, চিনি কিছুই আর নেওয়া হলো না নওশাদের। আগামী মাস পর্যন্ত দেনা শোধ করতে না পারলে আর কিছু না দেওয়ার ফরমান জারি করেছে লাদেন। মাথা নিচু করে বাড়ির পথ ধরে সে।
"তখন মনে হইয়াছিল, অশ্বত্থবৃক্ষ বড় রসিক, এই নিরস পাষাণ হইতেও রস গ্রহণ করিতেছে। কিছুকাল পরে আর একদিন এই অশ্বত্থগাছ আমার মনে পড়িয়াছিল, তখন ভাবিয়াছিলাম বৃক্ষটি বড় শোষক, ইহার নিকট নীরস পাষাণেরও নিস্তার নাই।"
বাপকে দূর থেকে আসতে দেখে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্যের গদ্যটুকু জোরে জোরে পড়তে শুরু করে দেয় রুশনা। চার দিন বাদে মেঘের সাথে যুদ্ধ জেতা রোদের বিজয়োল্লাস বেশিক্ষণ টেকেনি। মাত্র একটা দিন কোনোমতে কাটতে না কাটতেই আবার কালো মেঘের ষড়যন্ত্রে কুপোকাত হয়েছে নীল আসমান। প্রচন্ড তর্জন-গর্জন শেষে তার অঝোর নিক্ষেপ গাছ-মাটি-পাতার বুকে অবারিত বিঁধে যাচ্ছে। ঘরের ভেতরটা আবছা অন্ধকার। বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে যাওয়ায় জানালা খুলে দিলেও তেমন আলো আসছে না। আয়নার সামনে অস্পষ্ট নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল জাহানারা। আঁচল সরিয়ে-গুছিয়ে নিজেকে দেখলে হৃদয় খুঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। আজকের জাহানারার সাথে পুরানো জাহানারার কোনো সমান্তর খুঁজে না পেয়ে দু’চোখ ভরে আসে। ভালোই হয়েছে আবছা আলোয় মুখখানা পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে না। এই জাহানারাকে সে নিজেই দেখতে চায় না। বেঢপ একটা শরীর, শুষ্ক কালো ঠোঁট, চোখের তলায় কালি পড়েছে। বিয়ের পর থেকে অনেক ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে। রুশনা থেকে শুরু করে রুকন, সবাই অনাকাঙ্খিতভাবেই আশ্রয় পেয়েছে তার জঠরে। রুশনার ছোট একটা ভাই জন্ম নেবার পর তার নীরবতায় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল জাহানারা। হিঙ্গুলার গা-ঘেঁষা ওই হালি বিচরার পাশে সন্তর্পণে শুয়ে আছে সে। তার ছোট্ট কবর ঘেরা সাজানো বাঁশের বেড়া স্রোতের তোড়ে ভেসে গেলেও নিশানদিহি কার্পাস তুলোর গাছ দেখে দূর থেকেই জায়গাটি চিনতে পারে জাহানারা।
বিয়ের সময় সাথে নিয়ে আসা সুগন্ধি পাউডার, লিপস্টিক অনেক বছর আগেই হারিয়ে গেছে। আব্বা বেঁচে থাকলে মাত্র একবার মাধ্যমিক ফেল করার জন্য পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত না। স্ট্রোক নিয়ে সপ্তাহখানেক শহরের নামী নার্সিংহোমে থেকে সোজা বেহেস্তের পথ ধরবার সময় পরিবারটাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গিয়েছিলেন ওর আব্বা। তাই ফুলজান বিবি চাচাতো ভাইয়ের মেয়েকে বউ বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলে কেউ মানা করেনি।
স্কুল জীবনের কথা মনে পড়লে মনটা ভালো হয়ে যায় জাহানারার। তপা, রুবিয়া, বাবলিদের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো আজও অমলিন হয়ে আছে। মনে পড়ে রমাকান্ত সিনহা, ওরফে পন্ডিত স্যারের কথা। অংক বা ইংরেজি গ্রামারে ভুল করলে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে স্বজাতির ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতেন "তুমরা দুধ বেচিয়া হিঁদল খাও, পড়াশোনা মাথায় কই থাকি ঢুকতো!" স্যারের কথায় ফিক করে হেসে ফেলায় তার পিঠেও একবার বেতের দু'ঘা পড়েছিলো। ক্লাস নাইনে থাকাকালীন প্রথম প্রেম হয়। প্রেমিক পোস্টমাস্টারবাবুর ছেলে নন্দন সিনহা। বান্ধবীদের মুখে শোনা খবর অনুযায়ী, সে নাকি ব্যাঙ্গালোরে বড় কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। তার সাথে দেখাও হয়েছিল জাহানারার। বাপের বাড়ি থেকে ফিরতি পথে অটোরিক্সার জন্য অপেক্ষারত জাহানারার পাশ কেটে ধীর গতিতে চলে গিয়েছিলো বাইকটি। পেছনে বসা নীল শাড়ি পরা মুখখানি অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পারেনি জাহানারা। কোলে থাকা রুকনটা ঠিক তখনই কেঁদে ওঠায় তাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
নাছোড়বান্দা বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর থেকে এক মিনিটের জন্যেও থামেনি। বাড়ির উত্তর দিকের আমবনের আশপাশ থেকে কয়েকটা ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকের সাথে টিনের চালে জল পড়ার টুংটাং আওয়াজে রাতটা মুখর হয়ে উঠেছে। বারান্দায় বেরোলে আলো-আঁধারীর খেলা অস্পষ্ট হলেও, খোলা চোখে বেশ দেখা যাচ্ছে। দু'দিন আগেই পূর্ণিমা ছিল। দ্বিতীয়ার আকাশ মেঘ ঢেকে রাখলেও তার উজ্জ্বলতা পুরোটা ঢাকতে পারেনি। কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে রুশনা। এতো বৃষ্টিতে ওদের বাঁশের সেতু এতোক্ষণে বুঝি ডুবেই গেছে। জল পড়ার টুপটাপ শব্দে এমনিতে তার খুব ভালো ঘুম আসে, কিন্তু আজকে তা হওয়ার নয়। সারাদিনের চিনচিন ব্যথা রাত হওয়ার সাথে সাথে বেড়েই চলছে। চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল বালিশে গড়িয়ে পড়ে। প্রতিমাসের এই অসহ্য ব্যথা গত বছর থেকে শুরু হয়েছে। ভয়ে ভয়ে মাকে ব্যাপারটা জানালে, পাত্তাই দেয়নি মা। কয়েক টুকরো কাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা কাউকে না বলতে রীতিমতো শাসিয়েছে তাকে। হয়তো নিজের কোনো ভুলেই জিনিসটা হয়েছে। স্কুলের বন্ধুদের কাছে ব্যাপারটা খুলে না বললে এতোদিনে আপন মনে নিজেকে দোষারোপ করে করে সে শেষই হয়ে যেত। মেয়েরা নাকি তাড়াতাড়ি বড় হয়। গত এক বছরের মধ্যে বান্ধবীদের সাথে হাসি-ঠাট্টার ছলে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে রুশনা। এইরকমই এক ব্যথা ভরা রাতে মায়ের ফিসফিসানি আজও স্পষ্ট মনে আছে তার।
-- পুয়া তো এগু পাইলাইছো আর বাচ্চাইন দি কিতা করতায়? এরে হুনো না গো...
তারপর ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের সাথে হারিয়ে যাওয়া মায়ের গোঙানিতে শুধু কষ্ট আর যন্ত্রণা ছাড়া যে কিছুই ছিল না, তা অনায়াসে বুঝতে পেরেছিল তার কিশোরী মন।
ভোরবেলা পেচ্ছাব করতে উঠে বারান্দায় কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো নওশাদ। চতুর্দিকে শুধু জল আর জল। জলে ঘেরা কোনো ছোট্ট দ্বীপের মাঝে যেন দাঁড়িয়ে আছে সে। হালকা বৃষ্টির কণা নিঃশব্দে ঝরে যাচ্ছে এখনও। এই ধারাবাহিকতা আজকে না থামলে রক্ষা নেই। জল আর একহাত উর্ধ্বমুখী হলে পুকুরের পাড় উপচে মাঠের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। নওশাদের পুকুরে তেমন একটা মাছ-টাছ নেই, কিন্তু এইক্ষেত্রে যাদের পুকুরে মাছ আছে তাদের সম্মুখে তো বড় বিপদ। সাদা জলের কবলে পড়া মাঠখানা যেন কোনো বিশাল সমুদ্র। পুকুরের কোণে বাঁধা নৌকায় চোখ পড়তে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায় নওশাদের। নৌকা আর জাল নিয়ে বেরোলে অনেক বড় মাছ পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। জলাগ্রাম না হোক, কিন্তু নৌকা বেয়ে বুরুঙ্গা বা মোহনপুরের দিকে যেতে পারলে নিরাশ হওয়ার মতো কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তার ফোনটা তো খারাপ হয়ে পড়ে আছে, ফরিজকে খবর দেবে কেমন করে! বলাইদের বাড়ি গিয়ে মাধাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ফরিজের নম্বর ডায়াল করায় নওশাদ। সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। ঘরে ফিরে নাস্তা বানানোর জন্য বৌকে তাড়া দেয় নওশাদ।
-- গাংপীরে কয়দিন আগে কইসলা, বুলে “এমন আঝাব আইবো অউ বটগাছো মেচাঙ বানাইয়া পেলইন দিয়া দাড়কিনা ধরমু আর কবরর দারো চুলাত রান্ধিয়া খাইমু।“
দুর্দিনের পূর্বাভাস অনেক আগেই নিজের অলৌকিক গুণে গাংপীর ধরতে পেরেছিলেন বলে গ্রামের অনেক লোকের মতো ফুলজান বিবিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। অমন কথা সবসময় হেঁয়ালি করেই বলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন বর্ষীয়ান লোকটি। তাঁর কথার রহস্যোদ্ধার করা যার-তার কর্ম নয়। তাই বিপর্যয়ের কথা আঁচ করতে পারলেও, তার সর্বনাশা রূপ দরজায় কড়া না নাড়ানো অবধি বুঝতে পারে না গ্রামের লোকজন।
অসুস্থ নাতনিটার জন্য তেল পড়া আনতে কালো কাঁচের বোতলে আধাবোতল তেল নিয়ে কয়েক দিন আগে গাংপীরের বাড়ি হয়ে এসেছেন ফুলজান বিবি। মেয়েলোকদের সাথে সামনামামনি কথা বলেন না পীরসাহেব। একচালা ঘরের মাঝামাঝি বিভাজক রূপে বাঁধা নীল ফিনফিনে কাপড়ের ওপার হতে সালামসহ নিজের সুখ-দুঃখের কথা তাঁর কাছে নিবেদন করতে হয়। সাদা দাড়ি, আজানুলম্বিত জোব্বা, অসংখ্য বলিরেখা যুক্ত চেহারার মানুষটি দু'চোখ বুজে অস্ফুট গলায় যখন দোয়া পড়েন, তখন তাকে দেখতে বড় অদ্ভুত লাগে। আলতো হাওয়ার দোলায় তাঁর প্রার্থনা ভেসে ভেসে পৌঁছে যায় সঠিক জায়গায়।
ফোনে বলা কথামতো মাথায় বাঁশপাতার শক্তপোক্ত ছাতা গলায় পেঁচিয়ে বড়সড় একখানা খলুইসহ পথের ধারে দুলাভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল ফরিজ। কোমরের নিচের দিকটা ইতিমধ্যেই ভিজে গেছে। বেশ কিছুটা দূরে বৈঠা মেরে এগোনো দুলাভাইকে চিনতে পেরে হাত উঁচিয়ে ইশারা করে সে। সিদ্ধান্ত হলো যে ফরিজ নৌকা সামলাবে আর নওশাদ ঝাঁকি জাল উড়িয়ে ফেলে মাছ ধরবে।
--আমরার ওবায়দি চলো দুলাভাই। পানীয়ে বড় বড় ফিশারির পার মারিলাইছে। রৌ-সিলভার-কমনকাট-গাছকার্ফ হকলতা পাওয়া যাইবো।
-- হাছা নি রে! দেখি কিছু মাছ পাওয়া গেলে আইজ বাজারো লইয়া যাইমু।
মঙ্গলবার মোহনপুর বাজারের কথা মাথায় আছে নওশাদের। এই দুর্দিনে রুজি-রোজগার প্রায় বন্ধ, আজ দিনভর চেষ্টা করলে বাজারে নেওয়ার জন্য কিছু একটা তো পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী সে। আধঘন্টা মতো থেমে গেলেও আবার টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আজ-কালকের মধ্যে বৃষ্টি থেমে না গেলে আবার বাড়িঘরে জল ঢুকে পড়বে। বৌ-বাচ্চাদের শ্বশুরবাড়ি নিয়ে রেখে দিলেও বাকি জিনিসপত্র এদিক-ওদিক করা ভীষণ সমস্যার ব্যাপার। ওদিকে জাহানারার শরীরটার এই অবস্থা। কোনো অঘটন ঘটে গেলে এই দুর্যোগে কোথায় যাবে, কী করবে সে!
প্রায় দু’কিলোর একটা করে মৃগেল ও কাতলা, নানা সাইজের রুই, জাপানি, ফলি, বাটা মাছ ধরা পড়েছে জালে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলেও আকাশের হাবভাব দেখে তা বোঝার উপায় নেই। শরীর ক্লান্ত হয়ে গেলেও মন বাড়ি যেতে চাইছে না নওশাদের। বাড়ি ফেরার কথা এক ঘন্টার মধ্যে; বেশ দু-তিনবার তুলেও ব্যর্থ হয়েছে ফরিজ। খলুই ভরে গেলে প্লাস্টিকের রশি বাঁধানো বাজার ব্যাগে মাছ ভরে রেখেছে সে।
উড়িয়ে ঝাঁকিজাল ফেলার সাথে সাথে হাতের আঙুলে জালের দড়ি বেঁধে সাঁতার, ডুব-সাঁতারে নিজের সেরাটা ছুঁড়ে দিচ্ছে নওশাদ। তিনঘরির এই দিকটার জলটাও অনেক বেশী। কখনও গলা তো কখনও বুক অবধি জলের নিচে দাঁড়িয়ে সমানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে এখন। জালের নিচে হঠাৎ বড় মাছের ঘাই তুলতে দেখে টুপ করে তলিয়ে যায় নওশাদ। এটা কয়েক কিলোর মাছ হবে নিশ্চয়। অসামান্য দক্ষতায় জাল দিয়ে ভালো মতো পেঁচিয়ে ধরে নৌকার ওপর বাছাধনকে নিয়ে ফেলে সে। লাল রঙের বিশাল বড় একটা জাপানি। না আর পারা যাচ্ছে না, হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। শরীরটাকে নৌকায় টেনে তুলতেই চিৎকার করে ওঠে ফরিজ। নওশাদের পেটে লেপ্টে থাকা ধুসর রঙের চিকচিক করতে থাকা ওটা কী! এতো বড় জোঁক জীবনেও দেখেনি সে, রক্ত শুষে ফুলে উঠেছে অনেকটা। ফরিজের চিৎকারে চোখটা পেটের দিকে যেতেই দু’চোখে যেন অন্ধকার নামে নওশাদের। কাঠের পাটাতনের ওপর শরীরটা ছেড়ে দেয় সে।
পুরোটা নাভি জুড়ে দাঁত বসিয়ে লেপ্টে আছে রক্তচোষাটা। যেদিকেই দু’চোখ যাচ্ছে সেদিকেই শুধু জল আর জল। সাহায্যের জন্য যে ডেকে আনবে তেমন একটা মানুষেরও দেখা নেই। দু'হাত দিয়ে জোঁকটাকে ছাড়াতে চাইলে তার প্রচন্ড পিচ্ছিল দেহ থেকে হাত ফস্কে যায় ফরিজের। যেকোনো মতে একে ছাড়াতেই হবে, এখান থেকে নাও বেয়ে পাড়ে পৌঁছতে মিনিট দশেক তো লেগেই যাবে। কোমর থেকে গামছা খুলে আঙুলে পেঁচিয়ে এইবার জোঁকটাকে শক্ত করে ধরে ফরিজ। আলতো করে টান দিলে কোনো হেলদোল নেই অমেরুদণ্ডী প্রাণীটির। উপায়ান্তর না দেখে এইবার সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরার কয়েক সেকেন্ড পরে জোঁকসহ নৌকার একপাশে আছড়ে পড়ে সে। উঠে দুলাভাইকে দেখতে গিয়ে চোখ-মাথা ঘুরে যায় ফরিজের। নাভির ডানপাশ ফুটো হয়ে জোঁকের সাথেই উঠে গেছে। গলগল করে বয়ে যাওয়া রক্ত কালো নৌকার মেঝেটাকে লাল টকটকে করে দিয়েছে। একটু ধাতস্ত হতেই গলা ছেড়ে চিৎকার দেয় ফরিজ। হাত দিয়ে চেপে ধরলেও রক্তক্ষরণ মোটেই কমছে না। গামছা-লুঙ্গি লালে লাল হয়ে গিয়েছে। নওশাদ এখন একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, অনেকক্ষণ জলে ভেজা ফ্যাকাশে হাত-পা কনকনে ঠান্ডা হয়ে গেছে। সব কিছু ছেড়ে এইবার পাগলের মতো চিৎকার করে ফরিজ। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে, ঝমঝম আওয়াজে তার প্রাণপণ চিৎকার পঞ্চাশ-ষাট মিটারের বেশি আর এগোতে পারে না। ধারাবর্ষণের দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহে সর্বহারা সৈনিকের মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে অসহায় ফরিজ। অনবরত বৈঠা মারলেও নাওখানা যেন আর এগোচ্ছে না। খলুইয়ের ভিতরে মাছেদের লাফালাফিতে পেছন ফিরে দেখে সে। ব্যাগ থেকে কয়েকটা মাঝারি সাইজের মাছ বেরিয়ে পড়েছে। নৌকার মাঝে কিছুটা জল জমেছিল, তার সাথে গাঢ় লাল রং মিশে গিয়ে বড় দুঃসহ, ভয়ংকর দেখাচ্ছে। আকাশঝরা জল আর নিষ্প্রভ নওশাদের নাভিধারা দু’টোই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। নৌকার মাঝের তরল বেড়েই চলছে ক্রমশ। পাটাতনের মাঝে মাছেদের রক্তস্নান ভেজা চোখে দেখে ফরিজ। আবছা চোখে কোনো কূল-কিনারা দেখা যাচ্ছে না আর।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন