নিয়তির গণ্ডি
মার্ মার্ ইস হারামি কো.... ব-হ-ন-চ-দ।
বলতে বলতে গলা ধরে এলো পওয়নের। চোখ দুটো টসটস করছে। কাঁধের গামছার ভাঁজ ভেঙে চোখ মোছে সে।
-- আবে ও কুত্তো..... ইয়াহাঁ আকর মারপিট কর রহে হো!! টাঙ্গে তোড় দি জায়েগী সব কি।
জেলার সাহেবের শাসানিতে আবেগে দম ধরায় সন্তোষ। গোড়ালি ঘষে যাওয়া প্লাস্টিকের জুতো চিন্টুর গা থেকে নামিয়ে নেয়। দশক পুরানো বন্ধু পওয়নকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে থাকে। চিন্টু এখানে আসার পর থেকে ঘাড় সোজা করেনি। অপরাধ স্বীকার করা বশত লোহার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে সমানে পা খুটখুট করে যাচ্ছে। ঢং ঢং আওয়াজ রাতের খাবার সময়ের জানান দেয়। সারা দিনের দাবদাহ শেষে সামান্য আগেই সন্ধ্যা সেরেছে তিহার (সেন্ট্রাল জেল, দিল্লি), ঘড়িতে ঠিক সাড়ে সাতটা বাজে।
মাত্র দু'দিন আগে ঘটনার সুত্রপাত হয়েছিল পওয়নের হাত ধরেই। একুশ দিন বাদে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ভেবে খোরা কলোনির দশ নম্বর মকানটিতে দিন গুনছিল সে। শুধু গুটখার তাড়নায় একদিন ঘর থেকে বেরোলে পুলিশ ধাওয়া দিয়েছে। শুরুর দিনগুলোতে দাল-তড়কা, বেঙন ভর্তা, লিট্টি বানিয়ে সন্তোষ ও তার ভাগ্নে চিন্টুকে খাইয়েছে পওয়ন। কিন্তু একুশদিন বাদেও যখন লক ডাউন খুললো না, উল্টে করোনা পজিটিভ কেস পেয়ে সাত নম্বর গলি সিল হয়ে গেলো, তখন মনে মনে প্রমাদ গুনলো সে। ততদিনে পকেট হালকা হয়ে গেছে। হুশ হবার পর থেকে কোনদিনই বিনা কাজে ঘরে বসেনি। ক্লান্ত মনে ধীরে ধীরে ছেয়ে যেতে লাগলো দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। এই লক ডাউন কি আর খুলবে না, খাবে কী আর বাড়িতে পাঠাবেই বা কী, মা-ভাইয়ের সাথে কি আর দেখা হবে কোনোদিন। আচ্ছা, করোনাতে মরে গেলে তার লাশখানি কি বাড়ি পাঠাবে সরকার! মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় পওয়নের।
এনএইচ টুয়েন্টি ফোরের গা ঘেঁষা ঘিঞ্জি কলোনি খোরাতে প্রায় দু-লক্ষ লোকের বাস। রিকশাচালক, দিনমজুর, বড়বড় কোম্পানির নিরাপত্তারক্ষী, নয়ডার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করা দিহাড়ী মজদুরের সিংহভাগের ঠিকানা এই খোরা কলোনি। জেলা গাজিয়াবাদ হলেও তার কিছুটা অংশ দিল্লির ময়ূর বিহারে গিয়ে শেষ হয়েছে। কন্ট্রাক্টারদের সাথে চুক্তি বা দিনভিত্তিক কাজ না থাকলে ঘরের অদূরে দিনমজুরদের সাথে লেবার চৌকের বটগাছটির তলায় বসে বিড়ি ফুঁকতো পওয়ন। তার নিত্যসঙ্গী ছোট্ট থলেতে হাতুড়ি, স্ক্রু-ড্রাইভার, কাঠপেন্সিল, পরিমাপের ফিতা, কয়েক সাইজের লোহা আর নীল রঙের তারে পেঁচানো একটা পুরানো ড্রিল মেশিন পড়ে থাকে হামেশা।
জুতো-সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ, কোনো কাজে মানা নেই। পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই দিনমজুর সমান দক্ষতার সাথে সব কাজ উতরে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঘর বাঁধার ইচ্ছে কোনোদিনই ছিল না পওয়নের। কিশোর বয়সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল নিরুদ্দেশের পানে। বিহারের সিওয়ান থেকে বারো কিলোমিটার দূরের গ্রামের বাড়িতে বুড়ো মাকে নিয়ে থাকে বিকলাঙ্গ ভাইটি। পিছুটান বলতে ব্যাস এইটুকুই। দেওয়ালে ঝোলানো থলেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পওয়ন।
ময়ূর বিহার ফেজ-থ্রি, খিচড়ীপুরের সাপ্তাহিক বাজার লক ডাউনের শুরু থেকেই বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। হাজারবার জবাবদিহি করে দু-একদিন বাজারের একটা কোণে বসে কোনো লাভ হয়নি দেখে এখন গলি-গলিতে হাঁক পেড়ে সবজি বিক্রি শুরু করেছে সন্তোষ। এক জায়গায় বসে তীর্থের কাকের মতো পথ দেখার চেয়ে এটা ঢের ভালো। যদিও টোটোওয়ালা, রিকশাওয়ালা সবাই পেটের দায়ে আজকাল সবজি বিক্রি করছে, তাছাড়া বেশিরভাগ লোক আজকাল আলু-পেঁয়াজ অনলাইনেই কিনে নিচ্ছে। তপ্ত দিনগুলোতে বেশি পরিশ্রমে আয় কম তার ওপর ভাড়া দেবার জন্য ওই ঘাটের মরা মালিক বুড়োর ঘ্যানঘ্যানানি আর ভাল্লাগে না।
পরিযায়ীদের ঘরে ফেরার ইশতেহার এসেছে। যারা খিদের তাড়নায় প্রাণভয়কে তুচ্ছ করে পায়ে হেঁটে ফেরার রাস্তা ধরেনি, এখনো আধপেটা হয়ে বেঁচে আছে; তাদের জন্য সরকার বাহাদুর কৃপা করে রেল পরিষেবা শুরু করছেন। সময়ের একটু হেরফের হলেও আগামী পরশু দিন থেকে আবার চিরপরিচিত পথে দৌড়াবে আনন্দ বিহার টু পাটনা। কমিশন ছাড়া তালিকাতে নাম না আসার গুজব সন্তোষেরও কান মলে গেছে। তাই বন্ধু, ভাগ্নে সহ নিগম পর্ষদের কাছে নাম ও প্রমাণপত্রের সাথে হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে এসেছে সে।
এনএইচ টোয়েন্টি ফোরের ওপারে শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংসের বিশাল আড়ত। 'গাজীপুর মন্ডি' নামে পরিচিত আড়তটিতে হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মালপত্র আসে। পচা-গলা শাক-সবজি, মুরগি-পাঁঠার বোঁটকা গন্ধে একটা নিজস্বতা আছে গাজীপুর মন্ডির। যমুনার কালো জল, অশোক নগরের নালা, গাজীপুর মন্ডির গন্ধ থেকে আলাদা। কেউ চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও শুধু গন্ধ বিচারে চিরপরিচিত মন্ডিকে ঠিক চিনতে পারবে পোড়খাওয়া সন্তোষ। এখান থেকে মাইলখানেক দূরে আবর্জনার জমা পাহাড়। চিল-শকুনের অবাধ বিচরণভূমি এই পাহাড়টা মহানগরের যাবতীয় চাকচিক্যের অহংকারকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। তার বিষমাখা ছোঁয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে বিষণ্ণতার ধূসর-কালো রঙ যেন ভেংচি কাটছে নগর যাপনকে।
করোনার ভয়ে আধপেটা মজদুরেরা বাড়ি চলে যাওয়ায় মন্ডিতে খুব অসুবিধা হচ্ছে মহাজনদের। দু-একজন শ্রমিক দিয়ে এতো কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। দোকানের সামনে খুচরো বিক্রেতাদের লম্বা লাইন। ভাগ্নেকে সাথে নিয়ে আসলে কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না। একে তো এইসব জিনিস জীবনে ঘাঁটেনি, তার ওপর সর্বক্ষণ কানে হেডফোন গুঁজে বিড়বিড় করে কথা বলা চিন্টুর কোনো কিছুতে মন নেই, তা বেশ ক’দিন ধরে লক্ষ্য করছে সন্তোষ। টেম্পোতে মাল লোড-আনলোড করা বেশ ঝক্কির কাজ। বিনা পয়সায় এইভাবে কি কাউকে সাথে নিয়ে আসা যায়! এতদিন থেকে ঘরে বসে থাকা পওয়ন, সন্তোষের মনের কথা বুঝতে পেরে নিজেই সাথে যাবার আগ্রহ দেখালে মন ভালো হয়ে যায় সন্তোষের। বয়সে কয়েক বছরের তফাৎ থাকলেও, অনেকদিনের গাঢ় বন্ধুত্ব দুজনের। সন্তোষকে সন্মান দিয়ে চলে পওয়ন, আধাজ্বলা বিড়ি এগিয়ে দিলে হাত বাড়িয়ে নিতে আজও উশখুশ করে সে।
সকাল আটটায় সবজি মন্ডিতে বিশাল লম্বা লাইন দেখে চোখ কপালে ওঠে সন্তোষের। আরও সকালবেলা আসতে হতো, আজকে দুই-আড়াই ঘন্টার আগে কোনো কাজ হবার নয়! লাইনে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরায় সন্তোষ। দরকারে ফোন করতে বলে পায়ে পায়ে মন্ডি ঘুরে দেখতে সরে পড়ে পওয়ন।
বোঝাই ট্রাক থেকে উচ্ছে, ফুলকপি, গোল বেগুন নামাচ্ছে লোকজন। আরেকটু এগোতে কাঁচালংকার ঢের, নাক সুড়সুড়িয়ে কয়েকটা হাঁচি দিল পওয়ান। আশেপাশে কেউ না থাকায় বাঁচা গেছে, হাঁচলে বা কাশলে আজকাল লোকে শ্রাদ্ধ করার জন্য মরার অপেক্ষা করে না। জাল বাঁধানো টেম্পোগুলোর পেছনদিকটাতে গুচ্ছের ব্রয়লার মুরগি। ভরা দুর্গন্ধে অনেকটা সরে গিয়ে পথের ধারে দাঁড়ায় পওয়ন। রাস্তার ওপারে নানা উচ্চতার গা-ঘেঁষা বিল্ডিংগুলোর বেশিরভাগের বাইরের দিকটায় প্লাস্টার নেই। ইঁটগুলো যেন পওয়নের দিকে গুটখা খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসছে। "রাজধানী হোটেল" বিল্ডিংটির নিচে অনেক লোকের জটলা দেখে আশ্চর্য হয় পওয়ন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় তার কাছে। ভিড়টা মদের দোকানের। তাহলে কি মদের দোকান খুলেছে লক ডাউনে? আরেকটু এগিয়ে ব্যাপারটা ঝালিয়ে দেখে পওয়ন। এখানের লাইন মন্ডির লাইনকেও হার মানাবে। তবে লাইন দ্রুত চলছে, করোনা সংক্রমণ আর গা জ্বালানো রোদকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে আধ ঘন্টায় বিজয় নিশ্চিত। জায়গাটা কাগজপত্রে দিল্লিতে পড়ায় ভিড় আরও বেশি। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানাতে একে তো জিনিসটা খাঁটি পাওয়া যায় না, তার ওপর দামও অনেক বেশি। যদিও দিল্লির বাইরে অনুমতি ছাড়া মদ নিয়ে যাওয়া বেআইনি, কিন্তু এইসব ব্যাপারে ঝানু লোকেরা রাস্তা খুঁজে বের করেই নেয়। পওয়ন জানে এই ভিড়ের বেশিরভাগ মাথা গাজিয়াবাদের।
-- এক কাম কর দোগে ভাইয়া?
মেরুন রঙের চারচাকাটি কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায়নি পওয়ন। গ্লাস নামাতেই একমুঠো ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা মুখে লাগে তার। চাপদাড়ি মুখখানির দু’চোখ কালো সানগ্লাসে ঢাকা। ভারী কন্ঠের প্রস্তাবটি মন্দ ঠেকেনি পওয়নের। কিন্তু কাজটা করতে তো সময় লাগবে, ওদিকে সন্তোষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মিনিট ভেবে নিয়ে সম্মতিতে মাথা নাড়ায় সে।
কয়েকবার এদিক-ওদিক চেয়ে পওয়নকে ফোন করতে হয়েছে সন্তোষের। দুবার ফোন করার পরে কোত্থেকে হনুমানের মতো লাফিয়ে এসেছে পওয়ন। হুড়োহুড়িতে একপ্রকার একাই পঞ্চাশ কেজির বস্তাগুলো টেম্পোতে তুলে দেয়। পওয়নের হাবভাবে ভ্রূ কুঁচকায় সন্তোষ। কিসের এতো তাড়াহুড়ো, কোথা থেকেই বা হন্তদন্ত হয়ে আসছে! মালসহ তাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে দ্রুতপায়ে আবার উধাও হয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে আনলোড করতে আবার চিন্টুর সাহায্য নিতে হলো সন্তোষকে।
সূর্যাস্তের লালিমা মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে জ্বলে উঠছে স্ট্রিটলাইটগুলো। এক-দুটো গাড়ি দুরন্ত গতিতে বেয়ে যাচ্ছে মহাসড়কের মসৃণ পথ। মাঝেমাঝে মাথায় বোঁচকা নিয়ে পা-চলা লোকগুলো রাত-দিনের আবর্তনকে তাচ্ছিল্য করে গন্তব্যের পথে হারিয়ে যাচ্ছে। শহরের তাপমাত্রা রোজ বাড়ছে, সিলিং ফ্যানটির শব্দ বেশি হাওয়া কম। রোজদিনের মতো আজও কানে হেডফোন গুঁজে ঘরের কোণে বসে আছে চিন্টু। বিড়বিড়ানির সাথে মাঝে মাঝে তার চেহারার খুশি, গম্ভীরতা, লজ্জা কিছুই চোখ এড়ায় না সন্তোষের। বাপ মরা ছেলে কিছু একটা করলে নিজের বোনটির পেটে দুবেলা দানা-পানি পড়বে ভেবে, বছর তিনেক আগে চিন্টুকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিল মামা সন্তোষ। দৌড়ঝাঁপ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে দিয়েছে। লোকাল ক্যাবের কোম্পানিতে চাকরি ধরিয়ে দিয়েছে। নয়ডা ভিত্তিক এমএনসি কোম্পানিতে সকাল-বিকাল ক্যাব চালায় চিন্টু। কোম্পানি থেকে পিএফ-ইএসআই সবকিছুই দিচ্ছে, কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে ক্যাব বন্ধ। গতমাসে অর্ধেক বেতন দিলেও এই মাসে কিছুই পায়নি চিন্টু। বড় শহরে এসে বেশ চালাক চতুর হয়ে গেলেও ভাগ্নের কার্যকলাপ বড্ড চোখে লাগছে সন্তোষের।
ফেজ থ্রি-র অলিগলি ঘুরে বাড়ি ফেরত ক্লান্ত সন্তোষের তন্দ্রা ভাঙলো দরজা খোলার শব্দে। শার্টের ছেঁড়া পকেট, উস্কোখুস্কো চুল অথচ চোখ দুটো থেকে যেন অনাবিল প্রশান্তি উছলে পড়ছে পওয়নের। মুঠো হাত খুলে দেয় সন্তোষের কাছে। অনেকদিন পরে ক'টা টাকা রোজগার করতে পারার খুশি তার শুকনো মুখে। দুটো-পাঁচশো, কয়েকটি পঞ্চাশ-একশো টাকার নোট। অপ্রত্যাশিত সকালের বিস্তারিত বর্ণনা দেয় সে সন্তোষকে। ঘটনার আকস্মিকতায় কানের হেডফোন খুলে ফেলেছে চিন্টু।
সারা দিন মদের দোকানের বাইরে লাইন দিচ্ছিল পওয়ন। ক্ষুধা-তৃষ্ণা কিছুই একটি বারের জন্য দমাতে পারেনি তাকে। শ-দু’শো করে নিয়েছে গ্রাহকদের কাছ থেকে। কমিশন সহ বোতলের দাম নিয়ে আধ-পৌনে ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পছন্দ অনুযায়ী মদ গ্রাহকের হাতে তুলে দেবার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল সে। তার মাঝে উত্তম-মধ্যম পিঠে পড়লেও কুছ পরোয়া নেহি, নিজের কাজ গুরুত্ব সহকারে সম্পন্ন করেছে। দিন বাড়ার সাথে সাথে ভিড় বাড়তে থাকায় কিছুটা কষ্ট হয়েছে বৈকি, কিন্তু রোজগারের এই সুযোগটুকু হাতছাড়া করতে মোটেই রাজি ছিল না পওয়ন। একদিনে এতগুলো টাকা জীবনেও কামাই করতে পারেনি সে। হতভম্ব হয়ে পুরো ঘটনা হজম করে মামা-ভাগ্নে।
মদ খাওয়াটাকে সারা জীবন ঘৃণার চোখেই দেখে গেলো মানুষ। সেটা কত পুণ্যের ব্যাপার, আজকে এতক্ষণ লাইনে না দাঁড়ালে জানতেই পারতো না পওয়ন। অর্থনীতিকে নাকি এরাই বাঁচাবে! দেশের স্বার্থে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দলে দলে লোক আসছিল। একজন তো ধুপ-ধুনো নিয়ে এসে সবাইকে কপালে তিলক পরিয়ে দিলো - বুক ফুলিয়ে সন্তোষকে বীরগাথা শোনায় পওয়ন।
স্নান-টান সেরে পাড়ার একমাত্র খোলা দোকান থেকে এক পোয়া পনির নিয়ে এসেছে পওয়ন। অনেকদিন হলো ভালো-মন্দ কিছু খাওয়া হয়নি। জম্পেশ করে শাহী পনির মসালা বানাবে আজকে। হেডফোনটা বারমুডার পকেটে ঢুকিয়ে, থপ থপ করে ছাদ থেকে নেমে এসেছে চিন্টু। আড়চোখে চিন্টুকে একবার দেখে পনির সাইজ করতে লেগে যায় পওয়ন। মামু বলে ডাকলেও ছোঁড়াটাকে মোটেই পছন্দ করে না সে। সব কিছুতেই একটা সবজান্তা ভাব। সন্তোষের সাথে অনেকদিনের পরিচিতি, তাছাড়া বয়সে বড় সন্তোষকে সম্ভ্রম করায় কিছু বলে না পওয়ন।
--মামু, এক মস্ত জুগাড় সোচা হ্যাঁয় হামনে, বাতায়ে কা?
যে চিন্টু আজকাল বিশেষ একটা কথাবার্তা বলছে না, তার অতর্কিত কথায় জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠে দু’জোড়া চোখ। গড়গড়িয়ে তার দুর্ধর্ষ ইরাদার কথা দুই মামাকে শোনায় চিন্টু। শিক্ষিত মানুষ দূরদর্শীও হয় বটে। অমন নিখুঁত পরিকল্পনার কথা সন্তোষের মতো আদ্যিকালের বুড়োরা ভাবতেও পারবে না। দু’জনের মনে সন্মান অর্জন করতে মাত্র দু’মিনিট সময় লাগে চিন্টুর। টি-শার্টের কলার উঁচিয়ে, পায়ের ওপর পা তুলে জমিদারের ভঙ্গিতে বসে অভিনব অভিপ্রায়টি মাতুলদ্বয়কে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলে চিন্টু।
ব্যাপারটা শুনতে খুব আকর্ষণীয় হলেও বিপদের সম্ভাবনাটাও নেহাত কম নয় বলে, প্রথমে খারিজ করে দিয়েছিল সন্তোষ। পুলিশ ধরতে পারলে সোজা হাজতবাস। কিন্তু বিছানার তলায় তো মাত্র হাজার চারেক টাকা আছে। বাড়ি ফিরে কোনো কাজ কর্ম ছাড়া পাঁচজনের পরিবার বেশিদিন চলবে না এই টাকায়। চিন্টুর বলা প্ল্যানটি অতোটাও খারাপ নয়, শুধু একটু রিস্ক আছে এই যা। কয়েক ঘন্টা দোলাচলে ভুগে খেতে বসে মনের কথা বলেই ফেললো সে।
-- “বাকি সব তো ঠিক হ্যাঁয়, পর ইতনে প্যায়সে আয়েঙ্গে কাহাঁ সে ইয়ে জরা বাতাইয়ো বাবুয়া?”
সন্তোষের এই প্রশ্নে মুষড়ে যাওয়া চিন্টুর চোখমুখ আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গরম তরকারিতে রুটির টুকরো গলে গেলো তার। ঢকঢক করে জল গেলে চিন্টু।
পেটিএম অ্যাকাউন্টে এগারো হাজার টাকা ইতিমধ্যেই এসে গেছে। সবার হাত-পকেট ঝেড়েঝুড়ে দিয়ে দিলেও টাকা দু-হাজার কম পড়ছে। দু’দিন বাদে তো বাড়ি চলেই যাচ্ছে, কবে আসা হবে কে জানে! তাই চিন্টু গ্যাস সিলিন্ডার বেচে দেবার প্রস্তাব দিলে নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় সন্তোষ-পওয়ন।
বড়লোকের সাথে জানাশোনা থাকলে এইরকমই হয়, নিজেকে বেশ একটা সম্মানিত ব্যক্তিত্ব মনে হয় চিন্টুর। অফিসের স্যারজীদের অনেক টাকা বেতন। এইরকম একটা অফার দিলে সামান্য টাকার চিন্তা যে ওরা করবে না তা আলবাত জানতো চিন্টু। কিন্তু তাই বলে এতোগুলো অর্ডার আর অ্যাডভান্স টাকা পেয়ে যাবে তা কল্পনাতে আসেনি। উত্তরপ্রদেশের শহর নয়ডাতে বসে দিল্লির মদ পাওয়া, তাও এই করোনাকালে! হোম ডেলিভারির অফার এমএনসিতে কাজ করা লম্বা বেতনের কর্মচারীরা লুফে নিয়েছে। রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বেরিয়ে লেবার চৌক পর্যন্ত গেলেই হলো। অর্ডার নিয়ে আশেপাশে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকবে চিন্টু। নয়ডা থেকে দিল্লিতে মদের দাম অনেক কম, তাই বোতল অনুযায়ী চিন্টুকে একটু বেশি কমিশন দিতে হলেও কোনো প্রবলেম নেই। অনেকেই হোয়াটসঅ্যাপে সুরাপ্রেমী বন্ধুদেরও সুখবরটি জানিয়েছেন, অ্যাডভান্স পেমেন্টের জন্য সাথে ফরওয়ার্ড করে রেখেছেন চিন্টুর পেটিএম নম্বরটিও।
ফ্যানের শব্দের সাথে চিন্টুর অস্পষ্ট ফিসফিসানি ঠিক টের পাচ্ছে সন্তোষ। কোথায় তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কথা ছিল, কিন্তু ছেলেটার এতো রাতেও শান্তি নেই! বাড়ি যাবার পথে একে বোঝাতে হবে, না হলে শহরের হাওয়া একদিন কোথায় উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে টেরও পাবে না।
প্ল্যানমাফিক সকাল ছ'টায় বেরিয়ে পড়ে তিনজন। মন্ডি থেকে বড় প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছুটা সবজি নিয়ে রাখবে সন্তোষ যাতে বোতলগুলো সবজি দিয়ে ভালো মতন ঢেকে রাখা যায়। আর মদের দোকানে চিন্টু আর পওয়ন অর্ডার অনুযায়ী মাল কিনবে। কয়েকবার লাইনে দাঁড়াতে হবে, অর্ডার তো আর কম নয়। দশটা বাজবার আগে সব কাজ হয়ে যাওয়ার কথা, পুলিশ বা ভিড় দুটোই বেলা হলে আসে।
তাড়াতাড়ি করে কিছু আধপচা ভেন্ডি-মুলি-টিন্ডা ভরে চলে এসেছে সন্তোষ। চিন্টুরা মদের বোতল নিয়ে আসতেই ঝোপের কোণে বসে ভালোমতন বস্তাবন্দি করে সে। কেউ নজর রাখছে না তো! ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে নিচ্ছে বারবার। হোয়াটসঅ্যাপ থেকে চাহিদানুযায়ী নাম দেখে দেখে মদ কিনছে চিন্টু। কিছু কঠিন নাম পড়তে না পেরে কাউন্টারের লোকটির হাতে ফোন ধরিয়ে দিচ্ছে।
হিসেবমতো হাতে আড়াই হাজার টাকা আসবে, গতকালকের সাড়ে তেরোশোর সাথে আড়াই হাজার যোগ করলে কত দাঁড়ায়! লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিসেব কষে যাচ্ছে পওয়ন। আগামীকাল এমন সময় ট্রেন কানপুর হয়তো ছাড়িয়ে যাবে। তারপর ইলাহাবাদ, মুঘলসরাই, পাটনা পরেই তো কাটিহার জংশন। তেজিয়াল সূর্যের দিকে চেয়ে বেলা বুঝবার উপায় নেই। ঝোপের আড়ালে বসে ঢোক গেলে সন্তোষ।
টেম্পো থেকে নেমে যখন অতি সন্তর্পণে তিনটে বস্তা কাঁধ থেকে ওরা নামালো, তখন পৌনে দশটা বাজে। ফ্যানের রেগুলেটর দুবার মুচড়ে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে চিন্টু। আজকে আর ফোনে কথা বলা হয়নি, ফেরার পথে নম্বর ডায়াল করলে নিজে থেকেই কেটে গেলো।
দশ টাকায় এক-টুকরো বরফ নিয়ে এসে লেবুর শরবত বানাচ্ছে পওয়ন। আর চাপের কিছু নেই, বাকিটা চিন্টু দেখে নেবে। খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে জিনিসপত্র গোছাতে হবে। সকালবেলার ট্রেন, সাত-আট কিলোমিটারের দূরত্ব পায়ে পায়েই ডিঙোতে হবে। সামান্য জিরিয়ে নিয়ে উঠে বসে সন্তোষ। অন্ততঃ হাজারখানেক মালিক বুড়োর হাতে দিয়ে যেতে হবে, গত মাসের ভাড়াও দেওয়া হয়নি। কিছুই না দিয়ে গেলে চিৎকারে পাড়া মাথায় তুলবে বুড়ো। কথাটা ভাবতেই দরজায় কড়া নাড়ার ক্ষিপ্রতায় মুখ দিয়ে গালি বেরিয়ে যায় সন্তোষের। এতো বুঝিয়ে বলেও কোনো লাভ হয়নি তাহলে ।
দরজা খুলতেই পায়ের তলার মাটি সরে যায় সন্তোষের। দুজন লাঠিওয়ালা পুলিশের পেছনে দাঁড়ানো ইন্সপেক্টরের কাঁধে চকচক করছে রুপোলি তারা।
-- সন্তোস ইয়াদব তেরা নাম হ্যাঁয়?
-- জি-ই-ই স্যর।
শেষরক্ষা বুঝি আর হলো না; এবার পারলে মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যাবে সন্তোষ।
--আপ অ্যায়সে হমারে ঘর মে নহি ঘুস সকতে।
এক ধাক্কায় কয়েক হাত দূরে রাখা সরবতের গ্লাসের ওপরে গিয়ে পড়ে চিন্টু। ফাঁকা গ্লাসের ঝনঝনানিতে তার সাময়িক প্রতিবাদ ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। বিছানার পাশে বের করে রাখা নানা সাইজের পানীয়ের বোতলগুলো সব ঘটনার সাক্ষ্য দেয় নিঃশব্দে। উঠে দাঁড়াতেই বাম গালে সপাটে চড় খেল চিন্টু। বোতল হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কি একটা খুঁজে দেখছে ইন্সপেক্টর। এতগুলো বছর থেকে যে গলিতে কাটালো সেই গলির উৎসুক চোখগুলো যেন আজ গিলে ফেলতে চাইছে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, এখনই বুঝি সব দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসবে সন্তোষ। থানায় নিয়ে যাবার জন্য সন্তোষদের হাত বাঁধার প্রয়োজন মনে করেনি কনস্টেবলরা। কয়েকমিনিট যন্ত্রের মতো হেঁটে মাথা নিচু করে পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়লো ওরা তিনজন।
মামার হাতে জুতো-পেটা খাওয়ার পর গরম জলের মতো ডালে একটা রুটি ভিজিয়ে খেয়েছে চিন্টু। বিপরীত দিকের কোণাতে বসে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে দু’জনকে। যা হবার হয়ে গেছে, আত্মগ্লানিতে ভুগে কোনো লাভ নেই আর। এতো সাবধানতা নিয়ে কাজটা করে তীরে এসে তরী ডোবাতে যদিও সে খুব হতাশ, তবুও খবরটা পুলিশের কাছে কেমন করে গেলো হাজার ভেবেও কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছে না চিন্টু।
সন্তোষের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে পওয়ন। পেটে খিদে থাকলেও আজ মুখে খাবার তুলতে পারেনি তারা। সর্বস্ব খোয়া গেছে; তাই মারধর না করে যদি এখানেই ফেলে রাখে, তাহলে দু’বেলা অন্ততঃ পেটে খাবার পড়বে। এই দুর্দিনে শুধু প্রাণে বাঁচাটাই সবচেয়ে বড় পওয়নের কাছে। শক্ত কাঠের ওপর গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে সে।
সাত-আট ঘন্টা পরে ট্রেন ছাড়বে। গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা সন্তোষের দু’চোখে শেষবার বাড়ি ফেরার স্মৃতি ভাসে। ওর ছোট গ্রাম মনিহারি, আমবাগান আর বাচ্চা দুটোর মুখ মনে পড়তেই কুঠুরির আবছা আলোতে ডুকরে ওঠে সে।
ফোন রিং করতেই সহকর্মী থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে ফোন তোলে ব্রজেশ। ফোনটা আসবে আগে থেকেই জানতো। অনলাইন শপিং সাইটে পেমেন্ট করার লিংক অনেক আগেই এসেছে তার কাছে। মেয়েটা সত্যিই যাদু জানে, ওর দৌলতে আজ অনেকদিন পর গলা ভেজানো যাবে বিলেতী মদে। কথাটা ভাবলেই সারা দিনের পরিশ্রম দূর হয়ে যাচ্ছে নিমেষে। একটু ফ্রি হলেই পেমেন্ট করছে বলে মিনিট দুইয়ের বাৰ্তালাপ শেষ করে আবার কাজে মন দেয় দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ বর্ডারে কর্মরত কনস্টেবল ব্রজেশ তোমার।
ছোড়াটাকে রেখে কাজের কাজ কিচ্ছু হতো না। কিছু দেবার বেলায় নেই অথচ কথা বলার বেলায় সারাদিন এক পায়ে খাড়া থাকতো সালা। আগে ফোনে একটু-আধটু রিচার্জ-টিচার্জ করে দিতো; কিন্তু প্রায় দু-মাস থেকে বেতন বন্ধ, টাকা নেই বলে দোহাই দিয়ে আসছিল। আর সহ্য হচ্ছিল না কম্মোর। অবশেষে এক ঢিলে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়! পুলিশে কাজ করা মক্কেলটাকে দিয়ে ধরিয়ে ওই আপদের হাত থেকেও মুক্তি হলো সাথে নিজেরও পকেট ভরলো।
"ইওর অর্ডার হ্যাজ বিন প্লেসড সাকসেসফুলি!"
বিপ শব্দে ম্যাসেজটা আসতেই মনটা নেচে উঠলো। যাই হোক পুলিশকর্মীটি কথা রেখেছে, এবার নিশ্চিন্তে ঘুম হবে। ফোনের বিশেষ অ্যাপটা ডিসেবল করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো কম্মো ওরফে কামিনী ওরফে আলিগড়ের কমলেশ ত্যাগী।
Comments
Post a Comment