বরফের চাঁই

বরফের চাঁই



টপ্.... টপ্.... টপ্!
শেষ রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে জোরালো হয় জল পড়ার শব্দ। রামশরণের দু'কান খাড়া হয়ে ওঠে। বরফগুলো আবার গলে যাচ্ছে না তো!
খুচরো বাজারে এক একটা চাঁই প্রায় তিনশো টাকায় যাবে। যা পেল্লায় সাইজের, তাতে এই গরমে দু’ঘন্টায় অন্ততঃ পাঁচশো টাকা রোজগারের গ্যারেন্টি লিখে দিতে পারে রামশরণ। বাজার এখান থেকে বেশি দূরে নয়। রিক্সা করে বাজারে নিয়ে যেতে পারলে কতই না ভালো হতো। হাত নিশপিশ করে রামশরণের।
ব্যবসায়ী চোখ বলে কথা! যেখানেই যায় না কেন তক্কে তক্কে থাকে রামশরণ। ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা বলতে গেলে জীবন থেকে স্রেফ নয় বছর বাদ দিলেই হলো। কোন ব্যবসাটা করেনি সে! শীতের সন্ধ্যায় ভুট্টা, চীনাবাদাম তো গরম পড়লে বরফের চাঁই, কালোজাম, আঁখের কারবার করে জীবন কেটেছে তার। শ্রাদ্ধ-বিয়ে-পড়াশোনায় ঘামে ভেজা টাকাগুলো না ভেসে গেলে হয়তো একদিন বড় ব্যবসায়ী হতে পারতো। কিন্তু পুরানো দিনগুলোর কথা ভেবে মন খারাপ করে না রামশরণ। মেয়ে দীপ্তি পড়াশোনাতে ভালো। টিউশন শুরু করে ভাইদের পড়াশোনার খরচ বের করে নিচ্ছে। ক'মাস পরে আঠারোতে পা দিলে নয়ডার কোনো প্রাইভেট কোম্পানিতে কিছু একটা কাজ পেয়েই যাবে।
হাঁপানির কষ্টটাকে ভুলে গেলে বরফের ব্যবসা তার অন্যতম প্রিয়। খুব দ্রুত মুনাফা লাভের ক্ষেত্রে এই ব্যবসার জুড়ি মেলা ভার। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে কমপক্ষে চারমাস যমুনাপাড়ের বস্তিটিতে এই জিনিসটার চাহিদা আকাশছোঁয়া থাকে। "মুর্দাঘর কা মাল" বলে এটার একটু আধটু বদনাম থাকলেও গরিব মানুষ এইসব গায়ে মাখে না। আধহাত লম্বা ছুঁচানো রডের আঘাতে টুকরো করে, হাতের আন্দাজে দশ-বিশ টাকার বরফ বিক্রি করে রামশরণ। পলিথিনের ব্যাগে করে নিয়ে জলের কলসি-জগে ভরে কলজে ঠাণ্ডা করে মেহনতি মানুষগুলো। কোনোদিন একটু আধটু থেকে গেলেও অসুবিধা নেই। কল সেন্টারে কাজ করা মেসের ছেলেরা সারাটা দিন নিজেকে নিংড়ে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কুলারের জল ঠান্ডা করার জন্য সস্তায় বরফ কিনে নিয়ে যায় তার কাছ থেকে।
গরমের দিনগুলোতে দুপুরবেলার শুরুয়াত হয়ে যায় বেলা আটটা বাজতেই। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দেখা দেয় না বিকেল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাত দুটো গলে যায় অথচ মাথার ওপর উগ্র সূর্যদেব। খুকখুক কাশির সাথে শ্বাসকষ্টে গলার ভেতরে শোঁ শোঁ শব্দে বাঁশি বাজে রামশরণের। গলায়, হাতে বাঁধা কবচ তাবিজগুলোর অলৌকিকতা প্রতিবারই মুখ থুবড়ে পড়ে। সর্বনাশা মহামারী এই বছর রামশরণদের মতো অনেককেই পথে বসিয়েছে। অসুস্থতার কারণে লক ডাউনের সপ্তাহদিন আগে থেকে বিছানার পড়ে গিয়েছিল রামশরণ। যক্ষ্মা তখনও ধরা পড়েনি। টপটপ বরফ গলা জলের আওয়াজে চাপা পড়ে তার দীর্ঘশ্বাস।
পুরানো দিল্লি, যমুনা পাড়ের জনবহুল বস্তিগুলো মেট্রো সিটির মসৃণ গায়ে যেন অবাঞ্ছিত তাপ্পির মতো সেঁটে আছে। ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা যাতে বাড়ি ফেরার জন্য সামাজিক দূরত্ব ভেঙে দলে দলে ভিড় না করে, সেইজন্য প্রতিটি বস্তির মোড়ে পুলিশ মোতায়েন করেছে সরকার। পথে-ঘাটে পড়ে মারা গিয়ে সরকারকে কম বদনাম করেনি এরা!
শরীরটা প্রায় টেনে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে শিবম। ভাইকে দেখে তাড়াতাড়ি ভেজা চটের বস্তার টুকরো থেকে পেঁচানো বোতল খুলে শিবমের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দেয় দীপ্তি। চার কিলোমিটারের পথ আজকে দু-দু'বার অতিক্রম করেও কোনো লাভ হয়নি। ওকে দেখে ঘরে ঢুকে গেলেও দূর থেকে কান পেতে সব জানার বড় আগ্রহ প্রতিবেশীদের। উৎসাহী চোখগুলো জানালা, গ্রিলের ওপার থেকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রামশরণের ঘরের দিকে। দুপুরের রুটি দুটো যাবার পথেই হজম হয়ে গেছে। শিবমের বাড়ন্ত শরীরে চাগাড় দিয়ে ওঠা ক্ষিদে বারবার করে পেটে মোচড় দিচ্ছে। সারাটা দিন গেলো মা বিছানা ছাড়েনি। খাবার কিছু আছে নাকি, দিদিকে জিজ্ঞেস করতে গেলে শুষ্ক গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না তার। এইবেলাও হাসপাতালে গিয়ে প্রায় ঘন্টা তিনেক বসে কোনো কাজ হলো না। রোজ সত্তর-আশিটা টেস্টের জন্য অনুমোদন পেয়েছে এই সেন্টার। আর দৈনিক টেস্ট করার নির্ধারিত সংখ্যা নাকি আজকের মতো অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। মৃতদেহ টেস্টের তুলনায় করোনা আক্রান্ত সন্দেহে ক্রমবর্ধমান রোগীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। আসলে রামশরণের মতো মানুষ বাঁচলো কি মরলো, তা নিয়ে আদৌ কারও কিছুই যায় আসে না। কাল সকালবেলা আবার এসে খোঁজ নিতে বলে দিলো ওরা।
লাশ পেয়ে গেলে তারপর শ্মশানে নেওয়ার কী ব্যবস্থা, বাপকে কি একবার বাড়ি নিতে পারবে, টেস্ট হয়ে গেলে রিপোর্ট কবে আসবে কিছুই জানে না ষোলো বছরের শিবম। শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে চায় শেষবারের মতো।
জল পড়ার টপ টপ শব্দটা আরও দ্রুত হয়েছে। না, শব্দটা একটু দূর থেকেই আসছে। নিজের আইস ট্রে কয়েকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয় রামশরণ। দু'দিন আগে যখন এখানে ওকে নিয়ে আসা হলো, তখনই ঘরে খাদ্য সামগ্রী বাড়ন্ত। আরেকটা রুটির জন্য ছোট ছেলেটা মায়ের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছিল। হাসপাতালে ওকে নিয়ে যাওয়া-আসা করার জন্য কারও কাছ থেকে নিশ্চয়ই ধার নিতে হয়েছে। সন্তান-সন্ততির জন্য কিছুই আর রেখে যেতে পারেনি রামশরণ। যাত্রাপথের এই দুই চাঁই বরফই শুধু রয়েছে ওর কাছে, যা আজকের এই দুঃসময়ে বিক্রি করতে পারলে হয়তো পরিবারের জন্য দু'বেলার খাবার জোটাতে পারতো। তাই টপ টপ শব্দে ভয় কাটে না রামশরণের। বরফটা বুঝি গলে জল হয়ে গেল। ভেসে গেলো ঠিক তার জীবনের মতো।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন