রাজধানীতে এক দশক
আজকে এই শহরে আমার দশ বছর সম্পূর্ণ হলো। একটা মাইলস্টোন পেরিয়ে আসার পর অনেক ক্ষেত্রেই আমরা একটু আবেগী হয়ে গর্ব বোধ করতে ভালোবাসি। তাই দৈনিক পত্রিকা- ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে দুর্গাপুজোয় অনেক প্যান্ডেলের সামনে চোখধাঁধানো আলোয় 'গৌরবের দশ বছর বা 'সিলভার জুবিলী' লেখা হামেশাই দেখা যায়। তা গত এক দশকে 'গৌরব' করার মতো তেমন কিছু নেই আমার কাছে। একটু সংকোচ হলেও এই লেখাটা নিজস্ব ব্লগ বা ইমেলে না রেখে এখানে রাখছি, কেননা আজকের পরে প্রতি বছরে এই দিনে ফেবু আমাকে আবার মনে করিয়ে দেবে পুরানো সেই দিনগুলোর কথা। জীবনের কিছু বিশেষ সময় বা ঘটনার কথা সারা জীবন আমরা রোমন্থন করে থাকলেও প্রবাহমান সময়ের স্রোতে তার অনেকখানি স্মৃতিপট থেকে অজান্তেই মুছে যায়। তাই আরও দশ বছর পরে যখন আবার এই পোস্ট পড়বো, তখন হয়তো নিজের কাছেই অনেক কিছু নতুন বা অজানা বলে মনে হতে পারে।
১৭ই ডিসেম্বর ২০১০। বারো দিন আগে একুশ পেরিয়ে বাইশে পড়েছি। আগের দিন ক্রিকেট টুর্নামেন্টে আমার দল জিতেছে। পরের ম্যাচটি আর আমার খেলা হবে না। মন খারাপ ছিল। তার ওপর বাড়ি ছেড়ে এতদূর যাইনি কোনোদিন। দূরের সফর, সিট পেতে যাতে কোনো ঝামেলা না হয়, তাই বাড়ি থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে বিহারা স্টেশন থাকা সত্ত্বেও সাতসকালে শিলচরে গিয়ে বরাক-ভ্যালি এক্সপ্রেস ধরলাম। যার ডাকে দিল্লি যাওয়া, সে অসুস্থ। তার বাবা ও ছোট ভাই আমার সাথে যাচ্ছেন। শিলচর-বদরপুর-সুকৃতিপুর হয়ে মাঝবেলায় আমার গ্রামের পাশ দিয়ে স্কুলের গা-ঘেঁষে যখন ট্রেনখানা যাচ্ছিল, তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি মনে হচ্ছিল। বিহারা স্টেশনে মায়ের আসার কথা ছিল না। দু'মিনিটের স্টপেজে আকুল চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে স্বভূমের টুকরো ছবিগুলো যখন আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি, তখন মাকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব আশা করিনি। হাতে স্টিলের টিফিন বাটিতে আমার প্রিয় সিম চচ্চড়ি, ভাত। একটা পঞ্চাশ টাকা আর পাঁচটা চকচকে দশ টাকার নোট হাতে গুঁজে দেবার সময় কোনোমতে চোখের বাঁধ ধরে রাখলেও পরে খাবারটা খেতে পারিনি। সেই একশো টাকা আজও খরচ করিনি। তবে অধিক যত্ন সহকারে রাখতে গিয়ে ঠিক কোথায় যে রেখেছি এখন মনে করতে পারি না।
আটটার বদলে নর্থ-ইস্ট এক্সপ্রেস যখন রাত দু'টোয় পৌঁছালো, তখন কুয়াশার চাদর গায়ে কনকনে শীত রাজধানীতে স্বাগত জানালো আমাদের। অসুস্থ শরীরে সেই মানুষটি নতুন দিল্লি রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে নিতে এসেছিলো। হলদে-সবুজ রঙের অটোতে আঁটসাঁট হয়ে বসে যাচ্ছিলাম, তখন কুয়াশার পরত ভেদ করে আসা বিশাল সাইজের স্ট্রিটলাইটগুলো ছিমছাম রাজপথ ধুয়ে দিচ্ছিল। পথের দু'পাশে দৈত্যাকৃতির অট্টালিকা। ভাবছিলাম এখানকার মানুষের আকাশ তাহলে বেশ ছোট। কংক্রিটের জঙ্গল ভেদ করে এদের স্বপ্নগুলো আসমান অবধি বোধহয় পৌঁছতেই পারে না। দেখে মনে হচ্ছিল না যে রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। হিমশীতল ঠান্ডায় জিনিসপত্র নিয়ে পাঁচতলায় উঠতে গিয়ে ঘেমে গেছিলাম সেদিন।
প্রসেনজিৎ দাস। আমার গ্রামেরই ছেলে। বাবাকে দাদু বলে ডাকায় আমি ওর কাকু হই। কিন্তু বয়সে আমার থেকে বড় হওয়ায় আমিও তাকে কাকু বলে ডাকি। গ্র্যাজুয়েশন চলাকালীন পড়াশোনা শেষে কোনো ব্যবস্থা না হলে দিল্লি চলে আসার ভরসা দিয়েছিল। তার মারণব্যাধির কথা এখানে আসার মাসখানেক আগেই জানতে পেরেছিলাম। ভেবেছিলাম এই রাস্তা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সে নিজেই ফোন করে আসতে বলেছিলো। প্রসেনের সাথে ওর মা-ছোটভাই কয়েক মাস থেকে ওর সাথেই থাকছিলেন। আমরা যাওয়ার পর পরিবারটা ছয়জনের হয়ে গেলো। থাকতে কোনো অসুবিধা না হলেও যেহেতু ডাক্তারের নির্দেশে প্রসেনের তেল-ঝাল খাওয়া বারণ, ঘরে আলাদা করে আর খাবার বানানো হতো না। একটা প্রাইভেট হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। শরীরে এতবড়ো রোগ থাকা সত্ত্বেও তার সদাহাস্য মুখ দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে মানুষটি বড়োজোর আর বছরখানেকের অতিথি। এমন প্রাণবন্ত মানুষ জীবনে দু'টি দেখিনি। নিজের উদ্যোগে আমাকে চাকরিতে লাগিয়ে দিয়েছিল। যদিও বোকামি করে সেখানে কয়েকদিন গিয়ে আমি নিজেই বাদ দিয়ে দেই।
যা কিছু টাকা-পয়সা সাথে নিয়ে এসেছিলাম, তাতে কোনোমতে মাসখানেক কাটলো। বুঝলাম, শুধু চাকরির জন্য জোর করে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করেছি, তাতে কিছু পেয়ে যাওয়া আদতেই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কয়েক মাস কেটে গেছে। প্রতিমাসে বাবা টাকা পাঠাচ্ছেন। অনেক চেষ্টা করেও কিছু না করতে পেরে আত্মবিশ্বাস তলানিতে পৌঁছেছে। দিল্লি যাবার আগে দিদিমাকে নিয়ে একবার গুয়াহাটি পর্যন্ত গেছি। এই পর্যন্তই আমার দৌঁড়। এতবড় শহরে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। মাথামোটামি করে প্রসেনকাকুর কারণে পাওয়া চাকরিটা করলাম না।
পরিচিত একজনের সুপারিশে দিল্লির লক্ষ্মীনগর এলাকায় একটি আইটি কোম্পানিতে যোগ দিলাম। ওদের কথা ছিল আগে আমাকে কাজ শিখতে হবে তারপর বেতন। কাজ শেখানোর নামে ওদের অফিসের নানা কাজে আমাকে যেখানে খুশি পাঠিয়ে দিত। ফিল্ড বয়ের কাজ করলাম কিছু দিন। হাত খরচের টাকা ছাড়া কিছুই পাইনি। দিল্লির অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। তখন গুগল ম্যাপের ব্যবহার শুরু হয়নি সেভাবে। মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে গন্তব্য খুঁজে বের করতে হতো। এরকম অনেক দিন গেছে যখন সকালে সামান্য কিছু খেয়ে অফিস তারপর আর সোজা রাতের বেলায় খেয়েছি। সারাদিন পেটে কিছুই পড়তো না।
সেখানেই নিতেশের সাথে দেখা। প্রবাসে আমার প্রথম বন্ধু। ওর আর্থিক অবস্থা আমার থেকে বেশ ভালো ছিল। অফিসেরই একজন ওকে কিছু টাকার বিনিময়ে কাজ শিখিয়ে দেবার টোপ দিল। আমি তখন মাঠেঘাটে ঘুরে বুঝে গেছি যে এরা আমাকে ফিল্ড বয়ের থেকে এগোতে দেবে না। শেখানো তো দূর অস্ত, কম্পিউটারের সামনে বসবার সুযোগটুকু হয় না। নিতেশ টাকা দিয়ে শিখতে লেগে গেলো। যার সুপারিশে এখানে আসা তাকে কথাটা জানাতে সে টাকা দিতে মানা করে দিলো। অগত্যা সেই 'চাকরির' এখানেই ইতি হলো।
সেই সুপারিশকারী মানুষটিও আমাদের গ্রামের। একসময় সে বাবার কাছে পড়েছে, আশা করছিলাম সেই আমাকে হয়তো পথ দেখিয়ে দেবে। করোলবাগে পাঁচজন কর্মচারী নিয়ে ছোট একটা অফিস ছিল তার। যদিও তাকে আমার খুব একটা পছন্দ ছিল না। কথায়-বার্তায় কেমন একটা অহংকার ফুটে উঠছে। কিন্তু আমার কাছে কোনো রাস্তা নেই আর। তার অফিসে গিয়ে বসে রইতাম। একদিন ওরই একজন বিজনেস পার্টনার আমার ব্যাপারে শুনে পটপরগঞ্জ এলাকায় তার চেনাশোনা একজনের অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। টাকা-পয়সার কোনো কথা হলো না। ওরা বললো আমাকে কাজ শিখিয়ে দেবে। অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। আমার ঠিকানা থেকে ৮৫ নম্বরের বাস ধরে যেতে হয়। আইটির কাজ ওরা শেখাতো ঠিক কিন্তু ওদের ইভেন্টের কাজও ছিল, যা সারা রাত জেগে করতে হতো। এরকম অনেকবার হয়েছে যখন আমি সকালে দশটায় অফিসে গেছি আর এসেছি তার পরের দিন। একফোঁটা ঘুম নেই সারা রাত। মাসখানেকের হাড়ভাঙা খাটুনিতে শরীর-স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।
সময়টা জুন মাস। প্রচন্ড গরম পড়েছে দিল্লিতে। অফিসে দিনরাত এক করে কাজ করতে গিয়ে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লাম। রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেলো আমার টাইফয়েড হয়েছে। যত্ন নেবার মতো কেউ না থাকায় নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হতো। প্রসেনকাকুর অসুস্থতা তখন ধীরে ধীরে বাড়ছে, ওর কেমো শুরু হলো। একটু সুস্থ বোধ করায় আবার অফিস যাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু প্রচন্ড দুর্বল শরীরে একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। ভুল বাসে উঠে পড়লাম। জিজ্ঞেস করে যখন জানতে পারলাম যে বাসটা আমায় গন্তব্যে নিয়ে যাবে না, তখন নামতে গিয়ে একবারও মাথায় আসলো না যে বাসটা তো থেমে নেই। চলন্ত বাসে নামতে গিয়ে ছিটকে পড়লাম। ভাগ্যিস তেমন চোট লাগেনি। সেই ঘটনার দু'দিন পর আবার ডাক্তার দেখাতে গেলে জানতে পারলাম যে আমার জন্ডিস হয়েছে। শরীর শুকিয়ে ততদিনে অর্ধেক হয়ে গেছে। পুরোনো কাপড়চোপড় আর গায়ে আসছিল না। কোনো কাজে নিচে নামলে পরে আবার পাঁচতলা বেয়ে উপরে উঠতে পা-কাঁপতো। বাড়ি থেকে বারবার চলে আসার জন্য বলা হচ্ছিল। কিন্তু আমি ফিরে যাইনি। ভাবছিলাম পুজো অবধি দেখি, যদি কিছু একটা পাওয়া যায়। জুনের শেষ সপ্তাহে কাঙ্খিত ফোনকলটি এসেছিল। যার কারণে হয়তো আয়েশ করে বসে এসব লিখতে পারছি।
স্বল্প বেতনের হলেও উইপ্রোতে চাকরিটা পাবার পর তেমন কষ্ট করতে হয়নি। অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়েছে। বছরখানেকের মাথায় প্রসেনকাকু মারা যায়। সব চেষ্টা বিফল হবার পর ডাক্তারটা বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিল ওকে। ওই দিনটার কথা আজও মনে পরে যেদিন সে আমাদের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে শেষ বারের মতো বাড়ি ফিরছিল। "তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরে এসো..." বলার পর আর একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারিনি। সব আশাকে মিথ্যে করে প্রাণঘাতী ক্যান্সার একদিন তাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ, এই জনমে ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়।
আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ অন্ধ করা।
তোমার পরশ থাকুক আমার হৃদয় ভরা...
তার কিছুদিন পরের একটা ঘটনা বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। যে অহংকারী মানুষটির কথা আগেও উল্লেখ করেছি, সে নাকি বেশ মোটা টাকার জালিয়াতি করে দিল্লি ছেড়ে পালিয়েছে! পুলিশ তার চেনা-পরিচিত সবাইকে জেরা করছে। সেই বিকেলেই ওর সেই বিজনেস পার্টনারের ফোন পেলাম। লোকটা আমাকে সেই ব্যাপারে কিছু বললো না, একবার শুধু দেখা করতে বললো। দেখা করতে যাইনি আমি। পরের দিন ফোনে হুমকি দিলো, না আসলে আমার খারাপ হবে। আমি কিছু জানি না বললাম, কিন্তু সে শুনতে রাজি হলো না। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আবার তার ফোন। সেই কলে কিছুক্ষণ পরে অন্য একজন লোকের গলা, বললো সে দিল্লি পুলিশ থেকে বলছে। আমাকে ওদের অফিসের কাছে গিয়ে দেখা করতে বললো। সাহস করে বললাম যে আমি কিছু জানি না, পুলিশ স্টেশনে গিয়ে দেখা করতে পারি কিন্তু বাইরে কোথাও দেখা করতে যাব না। সে আমার ফোন ট্রেস করে আমাকে ধরে নেবার হুমকি দিল। তারপর তিনদিন ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি, তখন আমার বয়স মাত্র বাইশ। পরে অবশ্য সেই মানুষটাকে দিল্লি পুলিশ আমাদের গ্রামে গিয়ে পাকড়াও করতে সমর্থ হয়েছিল।
তার পরে প্রায় নয় বছর কেটে গেছে। যেসব জায়গাতে কোনোদিন পা ফেলার স্বপ্ন দেখিনি, সেখানে সম্মানের সাথে আছি, চাকরি করছি। দেশ বিদেশের মানুষের সাথে রোজ কথা হয়। পেয়েছি অনেক কিন্তু একজন প্রবাসী হয়ে যা হারিয়েছি, তা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না। আমার মতো অনেকেই আছেন যারা নিজের মাটি ছেড়ে দূরে থাকেন বটে, কিন্তু মন সেই স্বভূমেই পড়ে থাকে। আসলে তারা বড়োই অসহায়, যেখানে থাকেন সেখানের মানুষ তারা মন থেকে হতে পারেন না বা হতে চাইলেও স্থানীয়রা সহজে মেনে নেয় না। আর যে নদী-মাঠ-মেঠো পথ রোজ স্বপ্নে আসে সেখানে বৎসরান্তে গেলে সেই পরিচিত জায়গা ফিরে পাওয়া যায় না। নিজের মানুষের কাছেই একরকমের 'বিদেশী' হয়ে বাঁচতে হয়। ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত অস্তিত্ব সংকটে ভোগেন তারা। বছর শেষে যখন বাড়ি ফিরি, তখন মাকে ছাড়া আর সবকিছুই যেন বদলে গেছে মনে হয়। আমি আজও ফেরার স্বপ্ন দেখি। একদিন ফিরবোই তা জানি। কিন্তু নিজের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নিজেই সন্দিহান। গত কয়েক বছরে লেখালেখির মাধ্যমে কিছুটা হলেও নিজের মানুষদের কাছে আসার সুযোগ হয়েছে। আশা করি কোনোদিন ফিরলে তারা অন্তত কাছে টানবেন আমাকে। এই লেখা তাদেরই জন্য।
Comments
Post a Comment