বহুরূপী
টিকটিকিটা বেশ অস্বাভাবিক রকমের। কালো ডোরাকাটা রঙ, আকারেও বড়, কিছুটা তক্ষকের মতো দেখতে। মন্ত্রীবাবুর আগাগোড়া মার্বেল পাথরের ঘরটিতে কোথা থেকে যে আজব সরীসৃপটা এলো, কে জানে! কাজের লোক ভোলা ঝাঁটা দিয়ে মেরে তাড়াতে গেলে বাঁধা দেন খোদ মন্ত্রীবাবু। যাযাবর প্রাণীরা বাসা বাঁধলে তাকে মেরে তাড়িয়ে দিতে হয় না। ছোটবেলায় মা বলতো, তাই আপাতদৃষ্টিতে অন্ধবিশ্বাস মনে হলেও মায়ের কথাটা মনে পড়ায় টিকটিকিটার প্রতি দরদ উথলে ওঠে মন্ত্রীবাবুর।
মহানগরের বিশাল ওভার ব্রিজটি বানানোর মাস দুয়েকের মাথায় ভেঙে পড়লো, চাঙড়ের নিচে থেঁতলে গেলো কতগুলো নিরীহ মানুষ। দোষীদের চিহ্নিত করতে মন্ত্রীর সাহায্যপ্রার্থী হয়ে বাড়িতে এসেছিলেন সিবিআইয়ের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। কমিশনের ব্যাপারটা চেপে গিয়ে অগ্নিশর্মা হয়ে যখন সব দোষ ঠিকাদার আর ইঞ্জিনিয়ারদের ঘাড়ে মন্ত্রীবাবু চাপিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন বিশাল ঘড়িখানার পাশে লেপ্টে থেকে 'ঠিক ঠিক' শব্দে তার কথায় সায় দিচ্ছিল শীতলশোণিত প্রাণীটা। কথার ফাঁকে কাঠের চেয়ারে তিনবার ঠক ঠক আওয়াজ করেন মন্ত্রীমশাই।
কয়েক পেগ গলায় ঢালার পর সেদিন টালমাটাল অবস্থা। সারা রাত ধরে পার্টি হয়েছে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে কাছের ক'জন আর পার্টি ওয়ার্কারদের নিয়ে বসার পর ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন দু'বারের বিধায়ক আমাদের হবু মন্ত্রীবাবু।
-- টাকা কথা কয়রে শালারা! এইবার যা হরির লুট দিয়েছি, অপনা টাইম তো আনা হি থা। চিয়ার্স!!
ভাংড়ার তালে তালে দু-হাত শূন্যে উঁচিয়ে সবাই নাচছিল। টিউবলাইটের পাশে আসা আত্মঘাতী পোকা-মাকড়গুলোকে উদরস্থ করে টিকটিকিটা নাদুস-নুদুস হয়ে গেছে। চোখ দুটো তার জ্বলজ্বল করছিল। মন্ত্রীর এই গর্বের মুহূর্তটাকে 'ঠিক ঠিক' শব্দে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছিল সে।
লক ডাউনের সাময়িক ঘোর ভাঙার পর মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে কিছু স্বতন্ত্র সংবাদ মাধ্যমও সরব হয়েছে। কুকুর-বেড়ালের মতো পথেঘাটে পড়ে মারা যাচ্ছে ভিনরাজ্যের গরিব-মেহনতি মানুষগুলো। সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড, পিপিই কিটসহ নানা জরুরী সরঞ্জামের অভাব। মন্ত্রীবাবুর বাড়ির বিদেশী ব্র্যান্ডের পঞ্চান্ন ইঞ্চি ফুল এইচডি টিভিতে সরকারের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে একটা প্রাইভেট নিউজ চ্যানেল। নানা ফটো, ভিডিও-এর সাথে তুলে ধরছে রাজনীতির পদতলে পৃষ্ট হওয়া ব্যবস্থার ঘুণে ধরা রূপ। এরা কি এই মাসের কিস্তি পায়নি! টিকটিকির 'ঠিক ঠিক' করে উঠলে মেজাজ আরও খারাপ হয় তার। চেয়ারের ওপর চড়ে কঞ্চি দিয়ে ওটাকে মারতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যান আমাদের এই জন প্রতিনিধি। তরতরিয়ে সরে গিয়ে সিলিংয়ের কোণে লুকিয়ে পড়ে প্রাণীটা। যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে ওঠেন মন্ত্রীবাবু, ডান পা'টা বোধহয় ভেঙেই গেলো!
মিথ্যে কথায় 'ঠিক-ঠিক' করলে টিকটিকির লেজ খসে পড়ে যায়। দুলকি চালে দেওয়াল চষে বেড়ানো বদমাশটাকে দেখে অনেক বছর আগে মায়ের বলা কথা মনে পড়ে মন্ত্রীবাবুর। অকথা-কুকথায় 'ঠিক ঠিক' করেও দিব্যি লেজ নাচিয়ে ঘোরাফেরা করছে। পা'টা ব্যান্ডেজ করে শূন্যের ওপর ঝুলিয়ে রেখে গেছে নার্স। ব্যথার সাথে দু'দিন থেকে নতুন উপসর্গ হিসাবে দেখা দিয়েছে ঘুসঘুসে জ্বর। একভাবে শুয়ে শুয়ে গা'টা ব্যথা হয়ে গেলো। টেস্ট করার জন্য হাসপাতাল থেকে এসে সিরিঞ্জ ভরে রক্ত নিয়ে গেছে। পুরো পরিবার হোম কোয়ারান্টাইনে আছে বেশ ক'দিন হলো। সপ্তাহ খানেক হয়ে গেছে কারও সাথে দেখা-সাক্ষাৎ নেই।
আচ্ছা, রিপোর্টে যদি করোনা পজিটিভ আসে! হাই ডায়াবেটিসের সাথে তার কিডনির অবস্থাও তো ভালো নয়। হাজার টাকা-পয়সা থাকলেও চিকিৎসার জন্য এই পরিস্থিতিতে বিদেশে যাওয়া যাবে না। এতো কিছু ভেবে ভেবে প্রেসারটা বুঝি বেড়ে গেলো। টিকটিকিটা কি তাকে দেখে হাসছে! পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে! দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে সরীসৃপটা; ডোরাকাটা রঙ ফেটে ফেটে থকথকে জমা রক্ত চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদটির। হাঁ মুখে লম্বা জিভ বের করে এইবার যে তারই দিকে এগিয়ে আসছে বিশাল টিকটিকিটা। নিকষ কালো মুখের আঁধারে যেন উঁকি দিচ্ছে বহু জন্মের খিদে। জীবটা তাহলে কি কোনো বহুরূপী! চিৎকার করতে গেলে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না, বিশাল প্রাণীটি কি তাহলে তাকে খেয়ে ফেলবে! জ্ঞান হারানোর আগে পুনরায় 'ঠিক-ঠিক' শব্দ শুনতে পেলেন মন্ত্রীবাবু।
Comments
Post a Comment