তাজই

তাজই
।।তৃণময় সেন।।
ও তাজই...তাজই। আমার সুপারি ওগুইন লইয়া বাজারো যাইবে নি রে বেটা! মঙ্গলবারে লইয়া যাইমু ময়নাদ্দা, আইজ মজুনদারবাবুর বাড়িত যাইয়ার মাছ মারাত আর লগে ঠেলাও আনছিনা। শীর্ণকায় দেহে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোয় তাজই। বয়সটা পঁয়তাল্লিশ থেকে বেশি না হলেও অধিক পরিশ্রমের ফলে দূর থেকে দেখলে পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় বলেই মনে হয়। বামহাত দিয়ে কাঁধে মাছ ধরার জালটা ধরে রেখেছে আর ডান হাতের বিড়ি এতটাই ছোট হয়ে এসেছে দেখলে মনে হবে আগুন এই বুঝি আঙ্গুলদুটো চুমলো। পেশাগতভাবে তাজই জেলে কিন্তু যখন যা কাজ পায় সবই করে। এই যেমন পালবাবুর বাড়িতে শিমগাছে বাঁশের কঞ্চি কেটে ঝাড় লাগিয়ে দেওয়া, মাস্টারবাবুর বাড়িতে নারিকেল গাছ থেকে নারিকেল পেড়ে দেওয়া কোনও কাজেই মানা নেই তাজইয়ের। যদিও এককালে একটা নৌকা ছিল তাজইদের। ওর বাবা ফজর আলী নৌকা চালাত রানীঘাটে, সাথে ছায়ার মতন সবসময় থাকতো তাজই। যখন থেকে ফজর আলী জানতে পেরেছিলো যে রানীঘাটের উপরে সেতু হবে তখন থেকেই ছেলেকে বলতো "এলকু আর নাও চালাইয়া লাভ নাইরে বাপ, তোরে জাল এখান কিনিয়া দেই.. মাছ মারা হিক।" জলের দিকে চেয়ে কথা বললেও আব্বার জলভরা চোখ দুটো টসটস করে উঠতো তা ঠিক ঠাহর করতে পারত তাজই। নাতিটার চেহারাতে কেমন একটা আব্বার চেহারার ছাপ আছে। ওর বৌ বলে, কিতা যে মাত তুমি,. আব আট মাসর নেনা রইছে ইগুতা আর দেইখতে বলে আব্বাজানর লাখান। যদিও ছলমা বিবি শ্বশুরকে দেখে নাই। তাজই নাতিকে কোলে নিয়ে দোল খাওয়ায় আর "নাতি তুমার হড়ির বিয়া টেঙ্গা দিয়ে রেবা" বলে হো হো করে হেসে উঠে।
ভেউয়ারপার গ্রামের ওই পাড়ায় সবারই প্রায় একইধরনের জীবনযাপন। কেউ রিকশাচালক তো কেউ দিনমজুর। তাজই সকালবেলা উঠেই বেরিয়ে পরে পাশের হিন্দুপ্রধান গ্রাম সোনাপুরের উদ্দেশ্যে। ওখানে সবাই তাজইকে ভালোবাসে, কাজ দেয়। নগ্নপায়ে পথ যেতে যেতে দরাজ গলায় গান ধরে তাজই "ও আমার দরদী আজ জানলে, আজ জানলে, তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না..." ওর বাবা অনেক গান জানতো, কিন্তু তাজই মাত্র দু-একটাই মনে করতে পারে। গতবছর হারাংনদীর বন্যার তোড়ে ওর বাড়ির সামনে ইএন্ডির বাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো আবার বর্ষাকাল আসতে চলছে কিন্তু এখনও তেমনিই পড়ে আছে। মাস্টারবাবুর কাছে মনের ক্ষোভ উগরে দেয় তাজই। বুজছইন্ নি মাস্টারবু, বুট আইলেই হক্কলটিরে দেখা যায় আর অউ অতো দিন থনে পথ ওখান ভাঙি রইসে কুনগুর খবর নাই... আর জানইননি, ইন্দিরা আবাসও আমার নাম গেছিল, মেম্বরে কয় টেকা পাঁচ হাজার দিতে লাগবো বুলে। কিছুক্ষন থেমে আবার অনুনয়ের সুরে বলে ,ও মাস্টারবু....মাস্টারবু.. এখান দরখাস লেখিয়া দেইননা আমরার পথ ওখানতার লাগি, আমরা গাউর হকলে নাহয় টিপ দিয়া যেন লাগে লইয়া গিয়া জমা করমু।
চৈত্র মাসের শেষে আজ সাতদিন হল অঝোরে ঝরছে আকাশ। বৃষ্টির বড়বড় ফোঁটা দেখে সরকারি বিলের পাশে গা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপে তাজই।অনেক বেলা হয়ে এসেছে কিন্তু আকাশের দিকে দেখে তা বোঝার উপায় নাই। তাজই সময়টা হিসেব করতে থাকে। দিনটা আজকে মোটেই ভালো না। সকাল থেকেই আকাশটা গুমোট হয়ে আছে। তাতে আবার পুলিশবাবুর সাথে দেখা। বারীন্দ্র মন্ডলের চাকরি থেকে অবসর হবার এতো দিন হয়ে গেলেও পুরানো অভ্যেসটা যায়নি এখনও। ওবা তাজই, পুকইরপাড় ওখান বেড়া দিয়া দে টেকা একশ দিমুনে। একগাল শুকনো হাসি হেসে তাজই বলে, একশ টেকায় কিলা করমু। জেগা তো এক্কেবারে ছুটো নায়। ঝাড় থনে বাঁশ কাটিয়া বেড়া দিতে দুইদিন লাগিজাইব বাবু। বারীন্দ্র বলে, তে আস্তে আস্তে কয়েকদিনে করিয়া দিছ। টেকা এর থাকি বেশি দেওয়া যাইত নায়। আর তুমরা বেটাইন নদীত ফাঁসজাল দিয়া যে খেচিয়া মাছ মারয়ার অতা যে বেআইনি জাননি! আমি থাকায় করতায় পাররায় না হইলে টের পাইলায়নে। ঠিক আছে বাবু কাইল থনে কাম ও লাগমুনে বলে বিলমুখো রওয়ানা হয় তাজই। বিড়ি জ্বালিয়ে গুনগুনিয়ে গান ধরে “আল্লাহ তুমার দুনিয়ায় কিছিম কিছিম আদম তুমি বানাইলায়।“ যখন খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরোলো তখন ছোট্ট নাতিটা জ্বরে কাঁপছিলো। ব্লাড টেস্ট করানোর হপ্তাখানেক হয়ে গেল, রিপোর্ট আসেনি এখনও। বাবু নাকি ছুটিতে বাড়ি গেছেন আর হাসপাতাল ছাড়া বাইরে গিয়ে করাবে তার জন্য টাকা নেই ওর কাছে। নাতির ব্যাপারে জানানো হলেও রাস্তা বন্ধ থাকায় ছেলেটা মেঘালয় থেকে ফিরতে পারছেনা। বৃষ্টির বেগ একটু কমলেও আজকে আর ভাল্লাগছেনা, জালটা কাঁধে নিয়ে বাড়িমুখো হয় তাজই। একটু এগিয়ে যেতেই চাওয়ালা মতিন ওকে দেখে সাইকেল থামিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, তুমার বাড়িত কিতা অইসে বা চাচা, সকাল সকাল কান্দাকান্দি হুনলাম। কথার উত্তর না দিয়ে দৌড়ে চলে তাজই। বাড়ি ঢুকতেই কান্নার রোলটা আরও বেড়ে যায়। পুবদিকের ঘরে ঢুকেই নাতির বুকে হাত রাখে তাজই। অনেকক্ষন ভিজে কুঁচকে যাওয়া ওর হাত থেকেও ঠান্ডা ছোট্ট শরীরটা। পা পিছলে পড়ে যাওয়ার পর নদীরপাড় থেকে যখন আব্বাকে নিয়ে এসেছিলো, কিছু পথ আসার পর আব্বার শরীরটা তেমনই ঠান্ডা হয়ে গেছিল। পায়ের আঙুলে তীব্র একটা ব্যাথা অনুভব করে তাজই, হালকা আলোয় কালো রক্ত দেখতে পায়, কবে যে কেটে গেছে নিজেই বুজতে পারেনি। পাশের বাড়ির রেডিও থেকে আব্বার প্রিয় একটা গান ভেসে আসে.. হাঁমুখ তাজই শুনতে পায়... "আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে... অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাই রে..."

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন