অনাহুত বসন্ত
।।তৃণময় সেন।।
দ্যা নম্বর ইউ আর ট্রায়িং টু কল..... কয়েক ঘন্টার মধ্যে এই নিয়ে মোট পাঁচবার বিফল চেষ্টা করলো চন্দ্রা। ওপার থেকে ধমক খেতে হবে জেনেও কিছুক্ষণ পর পরই হাতটা ফোনের দিকে চলে যাচ্ছে। "এইভাবে যখন তখন ফোন তোলা যায় না, তাই আমি কখনো ফোন না ধরলে মিছেমিছি ব্যস্ত হয়ো না। একটু সময় পেলে নিজেই ফোন করব।" পইপই করে বুঝিয়ে বলে রাখা স্বামীর কথাগুলি ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল চন্দ্রা, কিন্তু কোনোদিনই তো ফোনের জন্য এতোটা সময় অপেক্ষা করতে হয়নি! তাছাড়া ভোরবেলা ফোন করে সায়নকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে ওর বাবা। ঘুমচোখে তেমন কিছু আবদার করতে না পারায় দুপুরবেলা বাবাকে কল করলে ওই একই আইভিআর মেসেজ বাজছিল। তারপরে তিন ঘন্টা কেটে গেছে... বিয়ের নয় বছর হয়ে গেলেও ভয় কাটেনি চন্দ্রার, একটু কিছুতেই দুঃশ্চিন্তার মেঘ জমে ওঠে মনে! সেইদিন আকাশপাতাল ভেবে ভেবে ঝিমুনিভাব আসতেই পাশের বাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিল বড় ভাসুরের মেয়ে। কাঁপা হাতে রিমোট নিয়েছিল চন্দ্রা।
মা...ওমা.. ফোন তুলছ না কেন..বেজে যাচ্ছে যে! ছেলের আওয়াজ অতীতের পাতা থেকে বর্তমানে নিয়ে নিয়ে আসল চন্দ্রাকে। পাকা ছেলের মতো নিজেই এগিয়ে এসে ফোন বাড়িয়ে দিল সায়ন।
--আর কতক্ষণ লাগবে বৌদি, স্যার এসে গেছেন তো!
হালকা বিরক্তির ছোঁয়া অনুভব করে চন্দ্রা।
--এই তো বেরোচ্ছি দাদা, সায়ন কিছুক্ষণ আগেই স্কুল থেকে ফিরল।
--তাড়াতাড়ি আসুন, ওনার আবার সাড়ে পাঁচটার ফ্লাইট। কয়েকমাস পরেই তো ইলেকশান, স্যার ভীষণ ব্যস্ত আছেন আজকাল। আশা করি বুঝতেই পারছেন।
ফোন রেখে নিজেকে আয়নায় দেখে নেয় চন্দ্রা। নীল-বাদামি শাড়িতে খারাপ লাগছে না ওকে। নিজে বেলা দু'টো থেকেই তৈরি হয়ে বসে ছেলের অপেক্ষা করছিল। আজকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি, পুলওয়ামা হামলার প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে চন্দ্রা-সায়নই মুখ্য অতিথি। সেই আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় যে চল্লিশজন সেনা জওয়ান শহীদ হয়েছিলেন, সায়নের বাবা তাঁদেরই একজন। বসন্তের মিষ্টি হাওয়া দুপুর থেকেই গুনগুন করে বইছে। শুকনো পাতার খসখস শব্দ শেষবেলার নিস্তব্ধতাকে বাধা দিচ্ছে অবিরত। ধীরে ধীরে কচি চিকন পাতা নবীনতা ছড়িয়ে দেবে প্রকৃতির প্রতিটি গ্রন্থিতে। কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া বা পলাশ-শিমুলের ফাগুন রাঙিয়ে তুলবে ব্যাকুল হৃদয়কে। দরজায় তালা দিতে গিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ছবিটিতে না চাইতেও চোখ যায় চন্দ্রার। রোজ শাড়ির আঁচলে মোছা বাঁধানো ছবিখানি বড় জীবন্ত লাগছে। একমুঠো দমকা হাওয়া পথ হারিয়ে ঘরে ঢুকলে ছবির গলায় ছোটছোট শঙ্খ দিয়ে বাঁধানো মালাখানি আলতো করে দুলে ওঠে। মায়ের হাত ধরে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সায়ন। ঘড়িতে তখন ঠিক সোয়া তিনটা বাজে।
Comments
Post a Comment