বেলুনওয়ালা

তখন ঘড়িতে মাত্র সাড়ে আটটা, অথচ লক ডাউনের দৌলতে মাঝ রাত মনে হচ্ছে। হেডলাইট স্তিমিত হলে অফিসের গাড়ি থেকে নামলেন নীলেশ। একটা মিটিং থাকায় বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল শহরের জনপ্রিয় সংবাদপত্রের সাব-এডিটর নীলেশ মোহনের। বর্ষীয়ান মানুষটার সাংবাদিকতার প্রতি ভালোবাসা সর্বজনবিদিত। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের পেশায় কাজের সাথে সাথে নিজেকে মানুষের সেবায় বিলিয়ে দিয়েছেন।
সন্ধ্যেবেলার ঝোড়ো হাওয়া তান্ডব করে গেছে। গাছের ডালপালা নেতিয়ে আছে। কারেন্ট নেই, পথের মাঝে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে স্ট্রিটলাইটগুলো। আবছা আলোয় কয়েক-পা এগোতেই আঠার মতন কিছু একটা জুতোর নিচে পড়লে ভ্রূক্ষেপ করলেন না নীলেশ। ডিভাইডারের গা ঘেঁষে বস্তার মতো কিছু একটা পড়ে আছে। পকেট থেকে মোবাইল বের করতে নিলে বাস-স্ট্যান্ডের পাশ থেকে আসা আওয়াজে ঘাড় ঘোরান তিনি।
-- বাবুজি! দফতর সে লওট রহে হ্যাঁয় ক্যাঁ?
রাতের বেলা ভূকাচাঁদের গলার আওয়াজে বিস্মিত হন নীলেশ। ব্যাটা এই অন্ধকারে কি করছে! এমনিতেই বিকলাঙ্গ মানুষ, পুলিশের চোখে পড়লে অকারণে মার খাবে।
-- অরে ভূকে, ইস অন্ধেরে মে তুম ক্যাঁ কর রহে হো!
-- বলুন লেকে আয়া থা বাবুজি। অগর থোড়া বহুত ভি বিক যায়ে তো কুছ প্যায়সে আয়েঙ্গে।
একে তো হাঁটুর নিচে পা-দুটো নেই, তার ওপর এই লক ডাউনে মানুষজনের চলাচল অনেকটাই কমে গেছে। এই দুঃসময়ে ক'জনই বা বেলুন কিনবে! ভূকাচাঁদের জন্য মায়া হয় নীলেশের। এই রোগ কত মানুষকে যে পেটে মারছে, তার হিসাব কি কেউ রাখে!
--তুম ঘর যাও ভূকে...
একশো টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে অনুরোধের সুরে বলেন নীলেশ। রোদে পোড়া মলিন মুখখানায় অস্বাভাবিক জ্বলজ্বলে দু'টো চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
-- ইয়ে বলুন সাথে লে যাইয়ে বাবুজি।
সুতো বাঁধা বেলুন দু'টো দিতে হাত বাড়ায় ভূকাচাঁদ। করোনার সময়ে এসব জিনিস বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। তাছাড়া নাতনীটাও এতক্ষণে নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে।
-- অরে ইয়ে সব নেহি চাহিয়ে ভাই। তুম ঘর যাও জলদি।
-- বাবুজি, আপ অগর বলুন নেহি লোগে তো ম্যাঁয় প্যাসে নেহি রখ পাউঙ্গা সাহাব।
ভূকাচাঁদের অনুনয়ে মন গলে গেলো নীলেশের। গরিব মানুষটার আত্মসম্মানবোধ তার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অগত্যা লাল-হলুদ বেলুন দুটো নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ান তিনি। কয়েক'পা এগোতেই মনে হলো ভূকা যেন উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু তা কী করে সম্ভব! পেছন ফিরে দেখলে জমাট অন্ধকার ছাড়া চোখে কিছু ধরা পড়লো না। অন্ধকারটা কি হঠাৎ করে একটু গাঢ় হয়ে গেছে! একটু আগেই সমদূরত্ব থেকে ভূকাচাঁদকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছিলেন। ব্যাপারটাকে মনের ভুল ভেবে আমল দেন না নীলেশ।
ডোবার ওপারের বস্তিটাতে ভূকাচাঁদের মতো মানুষদের বাস। প্রায় পনেরো-বিশটা পরিবার হবে। সংগঠনের সাহায্য ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে তিনি আকছার এদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গলি ধরে তিনটা বাড়ি পেরিয়ে বাঁদিকের দু'তলা বাড়িটা নীলেশের। গেট খুলে এগিয়ে গেলে পায়ের নিচে চ্যাটচেটে ভেজাভাব ঠিক টের পাওয়া যাচ্ছে । জুতোর কালচে লাল ছোপ সেঁটে আছে কংক্রিটের মেঝেতে। পাপোশে ভালো-মতন পা মুছে নিয়ে কলিং বেল বাজান তিনি। দরজা খুলে রঙিন বেলুনহাতে নীলেশকে দেখে আপাদমস্তক জরিপ করতে গিয়ে নিচে চোখ আটকে যায় শিবানীর। ঘরের ভেতর থেকে টিউবলাইটের আলো এসে পড়ায় লাল রঙটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্ত্রীর হাবভাব দেখে অপ্রস্তুত নীলেশ ঘরে ঢুকতে গেলে সশব্দে একটা বেলুন ফেটে যায়। সাথে সাথে হাওয়ায় উড়তে থাকে এক টুকরো কাগজ। DL12T.... তাজা রক্তে লেখা গাড়ির নম্বর দেখে শিউরে ওঠেন তিনি। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। গাড়ি থেকে নামার পরের মিনিট পাঁচেকের ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওই বস্তার মতো দলাপাকানো জিনিসটাকে ভালোমতন দেখার আগেই ভূকাচাঁদটা হাঁক পাড়লো। রাতের অন্ধকারে বেলুন বিক্রির ব্যাপারটা এখন মোটেই হজম হচ্ছে না। আচ্ছা, আসার সময় তো একবার এটাও মনে হয়েছিল যে বিকলাঙ্গ মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছে। অথচ সে তো কোনওমতে শরীর ঘষটে চলে, হাঁটুর নিচে...
শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে গেলো নীলেশের। বাদামি জুতোর চারপাশে আলতার মতো লাল লেগে আছে। কাগজের টুকরোটা সযত্নে ভাঁজ করে বুকপকেটে রাখেন তিনি। ভূকা কি তাহলে কিছু বলতে চাইছিল! প্রবল দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনের ভেতরে তুফান তোলে। অদম্য কৌতূহলে ধীরে ধীরে কেটে যায় ভয়মিশ্রিত সব জড়তা। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে ছুটতে থাকেন নীলেশ।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন