প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
আজকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু যে ভাষায় আমি প্রথম কথা বলতে শিখেছি, সেই ভাষায় আজকাল আর বাড়িতে বা স্বভূমের আপনজনকে ফোন না করলে বলা হয় না। যার সাথে এক ছাদের তলায় থাকা, সেও বাঙালি; কিন্তু কথ্য ভাষাটা আমাদের এক নয়। ঘরে প্রমিত বাংলায় বাক্যালাপ করলেও আমার মায়ের ভাষা তো সিলেটি। তাই আজকের দিনটিতে একটু মন খুলে নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য আধঘন্টার পথ পেরিয়ে পিঙ্কিদিদের কাছে যাওয়া। বেশ কিছুদিন পরে নিজের ভাষায় কথা বলতে পেরে ভালোই লাগছিল। ফেরার পথে মাতৃভাষা নিয়েই কিছু টুকরো ঘটনা মনে পড়ায় কিপ্যাডে হাত দিলাম।
আমার মতো যারা প্রবাসে থাকে, তাদের কাছে মায়ের স্নেহমাখা ছোঁয়া, মাটির চেনা গন্ধ, "কিতা রেবা ভালা নি?"-র মতো আন্তরিক বাক্য বিনিময়ের অর্থটা যথেষ্ট দামি। কেননা ইচ্ছে হলেই যখন তখন এর কোনওটাই আমাদের কপালে জোটে না। অপেক্ষা করতে হয় দিন-মাস-বছর ব্যাপী। যাই হোক, আসল কথাটাতে ফিরে আসি। বিশ্বের যেকোনও প্রান্তেই এখন বাঙালির উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে শোনাটা বেশ ভাগ্যের ব্যাপার। বাইরে বেরিয়ে হঠাৎ করে কোনও সিলেটি মানুষের সাথে দেখা হয়ে গেলো, গত দশ বছরে এরকম আঙুলে গোনা অভিজ্ঞতাই আছে আমার। তার মধ্যে যে ক'টি মনে গেঁথে আছে, সেইগুলোই এখানে বলি।
২০১১-এর প্রথম দিকটা। মাস দুয়েক হলো এসেছি আমি। থেকে থেকেই মন খারাপ হচ্ছে। এরকমই একটা বিকেলবেলায় দিল্লির অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র অক্ষরধাম মন্দিরে ঘুরতে গেছি। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলাকে সিলেটিতে কথা বলতে শুনে নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এক-একটা দিন যখন কাটছিল না, তখন প্রায় দু'মাস পরে মায়ের ভাষায় কাউকে বলতে শুনে মন ভরে উঠেছিলো। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম "আফনে শিলচরর মানুষ নি?" আমাকে দেখেও খুব খুশি হলেন তিনি। মিনিট কয়েকের কথাবার্তায় বাড়িতে আসার আমন্ত্ৰণও জানালেন। রাস্তাঘাট কিছু চিনতাম না, তাছাড়া কাজের জন্য হন্য হয়ে ঘুরছিলাম। তাই আর ওনার সাথে দেখা করা হয়নি, কিন্তু ঘটনাটা আজও স্পষ্ট মনে আছে।
সেদিন মেট্রোতে করে যমুনা ব্যাঙ্ক স্টেশন পার করেছি, তখন একজন ভদ্রলোক পকেট থেকে ফোন বার করে বিশুদ্ধ সিলেটিতে কথা বলতে শুরু করে দিলেন। সেটা এতোটাই খাঁটি যে চর্চার অভাবে কয়েকটা শব্দ আমি প্রায় ভুলেই গেছি। চারটে স্টেশন পরেই আমার গন্তব্য, মিনিট দশেক আছে হাতে। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট দুয়েকের মাথায় তিনি ফোন রাখতেই জিজ্ঞেস করলাম "আফনে সিলেটি নি দাদা?" চোখে-মুখে প্রসন্নতা ফুটে উঠলো ওনার। বললেন "অয় অয়! বাড়ি কই তোমার?" ভদ্রলোক করিমগঞ্জের মানুষ, কয়েক মিনিটের বাৰ্তালাপে অভিভূত হলাম। আমি নামতে যাবো, তখনি বলে উঠলেন "ওবা হরু ভাই, আমি বাড়িত থনে কিছু শুঁটকি আনছিলাম। সময় করি একদিন আইও। খাইয়া যাইবায় আর লইয়াও যাইবায়।" ইঁদুরদৌড়ের জীবনে প্রতিনিয়ত কতকিছুই না হারিয়ে যাচ্ছে। আমি অভাগা আর যেতে পারিনি। ঘটনার কয়েক মাস পরে ফোনটা হারিয়ে যাওয়ায় আর দেখা হয়নি ওনার সাথে।
শেষ ঘটনাটা মাসখানেক আগের। সপ্তাহ অন্তে ব্যক্তিগত কাজে পুরোনো দিল্লি গিয়েছিলাম, সারাটা দিন ধকল গেছে। লালকেল্লা থেকে সোজা পথটা ধরে হনহন করে হাঁটছিলাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ঢুকছে মাত্র, স্ট্রিটলাইটের আলো জোরালো হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ফোন বাজলে স্ক্রিনে দেখলাম 'মা'। "বাইরে আছি গো মা, ঘরো গিয়া ফোন করিয়ার!"। ফোন পকেটে ঢোকাতেই কাঁধে কেউ একজন টোকা মারলো। পেছন ফিরে দেখলাম চশমা পরা একজন ভদ্রলোক। "বাড়ি কানো বা!" শুনে ক্লান্তিতেও মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ওনার নাম সুনাম উদ্দিন আহমদ, বাড়ি সোনাই। খানদানি কাপড়ের ব্যবসা, সতেরো বছর থেকে আছেন দিল্লিতে। বরাকের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে এনআরসি, অনেক বিষয়েই কথা হলো। ফোন নম্বর নিলেন, একদিন আসতে বললেন। হো-অ্যাপে যোগাযোগ আছে। ভাবছি একদিন যাওয়াই যাক তাহলে। মায়ের ভাষায় কথা বলা মানুষগুলোকে আর হারিয়ে লাভ নেই।
Comments
Post a Comment