দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন - পিতৃতন্ত্র যখন আয়নার মুখোমুখি।
#দ্য_গ্রেট_ইন্ডিয়ান_কিচেন - পিতৃতন্ত্র যখন আয়নার মুখোমুখি।
মনের কথা বুঝতে ভাষা কখনো প্রতিবন্ধক হতে পারে না। কয়েক হাজার বছর আগে যখন ভাষা আবিষ্কার হয়নি, তখন তো মানুষ ইশারায় বা যেমন করে হোক যোগাযোগ স্থাপন করেই নিতো। বহু ভাষাভাষীর এই দেশে এইরকম কত মানুষ আছেন যারা মুখ খুললে তার বিন্দুবিসর্গ আমি বুঝতে পারবো না। কিন্তু তাই বলে কেউ যদি এমন কোনো নতুনের সন্ধান নিয়ে আসে, তাহলে শুধু তার ভাষা বুঝতে পারলাম না বলে তাকে দূরে ঠেলে দেবো তা তো হয় না!
সিনেমাটি দেখবার আগে এইরকম কিছু আবোলতাবোল ভাবনা জড়ো করে মনটাকে একটা সিদ্ধান্তে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। বিখ্যাত চিত্র সমালোচক থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া, সর্বত্র অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে সিনেমাটি। তবে একে তো দিনটা ছিল রোববার তার ওপরে বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি ছেড়ে সোজা মালায়ালম সিনেমা, তাই মনকে কিছু একটা বলে তো বোঝাতেই হয়! সাবটাইটেল দেখে কাজ চালিয়ে নেব ভেবে শুরু করার কয়েক মিনিট পরেও যখন স্ক্রিনের নিচে কিছুই দেখতে পেলাম না, তখন একটু মনঃক্ষুণ্নই হলাম বটে। যদিও তার ঠিক একশো মিনিট পরে একপ্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম। আর ঠিক সেইজন্যই লেখক এবং পরিচালক জিও বেবির 'দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন' মুভিটি দেখার জন্য পাঠককে নিশ্চিন্তে অনুরোধ করতে পারছি।
সিনেমাটির শুরুতে দেখা যায় একদিকে রান্নাঘরে সুস্বাদু খাবার তৈরী হচ্ছে আর আরেকদিকে চলছে নাচের মহড়া। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে আসছেন তাই এতো আয়োজন। মেয়ে আবার নাচে পারদর্শী। কচিকাঁচারা অনেকেই তার কাছে তালিম নিতে আসে। ছেলে সরকারি চাকুরে। পরিবারে মা-বাবা ছাড়া কোনো বাড়তি মানুষজন নেই। ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে এমন সমাহারকে 'সুখী’-এর মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করে বিয়ের ব্যাপারে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সুতরাং এইক্ষেত্রেও আত্মজাকে তার 'নিজের ঘর' বা 'আসল ঘর'-এ পাঠিয়ে দিতে দুইবার ভাবেন না মা-বাবা। যে কিনা ঘরকন্নার কাজ জানলেও নাচের মতো ততোটা পারদর্শী নয়।
আসল বিষয়ে যাবার আগে একটা কথা বলে রাখি; যারা খাদ্যরসিক তাদের জন্য সিনেমার প্রথম দিকটা বেশ ভালোই কাটবে। রকমারি খাবারের পদ, তৈরী করার প্রণালী, ক্লোজআপ শটগুলো দেখে জিভে জল আসতে বাধ্য। আর আমার মতো খাদ্যরসিক প্লাস হাতা-খুন্তির সাথে টান অনুভব করা লোকজন হলে তো কথাই নেই। গুগল-ইউটিউবে রেসিপি খুঁজতে বসে যেতে পারেন বৈকি। নাহ, এই সিনেমাতে সিক্স প্যাক অ্যাবসওয়ালা হিরো, লাস্যময়ী হিরোইন, হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান চালানো ভিলেন নেই। নেই কোনো সাসপেন্স, প্রেমের অলীক স্বপ্ন, আধ্যাত্মিকতা বা রহস্যের গন্ধ। রয়েছে নিতান্তই সাধারণ আটপৌরে জীবন অথচ দেখেও না দেখা, বুঝেও না বোঝার মতো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার সাথে একাত্ম হতে আলাদা করে কোনো ভাষা শেখার দরকার নেই। দরকার আছে একটা সংবেদনশীল মনের, যেখানে ঠিক শেলের মতো সিনেমাটি বিঁধতে পারে। আর যা টেনে হিঁচড়ে যাবতীয় মুখোশ খুলে দেখিয়ে দেয় পুরুষতন্ত্রের নগ্ন রূপ। 'হাউসওয়াইফ' শব্দটিকে 'কিছু না করার' পর্যায়ে ফেলা সমাজকে সিনেমাটি একা দেখার পরামর্শ দেব, কেননা ওই কিছু না করা মেয়েলোকটির সাথে দেখতে বসলে সিনেমা শেষে আপনি মুখ দেখানোর মতো অবস্থায় থাকবেন না।
বিয়ের পর শ্বাশুড়ির সাথে পরিবারের হাল ধরে একগুচ্ছ স্বপ্ন নিয়ে নতুন জীবনে পদার্পণ করে মেয়েটি। পারিবারিক 'পরম্পরা’- এর মতো শিলনোড়ায় নারকেলের চাটনি থেকে শুরু করে স্বামীর এঁটো পাতে খাওয়ায় অভ্যস্ত হতে বেগ পেতে হয় তাকে। যাবতীয় সব নিয়মনীতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সাথে হিমশিম খেতে হয় পিরিয়ডসের দিনগুলোতে। নিজের মনের ইচ্ছেগুলো ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে থাকে পরিবারের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কাছে। মুশকিল শুরু হয় সন্তানসম্ভবা ননদকে দেখাশোনা করতে শাশুড়ির সেখানে চলে যেতেই। তখন দায়িত্বগুলো পরজীবী উদ্ভিদের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ফেলে। তাই আক্ষরিক অর্থে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার বা গার্হস্থ্য হিংসার ছিটেফোঁটা মুভিতে না থাকলেও 'ছোট ছোট' জিনিসগুলো একসময় দুঃসহ হয়ে ওঠে আর দর্শককেও বাধ্য করে মনখারাপের আঁধারে হারিয়ে যেতে। তার বেশি জানতে গেলে সিনেমাটি দেখতে হবে। আগেভাগেই স্পয়লার দিয়ে আপনার দেখার ইচ্ছা নষ্ট করা বা এই সিনেমার প্রতি অনেক মানুষের শ্রমকে অবহেলা করার অধিকার নেই আমার।
'মেয়েরা মায়ের জাত, তারা সব পারে' বলার আগে আমরা ভুলে যাই তারা আগে মানুষ পরে মা। সবাইকে আপন করে নেওয়া, স্নেহমমতায় আগলে রাখা, নিজের কষ্ট গোপন করে ঘরের বাকি সদস্যদের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া সেই 'মানুষ'টির খবর কি আদৌ আমরা রাখি? কত প্রতিভা হেঁশেলের ধোঁয়ার মতো জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে যায়, স্বপ্নগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে অথচ সামান্যতম স্বীকৃতি জোটে না কপালে। হাবভাবটা এমন যেন এই জীবনটাই কাম্য ছিল। 'পরিবার' নামের কনসেপ্ট টিকিয়ে রাখতে যুগযুগ ধরে চলতে থাকা নারীজীবনের চুপকথারা প্রগলভ হয়ে ওঠে সিনেমাটিতে।
আমাজন প্রাইমে উপলব্ধ এই মালায়ালম চলচ্চিত্রটির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিমিশা সাজায়ন। পার্শ্বচরিত্রে আমরা দেখতে পাই সুরজ ভেনজারামুদ্দু সহ বর্ষীয়ান অভিনেতা টি সুরেশ বাবুকে। রিজিওনাল মুভিতে দক্ষিণ ভারতের নির্দেশকরা বেশ কিছুদিন থেকেই চমক দিচ্ছেন। তবে এমনভাবে ভীষণ প্রাসঙ্গিক তথা পিতৃতন্ত্রের চোখে আঙুল দিয়েই না থেমে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া সিনেমা খুব কমই হয়েছে। আর তাই টিম সহ জিও বেবিকে বলতেই হয় "জিনা তো তুমহারা বনতা হ্যায় বেবি...জিও!"
Comments
Post a Comment