পিরীতের কাঁঠাল
শরীরে তেমন একটা জুত নেই। বাঁহাত জুড়ে ভ্যাকসিনের ব্যথা। তবুও গতকাল অফিসে যে আমরা ছয়জন সহকর্মী ভ্যাকসিন নিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে কেবল আমারই জ্বর আসেনি। বাকিরা ইতিমধ্যেই প্যারাসিটামলের শরণাপন্ন হয়েছে। শরীর ও মনের ঠান্ডা যুদ্ধে মন জয়ী হওয়ায় লিখতে বসা। আসলে নিছকই মনের জোরে লিখবো বলে বসেছি বললে আসল সত্যকে আড়াল করা হবে। গত উইকেন্ডে আম নিয়ে লেখার পর থেকে কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম অপরাধবোধ কাজ করছিল। ফলের রাজার গুণগান তো সবাই করে, কিন্তু সারা দুনিয়ার রাজা হলেও বাঙালির হৃদয় সম্রাট তো আম নয়! যার গুণগান করতে গিয়ে তার গায়ের আঠাকে দরাজ গলায় প্রেমাসনে বসিয়েছেন বাউল সম্রাট, তাকে কি আর উপেক্ষা করে থাকা যায়!
কাঁঠাল অপছন্দ অথচ কাঁঠালবিচি, কাঁচা কাঁঠাল(এঁচোড়)-এর তরকারি, কাঁঠালের বড়া বা কাঁঠালের আঁচার পছন্দ - এমন কিছু একটা লিখে এই পোস্টে মন্তব্য করার আগে পাঠককে আগেভাগেই সতর্ক করে দিতে চাই। কাঁঠাল ভালো লাগে না, কিন্তু আবার কাঁঠালের বড়া, বিচি পছন্দ এসব মোটেই গর্ব করার মতো ব্যাপার নয়। বলছি একটু লজ্জা করুন, অপছন্দ হলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকুন। কেননা আপনার এই হিপোক্রেসি আমার অসহ্য লাগে। আর তাই দু'টো কটু কথা শুনিয়ে হাটে আপনার কাঁঠাল ভাঙার জন্য আমি দায়ী থাকবো না।
"আরে যাদের পরাণ বার হইগেলো কাঁঠাল খাওয়ায় জ্বালায়..."
মনে পড়ে ছোটবেলায় যখন চালের বস্তা নিয়ে বারান্দায় বা ঠান্ডার দিনে রোদে পড়তে বসতাম, তখন আকাশবাণী শিলচরের 'পল্লীগীতি' অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝেই এই গানটি বাজতো। শিল্পীর নাম মনে নেই। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে সেই দিনগুলো স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। আমি আজও দেখতে পাই বইখানা খুলে আমি জসীমউদ্দীনের কবিতাটি অনর্গল পড়ে যাচ্ছি...
'রৌদ্র তপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল
আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভূ খেল ল'য়ে অশনি,
একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী।'
কাঁঠালি চাঁপা। কাঁঠালি কলা। কাঁঠালই বোধহয় একমাত্র ফল যার নামে আলাদা করে ফল-ফুল দুটোই আছে। কাঁঠালকে আবার গাছপাঁঠাও বলা হয়। হাইস্কুলে বাড়ি থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে বাধ্য হয়ে চরম অপছন্দের বিষয় অংক পড়তে স্যারের বাড়ি যেতে হতো। কোনোদিনই অংক বুঝিনি। পরীক্ষার আগে নিজেকে একরকম 'কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো'-র মতো তৈরী করতে হতো। তা সোম-বুধ-শুক্র দু'ঘন্টা করে পড়াতেন স্যার। সারা বছর মনমরা হয়ে থাকলেও জ্যৈষ্ঠ- আষাঢ়ে ক্লাসের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবার কারণ ছিল স্যারের বাগানের কাঁঠাল গাছ। বড় কোয়াওয়ালা এমন সুস্বাদু কাঁঠাল ইহজীবনে ভোলার নয়। কচুর লতি-কাঁঠাল বিচি, নালি শাকের গিঁট-কাঁঠাল বিচি, সিঁদল দিয়ে.... সরি, রেঁধে যখন খাওয়াচ্ছেনই না, তাহলে অহেতুক ইঁচড়ে পাকামো করে কি আর লাভ!
'কাঁঠল পাখি
আমার ভাইরে
বনোর বাঘে
খাইছে রে।'
কুটুম পাখি বা যে পাখিটিকে প্রমিত বাংলায় 'বউ কথা কও' বলা হয়, তাকে আমরা ছোটবেলায় কাঁঠাল পাখি বলে ডাকতাম আর এই ছড়াটিও শোনাতাম। কেন শোনাতাম, জানি না। কেই বা শিখিয়েছিল, মনে নেই। চৈত্র-বৈশাখে একটা গাছে অজস্র ছোট ছোট কাঁঠাল কুঁড়ি দিয়ে উঠলেও বেশিরভাগই আপনা হতে ঝরে পড়ে যায়। এমন অবস্থায় এক-দুটো কুঁড়িকে থিতু হতে দেখে আহ্লাদে আটখানা হতাম। হই-হুল্লোড়টাই বেশি হতো। খাওয়ার বেলা বড়জোর আট-দশ কোয়া। "তুমরার বয়সো একলা এক কাঁঠল খাই ফালাইদিতাম রেবা নাতি।" এই ডায়লগের ট্র্যাডিশনও সমান তালে চলছে। দাদুগোছের লোকজন সুযোগ পেলেই এমন ঢপ মারতেন। ব্যাপারটা ওই একটু "গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল"-এর মতো শোনালেও, অতদিন টিকে গেলে সুযোগ বুঝে আমিও এমন ডায়লগ ছাড়বো বলে ভেবে রেখেছি।
কাঁঠাল সামাজিক ফল। এই ফল একা খাওয়া যায় না। দিল্লিসহ উত্তর ভারতের লোক পাকা কাঁঠাল খাওয়া জানে না বললে খুব একটা ভুল হবে না। এতগুলো দিন হয়ে গেলো বাজারে পাকা কাঁঠাল বিকতে প্রায় দেখিনি বললেই চলে। বড়জোর সপ্তাহখানেক ঘরে রাখলেই পেকে যাবে, এমন কাঁঠালকে যখন বাজারে এঁচোড়রূপে বিক্রি হতে দেখি, তখন গা-পিত্তি জলে যায়। এরকম কাঁঠাল যারা বেচে, তাদের থেকে বড় অপরাধী যারা কিনে খায়। এমন নিষ্ঠুরতা সয় না, তাই অসময়ে বাজারের কোনো কোণে এঁচোড় বিক্রি হচ্ছে টের পেলে ওই পথ মাড়াই না আজকাল। দু'বছর আগে বাঙালিপ্রধান একটা বাজারে কাঁঠাল পেয়ে এটা জেনেও বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম যে এই সাইজের কাঁঠাল দু’জনের দ্বারা সাবাড় করা সম্ভব নয়। অগত্যা, মৌ অনেক যত্ন করে প্রথমবার কাঁঠালের পিঠে বানিয়েছে, নিজের অফিসে নিয়ে সহকর্মীদের খাইয়েছে যারা জীবনেও এমন কিছু খায়নি।
এই পিৎজা-বার্গারের যুগে কেন যে এই কাঁঠালের আমসত্ত্ব নিয়ে বসলাম, তা হয়তো ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। এককালে আমার একটা মৃদঙ্গ (খোল) ছিল, যা কাঁঠালের কাঠ দিয়ে বানানো। আজকে মনে পড়ছিল সেটার কথা। ছাদের একটা কোণে অবহেলার জীবন কাটাচ্ছে। বাড়ির পশ্চিমে একটা কাঁঠাল গাছ আছে, যার পাতার ডগায় দক্ষিণ-পশ্চিম হাওয়া হয়তো আজও গুনগুনিয়ে গায়। আমিই শুধু শুনতে পাই না, পাইনি গত এগারো বছর ধরে। তাইতো হয়তো কলমে স্মৃতিরম্যরা বাসা বাঁধে বার বার।
Comments
Post a Comment