কোভিডনামা
সব ইয়াদ রকখা জায়েগা।
সব কুছ ইয়াদ রকখা জায়েগা।।
আমির আজিজের এই কবিতার পরিচিত লাইনগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপে বারবার ভাইরাল হলেও, আদতে আমরা কিছুই মনে রাখি না। ভুলে যাওয়ার কথা উঠলে আমাদের চরিত্র 'গজনী' মুভির আমির খানের মতোই। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেশব্যাপী অপরিকল্পিত লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা চিত্রপটে এতোটাই ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে যে পরপর পাঁচটা রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও, দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিষয়গুলোর এতটুকুও প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। যেমন প্রজা তেমনই রাজা। তাই যে দেশে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-লিঙ্গবৈষম্য-বেকারত্ব আরও অনেক জ্বলন্ত সমস্যার বদলে হিন্দু-মুসলিম, মন্দির-মসজিদই নির্বাচনের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে সরকারকে সব দোষের নন্দ ঘোষ বানানোটাও অযৌক্তিক।
করোনার মতো কিছু একটা গত বছরেই আমার হয়েছে। খুব ভয়ও পেয়েছিলাম। তখন হাজার চেষ্টা করেও টেস্ট করাতে পারিনি। প্রায় দুই মাস ভোগার পর নিজে থেকেই সুস্থ হয়েছি। এবারের অবস্থা গতবারের চেয়েও ভয়ংকর। খবরে-সোশ্যাল মিডিয়ায় আইসিইউ বেড, অক্সিজেন সিলিন্ডার, প্লাজমা, রেমডিভিসির ইনজেকশনের জন্য হাহাকার দেখে শিউরে উঠছি। কাঙালের মতো চার-পাঁচটা হাসপাতাল খুঁজে আপনজনের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারা অসহায় লোকজনের আর্তনাদ বড় হৃদয় বিদারক। কিন্তু এবার আর ভয় হচ্ছে না। কেননা যে দেশে এই চরম দুর্দিনেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হওয়ায় মানুষ মানুষের মৃত্যুতে উল্লাস ব্যক্ত করছে, সেখানে আর বেঁচে আছি কই! মহামারীর প্রবল ঝুঁকি রাজনৈতিক সমাবেশ, কুম্ভমেলাকে দমাতে পারেনি। সেকেন্ড ওয়েভের সকল সম্ভাবনাকে তুচ্ছ করে নির্বাচনজীবীরা নিজ নিজ দলকে জেতাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পুরোদমে। কোভিড প্রোটোকল ততদিনে শিঁকেয় উঠেছে। মাস্ক-স্যানিটাইজারের মতো বেসিক সুরক্ষাবিধি মেনে চলার মতো বিলাসিতা কেউই দেখাননি। যার ফলস্বরূপ আজ সারা দেশে কোভিড পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। কুম্ভমেলার দায়িত্বে থাকা ডাক্তারসহ মোট পঁয়ষট্টি জন স্বাস্থকর্মী করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছেন।
টোল-ফ্রি নম্বরে মিসড কল করে রাজনৈতিক দলের সদস্যতা হাসিল করতে পারার দেশে সরকারি কোভিড হেল্পলাইনে বারবার কল করেও সাড়া না পাওয়ার অভিযোগ আজকাল অনেকেই করছেন। যে সেনার উদাহরণ দিয়ে বুক ফুলিয়ে শক্তিমান সাজা হয়, সেই সেনাবাহিনীর এক জওয়ান দিল্লিতে গুরুতর অসুস্থ স্ত্রীকে গাড়িতে করে নিয়ে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে ঘুরে বেডের ব্যবস্থা করতে পারছেন না। "মাত্র দুই ঘন্টার অক্সিজেন বাকি আছে। শীঘ্রই কোনো ব্যবস্থা না হলে আমাদের রোগীদের চোখের সামনে মরতে দিতে হবে।" বলে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন সিনিয়র ডাক্তার। দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের ডাক্তার মনীশ জঙরা নিজে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লেও হাসপাতালে বেড জোটেনি। বাজারে অক্সিজেন-জীবনদায়ী ইনজেকশনের কালোবাজারি চলছে। জীবিতকে মৃত আর মৃতকে জীবিত ঘোষণা করার বেশ কয়েকটা ঘটনা ইতিমধ্যেই নজরে এসেছে। মরে গিয়েও শান্তি নেই। শ্মশানেও চলছে ওয়েট লিস্ট। কাঁড়িকাঁড়ি টাকা ঢালার পর শেষকৃত্য সম্পন্ন হচ্ছে। ওদিকে অক্সিজেন সাপ্লাই নিয়ে পরস্পরের উপর দোষারোপ করার সাথে নিজের তরফে 'সব চাঙ্গা সি'-র কায়দায় টুইট করে চলছেন রাজ্য-কেন্দ্রের শাসকরা। ভাগ্যিস এক্ষেত্রে রোগ বা ঔষধের নাম পরিবর্তন করে কোনো লাভ হবে না। তা না হলে এতক্ষণে রেমডিভিসিরের নাম বদল করে রাম-দেবা-ভাই টাইপের কিছু একটা রেখে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েই দিতেন যোগিজি।
গত সপ্তাহে যেদিন মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল সগর্বে ঘোষণা করলেন, যে দিল্লীতে টেস্টিং অন্যান্য রাজ্য থেকে বেশি হচ্ছে ঠিক সেদিন বিকেল থেকেই মৌয়ের শরীরটা ভালো ছিল না। খবর পেলাম যে বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরের মেট্রো স্টেশনে এখন আর টেস্টিং হচ্ছে না। রেপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করানোর জন্য যে মোবাইল ভ্যানটা অলি-গলিতে একপ্রকার জোর করে টেস্ট করাতো, সেটাও বেপাত্তা। অথচ লক্ষণ দেখামাত্র টেস্ট করানোর জন্য সকাল-বিকাল দু'বার করে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। অতএব সরকারি ডিসপেনসারিই শেষ ভরসা। পরের দিন যখন সেখানে পৌঁছলাম, তখন সকাল নয়টা বাজে। গেট থেকে শুরু হয়েছে লাইন যার শেষটা দেখতে মিনিট দুয়েক হাঁটতে হলো। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে এখানে RT-PCR টেস্টের জন্য রোজ মাত্র একশোটা স্যাম্পল নেওয়া হয়। তার জন্য আধার কার্ড নিয়ে আসতে হবে। এলাকার বাইরের রোগী যাতে প্রবেশ করতে না পারেন, তাই এই ব্যবস্থা। কাগজপত্র যাচাই করার পর লাইনে দাঁড়ানো প্রথম একশো জন টোকেন পান। কিন্তু আমি তো ভিন রাজ্যের নাগরিক তাই রেন্ট এগ্রিমেন্টের সাথে বিদ্যুতের বিলও নিয়ে আসার আদেশ হলো। গেট সকাল নয়টায় খোলে। দু'ঘন্টা আগে না আসলে প্রথম একশোতে যে স্থান হবে না তা লাইন দেখে একপ্রকার নিশ্চিত হয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীর দাবির নিগূঢ় অর্থ বুঝতে আর বাকি রইলো না।
তার পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় ডিসপেনসারির লাইনে যোগদান করলে নয়টার পরে আমাদের নম্বর বাহান্ন আর তেপান্ন ধার্য করা হলো। কমবয়সী কয়েকজন পুলিশকর্মী টেস্ট করানোর কারণ জিজ্ঞেস করে টোকেন দিচ্ছেন। টেস্ট করাতে গেলে লক্ষণ থাকাটা আবশ্যক। আমাদের খুব হালকা লক্ষণ ছিল। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা লাইনে দাঁড়ানোর পরে টেস্ট হলো। ইতিমধ্যে একজন স্করপিয়বাহী ভদ্রলোক (!) নিজের পরিবার সহ এসে কোনো লাইন ছাড়াই টেস্ট করিয়ে গেছেন। ভেতরে যেতে যেতে সেই বাহান্ন-তেপান্ন বাষট্টি-তেষট্টিতে পরিণত হলো। সোয়াব দেওয়ার পরে আমাদের বলা হলো যে রিপোর্ট বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে আসবে। সেই বাহাত্তর ঘন্টা আজকে সেঞ্চুরি পুরো করেছে। রিপোর্ট আসেনি। এতক্ষণে আমরাও পুরোপুরি সুস্থ। মৌ শুধু স্বাদ-গন্ধ পাচ্ছে না এই যা। সরকারি হাসপাতালে দাখিল হতে গেলে কাগজেপত্রে করোনা পজিটিভ থাকাটা বাধ্যতামূলক। আর মারাত্মকভাবে অসুস্থ রোগীর কাছে বাহাত্তর ঘন্টা জীবন-মরণের নির্ণায়ক, সেটা বলাই বাহুল্য। হিসাবটা এখন এমন দাঁড়াচ্ছে যে হয় রোগ খাল্লাস না হয় রোগী। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ক্ষেত্রে প্রথমটাই কার্যকর হয়েছে আর সেই 'বাহাত্তর' সেঞ্চুরি করার পরে ইনিংসটা শেষ করবে নাকি অপরাজিত থেকে যাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
Comments
Post a Comment