আম'র প্রেম
।। আম'র প্রেম...।।
এনারা আমার ঘরের ঠিক সামনের গাছের। প্রচণ্ড শাঁস হয় এদের গায়ে। তাই সুমিষ্টতার ফাঁদে পড়ে তাড়াতাড়ি করে উদরস্থ করার কিছুক্ষণ পর দাঁতের চারধারে শাঁস আটকে থাকার উপলব্ধিটা বড়ই বিরক্তিকর। এই বিষয়ে মনে পড়ে একবার এক নিকটাত্মীয়ের প্রথমবার আমাদের বাড়িতে আসা। একটু দুঃসম্পর্কের হলেও, শহুরে মানুষটি তখন এই বাড়ির নতুন জামাই হয়েছেন। গ্রীষ্মের এক হলুদ বিকেলে কাকু-জ্যাঠুদের ঘর হয়ে আমাদের ঘরে এসেই চা খাওয়ার ব্যাপারে ঘোর অনীহা প্রকাশ করলে, মা প্লেট ভরে গাছের আম কেটে দিলেন জামাইকে। ফলের রাজার এমন স্বর্গীয় প্রজাতি যে শহরে পাওয়া যায় না, সেই বিষয়ে আমি সহ আমার খানদান যখন তখন লাখ টাকার বাজি ধরতে পারি। লোকটি নিশ্চয়ই আমাদের মতোই আমপ্রেমী ছিলেন। তাই কয়েক মিনিটেই সাদা প্লেট আবার নিজের রঙ ফিরে পেলো। কিন্তু হাত ধুয়ে নেওয়ার পরই তার হাবভাবে অস্বস্তি টের পাচ্ছিলাম। কিছুটা প্রত্যাশিতই ছিল, তবে অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে কথা বলতে গেলেও দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা লম্বা শাঁস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিল বলে এক দৌঁড়ে ঘরের বাইরে চলে গিয়েছিলাম সেইদিন।
তা আজ এগারো বছর হতে চললো লালচে-হলুদ রঙের লাজুক উদ্ভিন্নযৌবনাদের ছুঁয়ে দেখা হয়নি। কৈশোররূপ হিসাবে আচার আর বার্ধক্যের আমসত্ত্বরূপে দেখা হয় প্রতি বছর। মা যত্ন করে বানিয়ে রাখেন। তবে গত কয়েক বছর থেকে তাদের সাথে দেখা করার আগ্রহ আমার থেকে মৌয়েরই বেশি থাকে। পুরো বাড়িতে আমগাছের সংখ্যা প্রায় ডজন খানেক হলেও মাত্র ছয়-সাতটিতে আমের ফলন হয়। তাও আবার প্রতি বছর সব গাছে আম ধরে না। বছর পাঁচেক আগে সবচেয়ে পুরোনো আমগাছটির মহাপ্রয়াণ হয়েছে। কথিত আছে দাদুর বাবা গাছটি নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন। তার পরের তিন প্রজন্ম ধরে প্রতি গ্রীষ্মকালে সুমিষ্টতার যোগান দিয়েছে আমগাছটি। শাঁসওয়ালা আম ছাড়া বাড়িতে ঢোকার পথে দুটো গাছ আছে। তাদের মধ্যে একটিতে আম পেকে গেলে হালকা ঝাঁকুনি দিলেই টপটপ করে ঝরে পড়ে। আরেকটা একটু ঝোপজঙ্গলের মাঝে। নিচে কাদাজল থাকায় অনেকসময় গাছের নিচে পড়ে কাদাতে ডুব দিয়ে তারা আত্মহত্যা করে। পাঁকে ডুবে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া ওখানে সরীসৃপদের অবাধ বিচরণ থাকায় খুব একটা যেতাম না। তবে এখন সব সাফ করে দেওয়া হয়েছে। আরও দুটো আছে পুকুর পাড়ে। অর্ধেক আমই পুকুরের জলে টুপ্ করে ডুব দিয়ে অতলে হারায়। স্নান করার সময়ে জলের নিচ থেকে আম কুড়াতে অনেক কসরত করতাম। ডুব দিয়ে আম খোঁজার অভিজ্ঞতা কেমন হয়, সেটা নিয়ে না হয় আরেকদিন লিখবো।
আমের প্রতি আমার দুর্বলতাটা বরাবরের। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াকালীন নিতান্ত কথা রাখতে গিয়ে গ্রামের একজন কাকুর একমাত্র ছেলেকে টিউশন দিতে হয়েছিল। কয়েকদিন পড়ানোর পরেই বুঝতে পারলাম যে এই গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া বানানো অন্তত আমার পক্ষে অসম্ভব। মাসখানেক না পড়িয়ে আবার মানাও করতে পারছিলাম না। সেদিন ভেবেই নিয়েছিলাম যে আজকেই মানা করে দেবো। কিন্তু ওদের বাড়ি যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদে সেদিন স্ন্যাকস হিসাবে ফাইবারের বড় প্লেটে কাকিমণি আম নিয়ে আসলেন। বাড়ির শাঁসওয়ালা আম বাদে এতো সুস্বাদু আম আমি কোনোদিন খাইনি। বলা বাহুল্য যে তারপরে ওই টিউশনের মেয়াদ মাস দেড়েকের জন্য বেড়ে গেছিলো।
নব্বই দশকে জন্ম অথচ 'মজুমদার বাড়ি'র সিঁদুরে আম খায়নি, এমন পাবলিক আমাদের গ্রামে নেই। বাড়ি থেকে শ'কদম দূরে ওদের বাড়ি। কচি-কাঁচাদের অপত্য স্নেহ করতেন। একদিন ওদের আমগাছের তলায় এক কালো কুচকুচে বিষধরের দিকে প্রথমে সাইকেলের টায়ার বলে এগোলেও পরে গা শিরশিরিয়ে উঠেছিল। ওদের বাড়ি থেকে পলিথিনের ব্যাগ ভরে আম আনতাম। বিকেলে মা আম কাটতে বসলে বাঁদরের মতো উবু হয়ে বসতাম দুই ভাই। বাঁশের ধুচুনে করে অন্তত দু-তিন কিলো আম রোজ সাবাড় করে দিতাম যদিও অনেক আমে পোকাও থাকতো। খুব ভোরে না উঠতে পারলে গাছতলায় আম পাওয়া যাবে না, এই চিন্তায় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে ভালোমতো ঘুম হতো না। ঝড়-বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। গাছ থেকে একবার আম পাড়তে গেলে একটা আম একদম সোজা মেঘের নাকে এসে পড়ে। অনেকক্ষণ পরে রক্ত বন্ধ হয়েছিল। এহেন কৃতকর্মে প্রতক্ষ্যভাবে জড়িত থাকার পরে কোনোক্রমে নিজের পিঠ বাঁচাতে পেরেছিলাম বলে আজও গর্ববোধ হয়।
একটা আমের ছবির সাথে এতো কথা বলাটাকে 'ধান ভানতে শিবের গীত' বলে পাঠক ধরতেই পারেন। কিন্তু ওটা আম বলেই এতো কথা বলা, নিজের ছবি হলেও বলতাম না। আমকে ভালোবাসাটা খানিকটা ওই 'লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট'-এর মতো। আম কি আমার ব্যাপারে এতটুকুও ভাবে? সত্যি, জানি না।
Comments
Post a Comment