শারদ সুজন
বাঙালির প্রাণের ঋতু শরৎ এখনও পেঁজা মেঘের ভেলা চড়ে দেখা দেয়নি হৃদয় আকাশে, কাশবনে হয়তো সফেদ কুঁড়ি সদ্য ফোটা শুরু হয়েছে। অতিমারীর করাল ছায়ায় উদভ্রান্ত পথিকের মতো হাতড়ে বেড়াচ্ছি আগমনীর শিশিরভেজা সুর। দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কবে শেষ হবে আমরা কেউ জানি না। অহরহ দুঃসংবাদের সাথে 'নিউ নরম্যাল' যুগে বেঁচে থাকার রসদ হিসাবে অফুরান জীবনীশক্তিই হয়তো আমাদের একমাত্র সম্বল। সামাজিক দূরত্বের সাথে মানসিক দূরত্ব যাতে হেরে না যায়, সেই ব্যাকুলতায় বিগত কয়েক মাস ধরে সঙ্গবদ্ধ হয়ে থাকার ফন্দি-ফিকির কম আঁটিনি আমরা। সোস্যাল মিডিয়ায় নানা বিষয়ে লাইভ কার্যক্রম থেকে শুরু করে গল্প-কবিতা-গানের সন্ধ্যায় কিছুটা হলেও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে অবাধ্য মস্তিষ্ককে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা সামাজিক বিভিন্ন রকমের কাজের সাথে যুক্ত প্রচারবিমুখ, নিরলস স্বজনদের সম্মাননায় "#শারদ_সুজন" নামের অভিনব কার্যক্রমটি কবি-গল্পকার-সংঘটক শ্রদ্ধেয় #বিদ্যুৎ_চক্রবর্তী মহাশয়ের সৃজনী চিন্তাধারার সফল প্রয়াস। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন গুণীজনের মরমী কলমের ছোঁয়ায় এইরকম অনেক নীরব প্রেমীর সাথে পরিচিত হয়েছি, যাঁদের অবিচল যাপন ছন্দে সব দুঃখ-জরা কাটিয়ে পৃথিবী বারবার বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। অনন্য কার্যকলাপে আমাদের সমাজে-মননে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সেই মানুষদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আমাকে আসতে হলো অনুজপ্রতিম কবি নিরুপম পালের ডাকে। অতিমানবিক ব্যক্তিত্বদের শ্রদ্ধা অর্পণে প্রিয়জনরা যখন অঞ্জলি ভরছেন, তখন ছোটভাই নিরুর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না।(Nirupam)
প্রায় এক দশক ধরে বাড়ির বাইরে থাকা আমি বড় কষ্টে আমার মাটি-মানুষদের স্মৃতিটুকু বুকে আগলে রেখেছি। হাজার চেষ্টাতেও নিষ্ঠুর প্রবহমান সময়ের ধারায় ধীরে ধীরে আবছা হয়ে উঠছে স্মৃতিপট। বন্ধুর পথে অনেক বন্ধু-সুজনের সাথে দেখা হয়েছে, যাঁদের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু গতকাল আমাকে মনোনীত করার পর যাঁর কথা খুব বেশি করে মনে পড়ছিল, আজ তাঁরই গান গেয়ে যাব।
শারদ সুজনে আমি তার কথাই বলবো যিনি আমার অন্তর্লীন সত্তায় নিবিড়ভাবে মিশে আছেন। জীবনে যতদূরেই যাই না কেন, তাঁর আদর্শের শেকড়ে নিজেকে বাঁধা ভাবলে মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। আমি বলছি আমার ঠাকুরমা স্বর্গীয় নিভা রাণী সেনের কথা; যাঁর পরোপকারী হৃদয়, দুর্জয় সাহস আর আত্মত্যাগই আমার অস্তিত্বের উৎস।
অবিভক্ত দেশের সিলেট জেলার (বর্তমান করিমগঞ্জ, শ্রীগৌরী) বনেদি পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী যতীন্দ্রমোহন দেব পুরকায়স্থের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন আমার ঠাকুরমা নিভা রাণী। পারিবারিক আভিজাত্যের অহংবশত মেয়ে বিয়ের জন্য বহু বছর ধরে নিজের বংশের সমতুল্য পাত্র খুঁজতে যতীবাবু যখন প্রায় বিফল মনোরথ হয়ে গেছেন, তখন ঠাকুরমার বয়স ত্রিশের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। এদিকে আমার দাদু ত্রৈলোক্যমোহন সেনের প্রথম স্ত্রী মানসিক বিকারগ্রস্ততায় মারা যান। দুই মেয়েকে পাত্রস্থ করে একপ্রকার ভবঘুরের জীবন ত্রৈলোক্যমোহনের। বড় মেয়ের জামাতা এবং দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের উদ্যোগে পরিবার জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত উদাসীন আমার দাদুকে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়। একে একে সব পিতৃসম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া ছাড়াও আপনজনের বংশরক্ষার অবসেশনকে এই বিয়ের একটি মুখ্য কারণ বললে অতিশয়োক্তি হবে না।
ঠাকুরমার সাথে যখন দাদুর বিয়ে হয়, তখন পিতৃসম্পত্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ হাতে আছে ত্রৈলোক্যমোহনের। বাবার একমাত্র সন্তান ত্রৈলোক্যমোহনের চোখের ব্যামো ধরা পড়ার পর থেকে তাঁর পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য অনেক সহায়-সম্পত্তি রাখা ছাড়া ছেলেকে তেমন কিছু কাজ শেখাননি গঙ্গাধর সেন। তাই শুধু বিক্রি করা আর খাওয়াতে হয়তো তেমন অস্বাভাবিক কিছু মনে হতো না তাঁর! গান-কীর্তন প্রিয় মানুষটি শুধু কীর্তন করে করে অবলীলায় কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন। বৌ-বাচ্চার দিকে একটি বারের জন্য ফিরেও তাকাননি।
এমন একখানা বনেদি পরিবারের মেয়ে নিভা রাণীর চোখে বিয়ের কিছুদিন পরেই অভাব-অনটনের কঙ্কালসার চেহারা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলো। অর্থ সাহায্যে বাপের বাড়ির সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনোদিন হাত পাতেননি আমার ঠাকুরমা। পেটের দায়ে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজও করেছেন। তখনকার যুগে শিক্ষিত (ষষ্ঠ শ্রেণি পাস) হওয়ার বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই-তিন কিলোমিটার দূরে শিমুলতলা সমাজ কল্যাণ কেন্দ্রে মাত্র কুড়ি টাকা বেতনে 'শিশুসেবিকা'র কাজ পেয়েছিলেন। প্রতি রবিবারে গ্রামের গরিব বাচ্চাদের খেলাধুলা-গান শেখানোর সাথে স্ন্যাকস হিসাবে সরকার প্রদত্ত দুধ-ফল-বিস্কুট খাওয়াতে হতো। এই সুযোগে বাবাদের ভাগ্যেও একটু-আধটু ভালো-মন্দ খাবার জুটতো, যা কখনও কিনে খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না।
মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার বাবা লিখেছেন "পাঁচ-ছয় বছর থেকেই জন্মদাত্রী, জননীর দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতাম। জানতাম মা এক সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারের কন্যা। পড়াশোনা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। বয়স বেশি হয়ে যাওয়ায় আমাদের মাতামহ স্বর্গীয় যতীন্দ্রমোহন দেব পুরকায়স্থ, আমাদের বিপত্নীক পিতৃদেবের সাথে তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন। স্বর্গীয় পিতা-মাতার ননীর পুতুল আমাদের বাবা ইতিপূর্বেই পিতৃদেবের সব সম্পত্তি প্রায় খুইয়ে বসেছিলেন। অবশ্য বাবা প্রথম পক্ষের দুই দিদিকে আগেই পাত্রস্থ করে দিয়েছিলেন। একে একে চার ভাইয়ের জন্মের পর দেখা গেলো বাবা সম্পূর্ণ সম্পদশূন্য। স্ত্রী-পুত্র প্রতিপালনে তাঁর তীব্র অনীহা। গান-বাজনা এবং ভবঘুরে জীবনকে নিয়েই তিনি সদাব্যস্ত। এবার শিশুপুত্রদের বাঁচাতে মা সংসারের হাল ধরলেন। সকল-বিকেল পাড়া প্রতিবেশীর ছোটছোট শিশু-কিশোরদের বাড়ির বারান্দায় বস্তা কিংবা ছেঁড়া কাপড় পেতে তিনি পড়াতেন। এতে দুই-চার আনা উপার্জন হতো। পড়াবার বিনিময়ে কেউ চাল-ডিম বা সবজি দিত। তাছাড়া মা প্রতিবেশী বাড়িতে পরিচারিকার কাজও করতেন। পাশের বাড়ি কৃষক পরিবারে ঢেঁকিতে ধান কুটতেন। ফলে যৎসামান্য রোজগার হতো। মাঝে মধ্যে চালের খুদ এনে ধুয়ে সেদ্ধ করে আমাদের খেতে দিতেন। মাকে ধান কুটতে আমি ও মেজ ভাই হাবুল মধ্যে মধ্যে সাহায্য করতাম। তখন আমার বয়স দশ-বারো বছর। দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্রের জ্বালায় নিষ্পেষিত আমাদের মা তার দুর্দশার কথা পিত্রালয়ে কখনও জানাতেন না। অনেক সময় মায়ের পরিধানের কাপড়ের অভাবে এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে পুরাতন কাপড় চেয়ে নিয়ে আসতেন। চরম দৈন্যের দু-একটা উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। একদিন আমাদের প্রতিবেশী জিতেন কাকার বড় ছেলে রাজু কাঁচা পায়খানার মধ্যে তর্জনী থেকে সোনার আংটি ফেলে দিয়েছে। কাকিমণির অনুরোধে অথচ কিছু অর্থ পাবার জন্য মা হাত দিয়ে পায়খানা ঘেঁটে আংটিটা বের করে দিয়েছিলেন। বিনিময়ে নগদ আট-আনা পেয়েছিলেন..." ঘটনাটুকু বলে আজও আমার বাবা ভেঙে পড়েন কান্নায়।
পরবর্তীকালে গ্রামেরই এক সম্ভ্রান্ত মহিয়সী মহিলা বীণা দেবরায় এবং কংগ্রেস নেতা হরেন্দ্র সেনের সহায়তায় বিক্রমপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে নার্সের সহায়ক হিসাবে চাকরি পান তিনি। এই চাকরি পেতে তৎকালীন ইনচার্জ ডক্টর সুনীল সেনগুপ্তের ভূমিকাও ছিল। বীণা দেবরায়ের প্রচেষ্টাতেই কিছুকাল পরে এই পদটি স্থায়ী হয়। বৃহত্তর বিক্রমপুর পরগণায় খুব কম সময়ের মধ্যে ভরসার মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আশেপাশে কেউ অসুস্থ জানলে সারাটা রাত তাঁর দু’চোখে ঘুম আসতো না। এমনও হয়েছে কোনো রোগীর শুশ্রূষায় সারা রাত তার শিয়রে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন। আর্তজনের সেবায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নিজে থেকেই ছুটে যেতেন তিনি। পারিশ্রমিকের চিন্তা কোনোদিনই করেননি।
দুঃখের দিনগুলোতে রাতের বেলা দাদু কীর্তন থেকে না ফিরলে ভাতের মাড়, খুদ খাইয়ে বেশি করে জল খাইয়ে দিতেন ছেলেদের। আবার খিদে পাওয়ার আগে যাতে চোখে ঘুম চলে আসে, তাই ধান শুকোতে ব্যবহার করা বাঁশের চাটাইয়ের উপর ছেঁড়া কাঁথা পেতে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী শুনিয়ে ছেলেদের ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন। উত্তরাধিকার সূত্রে নিজের পিতার মতোই রাগ নিয়ে জন্মেছিলেন আমার বাবা। তরুণ বয়সে সামান্য দোষে মানুষকে যা-তা শোনানোর আগে দু'বার ভাবতেন না। রাগী ছেলেটিকে ঠাকুরমা "উপরওয়ালার কইছইন, আমারে তোড়িছ কিন্তু আমার বান্দা তোড়িছ না/যে সয় সে রয়/কথার আছে যতেক বাণী, যদি কথা কইতে জানি" সব বলে মাথা ঠান্ডা করার অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। অর্থাভাবে ছেলেদের পড়াশোনা যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, তাই প্রতি বৎসর পরীক্ষার পরেই পুরানো বইয়ের সন্ধানে লেগে যেতেন তিনি।
হাতের লেখা খুব সুন্দর থাকায় পাড়া প্রতিবেশীদের পোস্টকার্ড-এনভেলাপ ইত্যাদিতে তিনি চিঠি লিখে দিতেন। গ্রামে-গঞ্জে তখন অশিক্ষিত লোকজনদের সংখ্যাই বেশি ছিল। তাই কোথা থেকে কারো চিঠি আসলে, তা পড়ে সারমর্ম বোঝাবার জন্য লোকজন আমাদের বাড়িতে দৌঁড়ে চলে আসত। ঠাকুরমার বই পড়ার খুব নেশা ছিল। রবি ঠাকুর-বঙ্কিম-শরৎ ছাড়াও উলটোরথ, নবকল্লোলের মতো ম্যাগাজিন কোথাও পেলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পেতেন না।
সুখ তাঁকে ইহজীবনে ধরা দেয়নি। ছেলেরা স্বনির্ভর হয়ে যাওয়ার পরে ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক সকালে বেশ কয়েক মাস দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে ভুগে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন তিনি। আমি তখন সাত-আট বছরের কিশোর, কিছুই বুঝতে পারিনি। সেই দিনটির কথা ভাবতে গেলে শুধু মানুষের ভিড় ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে না। এতো লোকের ভিড় আমাদের বাড়িতে আমি আজ অবধি দেখিনি। তিনি সশরীরে না থেকেও মিশে আছেন আমাদের সত্তায়। শিখিয়ে গেছেন মানুষের জন্য বেঁচে থাকা দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট আনন্দের সোপান। আজকের এই পুণ্য দিনে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম, ভালোবাসা জানাই। ভালো থেকো ঠাকুরমা।
Comments
Post a Comment