বিসর্জন
-- চা ঠাণ্ডা অইগেলো ঠাকুরজ্যেঠা, তাড়াতাড়ি আও।
শশব্যস্ত জয়া এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তলব করল নিতাইকে। ঘুম থেকে ওঠার পর সব খুঁটিনাটি কাজ সারার ফাঁকে বাপ আর ঠাকুরজ্যেঠাকে চা করে দেওয়াটা তার অনেকদিনের অভ্যাস। হাঁস দুটোকে খাঁচাছাড়া করার পর ঘর ঝাড়ু দেওয়া, এঁটো বাসনপত্র পরিষ্কার করা, উঠোন ঝাঁট, স্নান, ফুল তোলা, ঠাকুর দেওয়ার পর নিজে একটু লাল চা দিয়ে গলা ভেজায়। মহালয়ার সকালে তর্পণ সেরে বাড়ি ফেরার পরেই তক্তপোশের নিচে থেকে জং ধরা ট্রাঙ্কটি খুলে এক এক করে সব নথিপত্র দেখছিল নিতাই.. একটাই আশা, সৌভাগ্যক্রমে যদি স্বদেশী হওয়ার কোনো প্রমাণপত্র পাওয়া যায়! অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পরেও কোনো কিছু না পেয়ে নিরাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। মা মারা যাওয়ার বছরখানেক আগে যে বন্যা এসেছিলো, তাতেই বোধহয় সব ভেসে গেছে! ট্রাঙ্কটিকে খোলা রেখেই দুই হাঁটুতে ভর করে সোজা হয়। গত কয়েকদিনের একটানা পরিশ্রমে কোমর ধরে গেছে। চা খেয়ে এই মরশুমে শেষবারের মতো আবার কাজে বসতে হবে। প্রতি বৎসরই তর্পণ সেরে এসে মায়ের চোখে শেষ তুলির টান দেয় নিতাই। তারপর নিজের হাতে গড়া মৃন্ময়ী মায়ের চরণে শ্রদ্ধা-ভক্তি নিবেদন করে। মায়ের উজ্জ্বল, স্নেহময়ী মুখখানা দেখে এতোটা দিনের কষ্ট-পরিশ্রম সার্থক বলে মনে হয় নিতাইয়ের কাছে।
--তোর বাপ কই রে মাই, দেখলাম না তো?
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জয়াকে জিজ্ঞেস করে নিতাই। যদিও জয়ার বাবা সাধন কখন কোথায় যাতায়াত করে, তা নিয়ে ভালোই অবগত আছে সে। নির্ঘাত নদীর পাড়ে গাঁজা ফুঁকতে বেরিয়ে গেছে সকালবেলা। বয়সে নিতাইয়ের থেকে অনেক ছোট, পেশায় কাঠমিস্ত্রি সাধনের এই গাঁজা আর চোলাইয়ের নেশাটা আজকাল একটু বেড়েই গেছে। তার ছাপও পড়ছে চোখে মুখে। ঢ্যাঙা শরীরটা দিনে দিনে যেন হারকঙ্কালে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। মা মরা মেয়েটার যে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, সেই দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার। সাধনকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেও তাতে কোনও লাভ হয়নি। সুযোগ পেলেই নদীর পাড়ে চম্পট দেয় সাধন।
চায়ের কাপ রেখে রঙের কাজে হাত দেয় নিতাই। লাল-হলুদ-কালো রঙের মধ্যে পরিমাণমতো জল মিশিয়ে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে সে। মাটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে না গেলে তাতে আবার রঙ লাগানো যায় না। ভাগ্যিস গত পনেরো-কুড়ি দিন থেকে নীলাকাশে ঝলমলে রোদ্দুর ছিল, শরতের আকাশে কোথাও সাদা মেঘের কোনো ভেলাকে সাঁতার কাটতে দেখা যায়নি। যদিও আজকে মহালয়ার ভোর আসতেই যেন সবকিছু বদলে গেছে। আকাশে মেঘ গর্জনে রেডিওতে মহালয়ার চণ্ডীপাঠ ভালোমতো শুনতে পায়নি নিতাই।
আলো ফুটতেই সব সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে তর্পণ করার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল নদীর উদ্দেশ্যে। ধুতির কোণা দিয়ে চশমার গ্লাসটা সাফ করে সে। বাকি কাজগুলো করতে চশমার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু মুখমণ্ডলের কাজ সারতে গত বছর থেকে চশমা ব্যবহার করছে সে। দুর্গাপুজোর কাজ আগের মতো ততটা আসে না। এখন শুধু পাড়ার ক্লাবের প্রতিমা আর বাজার কালীবাড়ির প্রতিমা বানানোর কাজই হাতে আসে। বাইরের শিল্পীরা বর্তমানের বাজার ধরে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা থেকে কারিগররা মাস কয়েক আগেই এসে ঘাঁটি গড়েন। তাছাড়াও নিতাইয়ের এখন বয়স হয়েছে, বেশি কাজ সে করতেও পারবে না, তাই নেয়নি। বড় কাজের চেয়ে আজকাল ছোট কাজই বেশি আসে নিতাইয়ের কাছে। লক্ষ্মী-বিশ্বকর্মা-সরস্বতী-বিষহরী মূর্তির কাজ প্রায় সারা বছরই চলতে থাকে। এই বছর ক্লাবের কাজটা নেওয়ারও খুব একটা ইচ্ছে ছিলো না তার। বর্তমান কমিটি লেনদেনে মোটেই ভালো নয়। টাকা দেবে কম, সেটাও আবার বেশ কয়েক দফায়। নিজে থেকে না বললে পুরোটাও পাবে না। প্যান্ডেল-আলো-রোশনাইয়ের কাজে পয়সা আছে, ওদের কাছে শুধু নিতাইয়ের বেলায়ই যত হুজ্জুতি। রঙ-তুলি-কাপড়ের দাম এখন অনেকটাই বেড়ে গেছে, ওই টাকাতে পোষায় না। ইচ্ছে তো ছিলো এইবার অর্ডার দিতে আসলে সাফ মানা করে দেবে। তবে যেভাবে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটোর আশ্রয় নেয়, সেইভাবে দিশেহারা নিতাইও বিশ্বাস করেছিলো ক্লাবের ছেলেদের কথায়। এনআরসি-তে নাম না আসা নিতাইকে কিচ্ছু হতে দেবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিল ক্লাবের সেক্রেটারি। আশার আলো দেখতে পেয়েই কাজটা হাতে নিয়েছে নিতাই।
সত্তরের পরে ঠিক কোন সময়টাতে এসেছিল, তা মনে করতে পারে না নিতাই। মা-বাবার হাত ধরে যখন এদেশে আসে, তখন সে ষোলো-সতেরো বছরের তরুণ। হাতের গুণে মাটির ঢেলাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার কাজটা বাবা নবকিশোর পালের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। ওর বাবা একবার বলেছিল যে ক্যাম্পে ওঠার পরে কিছু একটা কাগজপত্র পেয়েছিল ওরা, কিন্তু সেটা যে কোথায় রেখেছে তা বাবা বলেনি আর নিতাইও জিজ্ঞেস করেনি। কারণ বছর দশেক আগেও ঐসব জিনিস তো আর এতোটা প্রাসঙ্গিক ছিল না! রোজ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় রেডিওতে খবর শোনার অভ্যেসটা নিতাইয়ের চিরকালের। কিন্তু আজকাল কান পেতে খবর শোনার পরে আর রাতে ঘুম আসে না তার.. আজকেই নাকি কোন নেতা বলেছেন যে এনআরসি ছুটদের দেশছাড়া করা উচিত। এই দুনিয়াতে যদিও চিরকুমার নিতাইয়ের আপন বলতে কেউ নেই, কিন্তু কালকে যদি ওকে দেশছাড়া হতে হয়; তাহলে এই বুড়ো বয়সে যাবে কোথায়...তার আগে মরে গেলেই ভালো। "মাগো.. তুমি যাইতে সময় ইবার আমারেও লগে লইয়া যাইও", মা দুর্গার কাছে করজোড়ে মিনতি জানায় নিতাই।
দু'দিন আগে শহরের কোনো নিউজ চ্যানেল থেকে জনাকয়েক যুবক-যুবতীরা এসেছিল নিতাইয়ের বাড়িতে। নিতাইয়ের সাথে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করার সাথে সাথে অনেকগুলো সেলফি তুলেছে ওরা.. সাথে নিতাইকে এটাও বলেছিল যে তাকে নাকি দু'দিন পরে টিভিতে দেখাবে। কিন্তু নিতাইয়ের কাছে তো টিভি নেই, দেখবে কেমন করে! সহজ কথাটা হাসিমুখে ওদের কাছে বলে নিতাই। পুজো-পুজো গন্ধটা নিতাইয়ের ছোট বাড়ি থেকে গ্রামের আকাশে বাতাসে ছড়ায়। আঁঠালো মাটির ঢেলা তিলতিল করে মৃন্ময়ী রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বারান্দা লাগোয়া কালো শ্যাওলার চাদর গায়ে শিউলি গাছটি প্রতি বছর শরতের শুরুতে সাদা পাঁপড়ি মেলে আগমনীর বার্তা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। পুরো ঘরে ছড়িয়ে থাকে বাঁশের টুকরো, নদী পাড়ের আঠালো মাটি, শুকনো হলুদ খড় আর নানা রঙের রঙ-তুলি। নিজের শোবার ঘরে বর্ষাতে জল ঝরলেও, প্রতিমা বানানোর ঘরটার ছাদ প্রতি বৎসরেই মেরামত করায় নিতাই। বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে সব মাটির কাজ মাটি হয়ে যাবে। মহাষষ্ঠীর বিকেলেই একে একে কালীবাড়ি আর ক্লাবের লোকেরা এসে প্রতিমা নিয়ে যায়। তারপর ধুমধামের সাথে গ্রামে শুরু হয়ে যায় প্রতিটি বাঙালির প্রাণের উৎসবটি।
কালীবাড়ি থেকে পাওনা টাকার বেশীরভাগটা পেয়ে যাওয়াতে সপ্তমীতেই কিছু পুরানো ঋণ পরিশোধ করতে পেরেছে সে। হাতের অবশিষ্ট ছয়শত টাকা থেকে পাঁচশত টাকা তুলে দিয়েছে জয়ার হাতে। মেয়েটা ওকে নিজের বাবার মতোই ভালোবাসে। ওর বিয়ে অবধি বেঁচে থাকলে, ভালো কিছু একটা উপহার দিতে হবে। সপ্তমীটা ভালোভাবে কেটে গেলেও অষ্টমীর সকাল থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। সারাদিন থেকে ঝরা এই অকাল শ্রাবনে সবাই বিরক্ত। গাঁয়ের ভাঙা রাস্তায় কাদামাটি ঘেঁটে মানুষ পুজো দেখতে যাবে কেমন করে! প্রতিমা বাড়ি থেকে বের করে গ্রাহকের হাতে দেওয়ার পর থেকেই শরীরটা ভালো ঠেকছে না নিতাইয়ের। রাত হলেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার দু'দিন হয়ে গেছে। ফার্মেসি থেকে ঔষধ নিয়ে আসলে তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি। হাতে টাকাও নেই যে ডাক্তারের কাছে যাবে। নবমীর বিকেলে ক্লাব থেকে পাওয়া ধুতি আর আর খয়েরি পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে পরে নিতাই। প্রথমে কালীবাড়ি যাবে পরে ক্লাবে.. পুজো তো দেখা হবেই, তার সাথে ক্লাবে গেলে বকেয়া টাকা থেকে কিছু একটা দিতে অনুরোধ করবে বলে ভেবে রেখেছে। পুজোর দিনগুলোতে মানা করবে বলে মনে হয় না। সামান্য কিছু টাকা হাতে আসলে একবার ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে।
কালীবাড়ি হয়ে ক্লাবে আসতে আসতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আরতি দেখে সে। বেশিরভাগ পুরুষদের শরীর থেকে মদের গন্ধ আসছে। টাকার জন্য যে কথা পাতবে, সেইরকম ওজনের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। এই অসুস্থ শরীরে বৃষ্টিতে ভিজলে উপায় নেই। অগত্যা একজন মুখচেনা যুবককে দেখে মনের কথা বলে ফেলে নিতাই। উত্তরে যুবক বলে,
-- ইবার পুজাত ঘাটতি অইসে রেভো, এখন কিচ্ছু দেওয়া যাইতো নায়... পরে পাইবার নে।
একে তো শরীরটা ভালো না, তার উপরে গত কয়েকমাস থেকে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটানো নিতাইয়ের রাগ হয় যুবকটার উপরে। নিজের অসুস্থতার কথা বলে একটু রাগী গলায় আবার টাকা চায় সে। তার কথায় ক্লাবের যুবকটা দ্বিগুণ স্বরে চড়াও হয়, সন্ধ্যার আড়ালে গলায় ঢালা লাল পানীয় এইবার আসল রূপে আসে। যুবক বলে,
-- অতো বেটাগিরি দেখাইরায় যে, তুমার টেকা কিতা দিতামনায়নি! আমরার লাগিয়া তুমি টিকিয়া আছো, না অইলে তুমারে পুলিশে ধরিয়া নিলওনে.. হালার হালার বাংলাদেশী!
যুবকের কথায় অপমানে লাল হয় নিতাইয়ের মুখ, কপালে বিন্দুবিন্দু ঘামের ফোঁটা চোয়াল বেয়ে নেমে যায়। ধীরপায়ে বাড়িমুখো এগোয় সে, ঘরে ঢুকতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। রাত ন'টা হয়ে যাওয়ায় রেডিওতে আজ আর হাত না দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। এতোটা বছর একজায়গায় কাটানোর পরে ভিনদেশীর অপবাদটা আর সহ্য করা যায় না। সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি নিতাই। জ্বরটা বেড়ে গেছে, কাঁথা-কম্বল কিছুতেই যেন ঠান্ডা কাটছে না। বৃষ্টি সেই যে শুরু হয়েছিল আর থামেনি। সকালবেলা জয়ার ডাকে বাসিমুখে চা খায় নিতাই। সাধনকে গতরাতের কথা বললে সাধন খুব একটা আমল দেয় না নিতাই'র কথায়। বলে...
-- আমার লাখান দুইগ্লাস লালপানি খাইয়া দেখো নিতাইদ্দা, সব দুঃখকষ্ট ভুলি যাইবায়'...
বিকেল হতেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে নিতাই। সরকারি হাসপাতালের পিছনে সাধনকে পেয়ে ওর বোতল থেকে ঢকঢক করে নিজের গলায় প্রায় আধবোতল ঢেলে দেয়। ড্যাবড্যাবিয়ে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকে সাধন। পাশে বসার কথা বললে একরকম না শোনার ভান করেই বিসর্জন ঘাটের দিকে পা বাড়ায় নিতাই। আশপাশের কয়েকটা গ্রাম এই ঘাটেই প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য আসে। গতরাতের প্রবল বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে পাহাড়ি নদীটি। ঢাক-বাদ্যির সাথে সাথে চলছে কাঠাম বিসর্জন। মা আসবে আবার একটি বছর পরে। পায়ে পায়ে ঘাটের পাশে এসে দাঁড়ায়। কনকনে ঠাণ্ডা নদীর জল পায়ে লাগতেই পুরোটা শরীর শিরশিরিয়ে উঠছে। নদীতীরে আসা একটি কাঠামে হাত লাগায় সে, জীবনে কখনও বিসর্জন করতে যায়নি। একটু বেশী জলে নেমে গিয়ে সবাইকে কাঠামের পিছনদিকে সরে যেতে নির্দেশ দিচ্ছে মোড়লগোছের কয়েকজন। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে থাকা নিতাই আর পিছু হটেনি। পিছন থেকে ধাক্কা দিতেই কাঠামের নিচে চলে আসে নিতাইয়ের শরীর। প্রবল স্রোতের মুখে নিমেষেই মাঝ নদীতে চলে আসে প্রতিমা। জলের তীব্র ঘূর্ণি নিতাইয়ের কানে-মুখে ঢুকে পড়ে। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার দেহ, তলিয়ে যায় অতলে। একূল-ওকূল হয়ে অচিরেই ভাসমান নিতাই মিশে যাবে স্রোতের অনন্ত সলিলে, যেখানে আর নিজের পরিচয় দিতে হবে না...দরকার হবে না কোনও প্রমাণপত্রের।
Comments
Post a Comment