মুখদর্শন

#মুখদর্শন

।।তৃণময় সেন।।
উবু হয়ে বসতে গেলে ধাতব জিনিসটার খোঁচা তলপেটে টের পেলো জিতেন। নদীপাড়ের দমকা হাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে সেতুর নিচে একটা কোণে বসে গাঁজার কলকেতে আগুন দিচ্ছে মিঠুয়া। গাঁজা জিনিসটা জিতেনের নাপসন্দ। তরল নেশা পেলে গলায় না হয় দু'ঢোক ঢালা যেত। একটু নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করে সে। নাহ, এগুলো পকেটে নিয়ে এইভাবে বসা যাবে না। চুড়িগুলো পকেট থেকে বের করে বাঁশের কঞ্চিতে ঝোলানো শার্টের মধ্যে টোপলা বেঁধে রেখে দেয়। বেশ মজবুত জিনিস; সুশীলা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। সোনা তো দূর তামা, পিতল এমনকি ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কাঁচের দু'গাছা চুড়িও সতেরো বছরের সাংসারিক জীবনে ক'বার কিনে দিয়েছে, মনে করতে পারে না সে। স্যাকরার দোকানে জীবনে মাত্র একবারই গেছে। তাও ছেলের জন্য। অমনের একটা কানে দুল পরিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে সুশীলা। মাত্র দু'দিনের জ্বরে মারা গেছিলো তার বড় ভাইটি মাত্র আট মাস বয়সে।
ঘড়ির কাঁটা তখনও রাত আটটা ছোঁয়নি। দূরে আলোর আভাস পাওয়া গেলেও ভারতবর্ষের দুই জনবহুল রাজ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী জয়প্রভা সেতুর বুকে জমে আছে অন্ধকারের ছোপ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরের আলোটা যেন তীব্রতর হচ্ছে। এ যেন কোনো অপার্থিব জগতে ধ্বংসযজ্ঞের হোমাগ্নির করাল শিখা। হাহাকার আর বিষাদে ভরা। আগুনের ফুলকির সাথে মহাকাশের গায়ে মিশে যাচ্ছে কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া। তারাগুলো দমবন্ধ হয়ে কোনোমতে মিটিমিটি জ্বলছে। সরকারি শ্মশানটা এখান থেকে কম করে হলেও মাইল খানেক দূরে, অথচ অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে ধীর পায়ে বুঝি এদিকেই এগিয়ে আসছে। জিতেন ঠিক টের পায় সব। ভোজপুরি গানের সুর আর গোটা তিনেক নেড়ি কুকুরের চ্যাঁচানোর আওয়াজ থেকে থেকেই ভেসে আসছে। দেশে মড়ক লেগেছে অথচ আশ্চর্য নির্লিপ্তের মতো কলকল বয়ে চলছে সরযূ নদী। নিস্তব্ধ চরাচরে গড়িমসি করে বয়ে চলছে সে।
আঁধার চোখে নদীর পানে চেয়ে থাকে জিতেন। বাড়ি যাওয়া হয়নি আজ তিনদিন হলো। দু’গাছা চুড়ি, একটা মানি ব্যাগসহ আড়াই হাজার টাকা ক্যাশ। রোজগার মন্দ হয়নি, তবে আর পারা যাচ্ছে না। প্রস্রাবের কটু ঝাঁঝ নাকে আসতেই ওয়াক চলে এলো। পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। প্রথম দু'দিন ডাল-রুটি জুটলেও আজকে এক ডজন কলা আর দু’প্যাকেট বিস্কুটের উপর কাটিয়েছে তারা। জিতু আর মিঠু, দুই অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু। সাইকেল চুরি থেকে শুরু করে বিড়ি খাওয়াতে হাতেখড়ি - একসাথেই হয়েছে। এককালে বস্তির দুই ডানপিটে ছেলে আজ প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়। সরযূ নদীর গা-ঘেষা চান্দিলা বস্তিতে তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করা দিনমজুর জিতেন দুষাদের দুই মহল্লা পরেই মিঠুয়া পাসির ঘর। ছিঁচকে চোর-পকেটমারের সাথে দালালির কাজ করে দিন চলে মিঠুর, বিয়ে-শাদি করেনি। চরম দুঃসময়ে রোজগারের এই খবরটা মিঠুই নিয়ে এসেছিল। কিছুদিন ধরে আধপেটা হয়ে না থাকলে এমন কাজে রাজি হতো না জিতু। প্রথম দিন নিজেকে খুব নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। কিন্তু কাজের শেষে চকচকে নোট দেখে মনটা ভালো হয়ে গেছিলো।
মশাগুলো হাত-পা চিবিয়ে খাওয়া সত্ত্বেও নাছোড়বান্দা ঘুমকে দমাতে পারছে না। গামছা পেতে বালির উপর গা এলিয়ে দিলো জিতু। অ্যাম্বুলেন্সের তীক্ষ্ণ শব্দে চোখ একান্ত না খুললে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য মিঠু তো আছেই। গাঁজার নেশায় মাথামুন্ডুবিহীন দুর্বোধ্য গান গেয়ে চলছে সে অবিরত। কোদাল-গাঁইতিগুলো একপাশে পড়ে আছে। প্রথম দু’দিনে প্রায় পনেরোটা লাশ পুঁতেছে। তারপর আর হিম্মত হয়নি, হাতদুটো টনটন করছিল। আঙুলগুলো এখনও অসাড় হয়ে আছে। অগত্যা চুক্তিতে কিছু হেরফের ঘটাতেই হলো। দিনে নামমাত্র জোড়াকয়েক লাশ নিয়ে আসা হবে আর বাকিগুলো অন্ধকার নামার পরে। যেহেতু জনবসতি জয়প্রভা সেতু থেকে কিছুটা দূরে আছে, তাই বেওয়ারিশ লাশগুলো সরযূর জলে ভাসিয়ে দেওয়া যাবে। হাত-পা ভালো করে বাঁধার জন্য ওরা কিছু পাটের রশির ব্যবস্থা করেছে। সাঁতারে দু’জন পটু হলেও গায়ের জোর মিঠুরই বেশি। তাই নিঃশব্দে মাঝগাঙে নিয়ে ফেলার দায়িত্বটা সেই নিয়েছে। কাছেপিঠে ভেসে উঠলে আবার মুশকিল। অন্তত রাতের আঁধারে প্রবহমান নদীর বেগে দুটো গ্রাম পেরিয়ে গেলে তারপর দোষটা আর নিজের ঘাড়ে থাকবে না।
মিঠু আর যাই বলুক না কেন, সকালে পেমেন্ট পেয়ে গেলেই সোজা বাড়িমুখো হওয়ার কথা ভেবেই রেখেছে জিতু। কোমর অবধি জল পর্যন্ত শেষ লাশটা এগিয়ে দিয়ে হাঁপাতে থাকে সে। দুইজন সমবয়সী, কিন্তু সে নিজে কেমন যেন একটু বেশিই বুড়িয়ে গেছে। এইবারের সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই বয়স্ক মানুষ ছিল, তাই ওজনটাও বেশি। একবার জলে নামিয়ে নিলে আর ততোটা জোর লাগাতে হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেক গাড়ি আসবে, কি জানি এইবারে ভাগ্যে ক'টা লাশ টানা লেখা আছে! মাঝ নদী থেকে নিঃশব্দে পাড়ে উঠে আসে মিঠু। পরনে জাঙ্গিয়া ছাড়া কিছু নেই আর। মিঠু বলে, এদের পরিবারের কাছে শেষকৃত্য সম্পন্ন করার টাকা না থাকায় কর্তৃপক্ষ এই পথ বেছে নিয়েছে। তিন-চার হাজারের কাজে নূন্যতম কুড়ি হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে, তারপরেও শ্মশান-কবরে চলছে ওয়েটিং লিস্ট। তাছাড়া ওদের কাছে এখন কাজের মানুষের অভাব। মৃত্যুর হার যেইভাবে বাড়ছে, তা গুটিকয়েক সাফাই কর্মচারীর দ্বারা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। মিঠুর কথা বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। টাকাটা কি তাকে সত্যিই অর্ধেক দিচ্ছে, তাও সে জানে না। সাদা রঙের একটা গাড়ির গ্লাস নামার পর কাগজে মোড়া পলিথিনের থলের ভিতরে ঠিক কত টাকা ছিল সেটা শুধু অনুমানই করতে পারে জিতু।
একটু ধাতস্ত হওয়ার আগেই গাড়ির শব্দ শুনে কান পাতে দুই বন্ধু। শব্দ শুনে নিজেদের গাড়ি চিনতে ভুল হয় না। এখান থেকে হাসপাতাল খুব একটা দূরে নয়, তার উপরে এই সময়ে রাস্তাও ফাঁকা। রাত নিশ্চয় এগারোটা থেকে কম হবে না। গুটিগুটি পায়ে সেতুর ঠিক নিচে এসে দাঁড়ায় তারা। আগে টর্চ দিয়ে সিগন্যাল দিতে হবে। অন্ধকার চিরে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সটি। ইশারা পেতেই তিনজন লোক অনেক কসরত করে মোট পাঁচখানা লাশ থপ-থপ করে ফেলে গাড়ির পেছন দিকটা বন্ধ করে দেয়। এইবার তাড়াতড়ি হাত চালাতে হবে। অভিজ্ঞ হাতে হাত-পা বেঁধে ফেলে জিতু। কারও পকেটে কানাকড়ি নেই। একজনের কোমর থেকে বেল্ট খুলে একটা পাশে রেখে দেয় মিঠু। বাকি একজন মেয়েলোক আর কমবয়সী ছেলে দুটোর পরনে হাফ-প্যান্ট থাকায় আর খোঁজাখুঁজি করতে যায় না তারা। একে একে মাঝ নদীতে লাশ চালান দেয় মিঠু। শেষটা ভাসিয়ে দিতে পারলে আজকের জন্য কাজ শেষ। ওজন কম তাই কাঁধে করে কিশোরটাকে নিয়ে জল ভেঙে এগিয়ে চলে জিতু। ওদিক থেকে মিঠু এগিয়ে আসছে। পিঠের দিকে ধাতব কিছুর তীব্র খোঁচা টের পায় সে। লাশ না নামিয়েই বাম হাত দিয়ে পিছন দিকটাতে হাতড়াতে থাকে। হাতটা সঠিক জায়গায় পৌঁছালে নিমিষেই দুহাতের মধ্যে লাশটাকে নেয় সে। অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার পর দৃষ্টি অনেকটাই উজ্জ্বল হয়ে গেছে। একমুঠো ফুলকি শ্মশান থেকে আকাশপানে উঠে এসে মনের সব শঙ্কা মিটিয়ে দেয়। কানের দুলটা জিতুর বুড়ো আঙুলে গেঁথে গেছে, আরও জোরে চেপে ধরলে আঙুল থেকে রক্ত বেরিয়ে মিশে যায় সরযূর জলে। আবছা আলোয় কিছুই টের পায় না মিঠু। সাঁতরে এসে একপ্রকার ক্ষিপ্রতার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে গভীর জলে টেনে নিয়ে যায় কিশোরের দেহটাকে।
ফিরে এসে জিতুকে না দেখে একটু অবাক হয় মিঠু। এতো কম সময়ে শালা গেলো কোথায়! পয়সা না নিয়েই পালালো! পোটলাটা তো বাঁশের কঞ্চিতে ঝুলছে এখনও! কিছু না বুঝতে পেরে এইবার হাঁক পাড়ে সে....জিতু..আবে ও জিতু! অরে কহাঁ ভাগ গয়া রে হারামি! প্যায়সে তো লে জাতা! জিতু...

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন