আলপনা

||তৃণময় সেন||
সারা উঠোনে আলপনা এঁকে হাতপা ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে লক্ষ্মী। একটু শুকিয়ে গেলেই সাদা রংটা আরো ভালোভাবে ফুটে উঠবে। ছোটবেলায় লক্ষ্মীপুজোর দিনে ওর পুজো বলে সঙ্গীসাথীরা ওকে ক্ষ্যাপাত যদিও তিনবোনের পরে আসা অবাঞ্চিত লক্ষীকে বাড়ির কেউই খুব একটা পছন্দ করত না। পান থেকে চুন খসলেই মা ওকে অলক্ষী বলে গাল পাড়ত। এই আলপনা আঁকাটা ও মাকে দেখে শিখেছে। চালের গুঁড়ো, ময়দা একসাথে গুলিয়ে নিয়ে নরম কাপড় দিয়ে উঠোন, দুয়ার থেকে শুরু করে রান্নাঘর পর্যন্ত খুব সুন্দর করে আলপনা আঁকত ওর মা। আঁকার পর ঘন্টাখানেক খুব সাবধানে পা ফেলতে হত, এই বুঝি আলপনা নষ্ট হয়ে যায়। হঠাৎ ঘর থেকে মেয়ের কান্নার শব্দে ঘোর ভাঙলো লক্ষ্মীর। তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে বুকে মুখ গুজিয়ে দিল সাত মাসের মেয়েকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে শুরু হয়ে যাবে অশান্তি। টেন্ট হাউসের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে বাড়ি ফিরবে সাধন। তারপর শুরু হয়ে যাবে চানাচুরের প্যাকেটের সাথে সস্তা মদের পার্টি। অনেকবার মানা করলেও লক্ষ্মীর কথা কানে তোলেনি সে। মেয়ে জন্মাবার পর থেকে সামান্য কথায় রেগে যায় সাধন, ওর মতন "অলক্ষীনি" বিয়ে করে নাকি সর্বনাশ হয়েছে! দুএকবার কথা কাটাকাটি করে লক্ষ্মীর উপর হাতও তুলেছে সে।
পুজো শেষে আশপাশের বাচ্চাদের ডেকে কলাপাতায় সাগু, চানামটর, জাম্বুরা, কুশিয়ারের যৎসামান্য প্রসাদ বিতরণ করে লক্ষ্মী। পাশের বাড়ির স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা সাহায্য না করলে কোলের বাচ্চাকে নিয়ে পুজো করাটা এবছর সম্ভব হত না। সেলাইয়ে ভাল হাত থাকলে তাও প্রায় বছর খানেক থেকে বন্ধ। কাজটা করতে পারলে ছোটছোট প্রয়োজনে সাধনের কাছে হাত পাততে হত না আর মনমর্জি বাড়িতে এরকম উপদ্রব বন্ধ করার জন্য সাধনকে আরেকটু জোর দিয়ে বলতে পারত লক্ষ্মী। আজকের এই পুজোর জন্যে অনেক কষ্টে একশ টাকা নিয়েছে সাধনের কাছ থেকে। জাম্বুরা, কুশিয়ারগুলো না কিনতে হলেও সাবু, চানামটর, অগুরু, চন্দনে টাকা সবকটাই লেগে গেছে।
লক্ষ্মীপুজো সন্ধ্যার জমজমাট ভাবটা কাটার পরে সাথে তিনজন লোক নিয়ে বাড়ি ফিরেছে সাধন। বাজার ব্যাগের ভিতর কাঁচের বোতলের টংটং শব্দ ঘরের ভিতরে থেকেই শুনতে পেয়েছে লক্ষ্মী। ওর সাথে কোনো বাকব্যয় না করে রান্নাঘরের পিছনে পুরোনো চাটাই পেতে ঘর থেকে গ্লাস, কেটলি নিয়ে যায় সাধন। পিছনের দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় মশারি টাঙিয়ে দেয় লক্ষ্মী। বাইরের হট্টগোলের আওয়াজে এই বুঝি ঘুম থেকে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। কেরোসিন বাতির আলোয় ফুটন্ত উনুনে ভাত পরখ করে লক্ষ্মী, সেদ্ধ হয়ে গেছে। গরম মাড় একটু মেয়ের জন্য রেখে দিতে হবে। বাইরে কথাবার্তার ঝাঁঝ তীক্ষ্ন হয়ে যাওয়ায় দরজায় কান পাতে লক্ষ্মী। সাধনের কাছে কি একটা হিসেবে চাইছে ওরা, কিন্তু সাধন তা মানতে নারাজ। ব্যাপারটা হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেছে ঠাহর করতে পেরে ছিটকিনিতে হাত দেবার সাথে সাথেই কানে আসে সাধনের আর্তনাদ। জোরে দরজার পাট খুললে দেখতে পায় সাধন মাটিতে কুঁকড়ে পড়ে আছে, চাটাইয়ের উপরে একজন সঙ্গী অর্ধনগ্ন অবস্থায় অচেতন। দৌড়ে গিয়ে সাধনের কাছে বসে পড়ে লক্ষ্মী। ঘামে ভেজা সাধন পেটে হাত চেপে কাতরাচ্ছে, ভালই মার পড়েছে গায়ে গতরে। চোখ তুলে বাকি দুজনকে দেখে ভয়ে ভিতরটা কেঁপে উঠে লক্ষ্মীর, এই ঠান্ডা চাহনির অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না। ধীর পায়ে লক্ষ্মীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে লুলোপ দুজোড়া চোখ। আধমরা সাধনকে ছেড়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকলেও শক্ত হাতের কাছে হার মেনে দরজা বন্ধ করতে অক্ষম হয় লক্ষ্মী। একপা দু'পা এগিয়ে আসছে নরপশুরা, পিছিয়ে যেতে যেতে মাড়ের গামলায় পা লাগে লক্ষ্মীর। হঠাৎ নিচু হয়ে গামলাটা হাতে তুলে নেয় সে। গরম মাড়ের জল ছুড়ে ফেলে দেয় আক্রমণকারীদের উপর। সহসা এই আক্রমণের জন্য মোটেই প্ৰস্তুত ছিল না লোকদুটো। ভীষণ গরম তরল গায়ে পড়তেই চিৎকার করে উঠে দুজনেই। ততক্ষণে চুলো থেকে জ্বলন্ত কাঠের টুকরো হাতে নিয়ে ক্ষিপ্রবেগে ওদের দিকে এগিয়ে আসে লক্ষ্মী। প্রচন্ড যন্ত্রনায় নেশার ঘোর কেটে গেছে অমানুষদুটোর। প্রানপনে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। পিছনে লক্ষ্মী যেন আজ রনংদেহী মা কালীর বেশে ধেয়ে আসছে। পূর্ণিমার রাতে আলোছায়া পথে গা ঢাকা দেয় লোকদুটো। মাঝ্উঠোনে দাঁড়িয়ে এখনো সমানে ফুঁসে যাচ্ছে লক্ষ্মী। জোৎস্না রাতের আভায় আলপনা শুকিয়ে গিয়ে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মাথা ঠান্ডা হলে ঘরের পানে পা বাড়ায় সে। লক্ষ্মীর পায়ের ছোঁয়ায় আজ সার্থক হয় আলপনার পদচিহ্ন!

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন