গ্রন্থ পর্যালোচনা
প্রায় দেড়মাস ধরে সময় সুযোগে আধ-পৌনে ঘন্টা পড়ার পরে আজকে শেষ করলাম তিলোত্তমা মজুমদারের আটশো পাঁচ পাতার বইখানি। রাজপাট। এতোটা সময় লাগার পেছনে দু'টো কারণ আছে। প্রথমত, বইটি কাহিনী সর্বস্ব ছিল না। তাই বইয়ের টানে নিজে থেকে সময় বের না করে যখন স্বতঃস্ফূর্ত সময় পেয়েছি, তখন পড়েছি। আর দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই বর্তমানের অস্থির সময়। অহরহ দুঃসংবাদ ক্রমশই কোণঠাসা করে দিচ্ছে মনটাকে। দুঃস্বপ্নরা যে এতোটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়, এর আগে জানা ছিল না।
উপন্যাসের পটভূমি পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী জেলা মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদকুলি খাঁ-র মুর্শিদাবাদ। সিরাজের মুর্শিদাবাদ। গঙ্গা এখানে সাগর অভিমুখে প্রবহমান। একটা সময় নবাব আর তারপরে বাউল-বৈষ্ণব সাধকদের বিচরণের ক্ষেত্র বলে বিখ্যাত হয়েছিল এই মুর্শিদাবাদ। মিশ্র সংস্কৃতির এই জেলায় হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ধর্ম-জাতি-বর্ণের নামে তেকোনা-ধুলামাটি- চতুষ্কোণার মতো গ্রামের মানুষকেও কোনো বিভেদকামী শক্তি আলাদা করতে পারেনি। মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের কিছু টুকরো ছবি দক্ষ হাতে তুলে ধরেছেন লেখিকা। তাই এই উপন্যাসটিকে ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতি-ইতিহাস এবং মানবিক সম্পর্কের গভীর উপাখ্যান বলা যায়।
উপন্যাসের প্রতিটি বাঁকে পুণ্যতোয়া গঙ্গা নদীর দেখা পাওয়া যায়। প্রবহমান নদী অনেক ইতিহাস সৃষ্টি এবং ধ্বংসের সাক্ষী। মহাপ্রাণ ময়না বৈষ্ণবীর সাথে বাউল দুলুক্ষ্যাপা, নির্ভীক যুব রাজনেতা সিদ্ধার্থ, স্বার্থপর গ্রাম্য মহাজন সুকুমার পোদ্দার, জ্ঞানী প্রবীণ বোধিসত্ত্ব, দুঃখিনী তান্ত্রিক শিখারানী, গৃহবধূ আফসানা, কৃষক-কবি বলাই মণ্ডলের মতো প্রায় পনেরোটি ভিন্ন অথচ স্বতন্ত্র চরিত্রের সংমিশ্রণে সজ্জিত ভিন্নধর্মী উপন্যাসটি।
গঙ্গার মতোই পাপপ্রক্ষালনকারী এক আশ্চর্য মানবী ময়না বৈষ্ণবী। তার জীবনদর্শন তাকে শিখিয়েছে যে “পুরুষকে কামে চিনলে হয় না, তাকে স্নেহে চিনতে হয়। সেখানেই আছে তার প্রেমের আখর।" তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আশ্রমে ঈশ্বর আরাধনার ছদ্মবেশে সক্রিয় রয়েছে নারীপাচার চক্র। অতর্কিত এই সন্ধান ব্যথিত করে তাকে। বিদ্রোহী মন একাই তার মোকাবিলা করতে পথে বেরোয়। প্রতিকার চায় তরুণ রাজনৈতিক কর্মী সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তারপরেই কিছুদিনের মধ্যেই নির্জন স্থানে একাকিত্বের সুযোগ পেয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো ময়নাকে। মৃত্যুর পরেও উপন্যাসে সমান প্রাসঙ্গিক থেকে যায় ময়না বৈষ্ণবী।
উপন্যাসের অনেকটাই জুড়ে আছে বাউলদের জীবন কথা, তাদের শরীর সাধনা। পদাবলী কীর্তন, বাউল গান আর প্রতিটি পর্বের শুরুতে লোকায়িত সংস্কৃতির সহজিয়া গানের পংক্তি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয় বইটিকে। মরমী কলমে লেখিকা এঁকেছেন বলাই মণ্ডলের মতো মাটির গন্ধ মাখা এক অপার চরিত্র। যিনি একজন কৃষক এবং কবিও। মাঠের আমগাছগুলোর নামকরণ করেছেন তিনি। কিন্তু একে একে তারা সকলেই নদী ভাঙনের কবলে প্রাণ হারায়। কলুষনাশিনী গঙ্গা সর্বগ্রাসী রাক্ষসী রূপ ধারণ করে। একসময় সর্বস্ব হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যান কবি। নগ্ন হয়ে পথে দাঁড়ান। চোখের সামনে লহমায় চতুষ্কোণা গ্রাম ইতিহাস হয়ে যায়। তিলোত্তমা লিখেছেন "তখন শান্ত নদীটি বয়ে যাচ্ছে পটে আঁকা ছবিটির মতো। কে বলবে, ওই নদীর তলায় খানিক আগেও একটা আস্ত গ্রাম ছিল! গৃহস্থী ছিল কত! কত শোকগাথা। মানুষের কত প্রাচীন ইতিহাস ধরা ছিল সেই গ্রামে! কে বলবে? চতুষ্কোণা আজ হতে বিপন্ন স্মৃতিকথা!" ঠিক তখন কবির কলম ধারণ করে তার ছেলে তীর্থ। আকাশে জ্বলে মিটিমিটি তারা। রাস্তার বাঁধের উপর তখন কবিতারা ভর করে তীর্থের উপর। খোলা আকাশে পিদিমের আলোয় সে লেখে তার জীবনের প্রথম কবিতা।
বইটি গত নভেম্বর মাসে বিজয়া করের কাছ থেকে উপহারস্বরূপ পেয়েছি। বন্ধু সুদীপ হয়তো দোকান থেকে পছন্দ করে নিয়ে এসেছিল। উপন্যাসের শেষে একটি দীর্ঘ গ্রন্থতালিকা দিয়েছেন তিলোত্তমা, যেগুলোর সহায়তায় বইটি সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রচুর অধ্যয়ন-গবেষণার ফসল রাজপাট। তাই কাহিনী বা চরিত্র সর্বস্ব না হয়েও পাঠককে একটি অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়। সমাজ, রাজনীতি, পুরাণ প্রসঙ্গ এবং সর্বোপরি মাটি ও মানুষের দেশকে জানতে গেলে উপন্যাসটিকে পড়তেই হবে।
Comments
Post a Comment