শুভদিনের_আবাহনে

।।তৃণময় সেন।।
সবুজ..লাল...সবুজ..লাল..
মুঠো ফোনে সাদিকের নম্বর বারবার ডায়াল করেই আবার কেটে দিচ্ছে আরমান আলী। মানসিক দূরত্ব আজকাল কিছুটা কমে গেলেও সরাসরি শুধু তর্কই হয়েছে, কথা বলা হয়ে ওঠেনি। মাস ছয়েক আগেই ইঁটভাটার পাশে আধ-বিঘা জমি বিক্রি নিয়ে বিস্তর কথা কাটাকাটি হয়েছে চাচা-ভাতিজাতে। ইঁটভাটার মালিক ভালো দাম দিতে রাজি হলেও, অনুর্বর জমিটুকু বেচতে সাফ মানা করে দিয়েছে একগুঁয়ে আরমান ।
সারা জীবন দুই ভাইয়ে জমির বিবাদ করে আরমানের বড় ভাই আশরাফ তিন বছর হল ইন্তেকাল করেছে। প্রতি বর্ষাতে জমি নিয়ে তুমুল বিবাদ গ্রাম্য মাতব্বরের গন্ডি ছাড়িয়ে থানা-পুলিশ অবধি গড়ানো স্বাভাবিক ছিল আরমানদের পরিবারে। জীবনে উপার্জনের অন্ততঃ চারআনা মামলা-মোকদ্দমা করে খুইয়েছে দু’ভাই। আশরাফের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। ছেলে সাদিক চাচার সাথে বৃথা তর্কে সহজে জড়াতে চায় না, কাপড়ের ছোট দোকান নিয়েই সুখে দিন যাপন করতে ভালোবাসে সে। সবই ঠিক চলছিল তার জীবনে, বাঁধ সাধল লক ডাউন! বড়বাজার থেকে মাল আনতে গিয়ে আজ সাতাশ দিন হলো দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বাড়িতে দিন গুনছে। পথ-ঘাট কবে খুলবে কেউ বলতে পারে না।
কিছু জিজ্ঞেস না করেই বৌয়ের কাছ থেকে রোজ ওবাড়ির খবর পায় আরমান। সাদিকের সাড়ে তিন বছরের মেয়েটি গুটিগুটি করে দাদাজির পেছনে ঘুরঘুর করে, এই পরিবারেই চলে তার নাওয়া-খাওয়া। সারা জীবন দুই পরিবারে কাজিয়া করল অথচ বাচ্চাটার কি অগাধ ভালোবাসা, প্রতিবেশীরা অবাক চোখে সাক্ষী হয় এই বিবর্তনের। বেরোলেই তার জন্যে লজেন্স, কুরকুরে নিয়ে আসে আরমান। মাত্র আট মাসের মধ্যে দুটো মেয়ে বিয়ে দিয়েছে সে, হাতে টাকাকড়ি বিশেষ নেই। বেঙ্গালুরুতে থাকা ছেলে গাড়ি চালায়, সুস্থ আছে কিন্তু আগামী ক'মাস টাকা পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বাপকে। গত বছরের ধান বিক্রি করে চলছে পরিবার। সামনের সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে মাহে রমজান। দুটো মেয়ের বাড়ি ইফতারি পাঠাতে গেলে অনেক খরচ আছে। অলস দুপুরে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আবার সবুজ বোতামে চাপ দিল আরমান...
-- হ্যালো
-- তুমার চাচা কইয়ার রেবা.. মরির (নায়েব) ব্যাটার লগে মাত অইছে। টেকা কিছু আডভান্স দিবা। আমি লইলাইতাম নি, না তুমি আইলে...
--জি সালামালাইকুম! আফনে লইলাইন, আমি আইতে সময় লাগব।
--আইচ্ছা, সাবধানে থাকিও।
বিনা শব্দ ব্যয়ে ফোন কেটে দেয় আরমান। ঊষর জমিটুকু বিনা কাজে ফেলে রাখার কোনো অর্থ ছিল না, সব জেনে বুঝে অভ্যাসগতভাবে সাদিকের বিরোধিতা করে এসেছে এতদিন। মহামারীর এই দুর্দিনে টিকে থাকার তাগিদ মনের বন্ধ জানলা আপনা হতেই খুলে দিয়েছে। হাজার কিলোমিটার ব্যবধান থেকে আজকের কয়েক সেকেন্ডের বাক্য বিনিময় যেন বহু বছরের দূরত্বকে কোনো অদৃশ্য জাদুকাঠির ছোঁয়ায় মুছে দিয়ে গেছে। একমুখ দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় আরমানের ললাটে প্রশস্তির আভা। নারিকেল গাছের নিচে একমনে খেলা করছে ছোট্ট নাতনি। সরল চোখে তার পানে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সে।
************
একদিকে এতদিন থেকে গাড়ি বন্ধ তার ওপরে দুদিন আগের ঘূর্ণিঝড় চালের টিন উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ায় সাথে রান্নাঘরের বেড়া ভেঙে দিয়ে গেছে। একেই বুঝি বলে মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা! দাওয়ায় বসে নখ খুঁটে যাচ্ছে শংকর। সেক্রেটারি নির্মলদা বিকেলবেলা কেন জানি ওকে ক্লাবে ডেকে পাঠিয়েছে।
মা বিমলাবালা একটু একটু করে রান্নাঘরের জিনিসপত্র শোবার ঘরে নিয়ে এসে গোছাচ্ছেন। এই জীবনে সুখের মুখ দেখা বুঝি আর হবে না। স্বাস্থ্য বিভাগের চতুর্থ শ্রেণীর এই অস্থায়ী কর্মচারীর রিটায়ারমেন্টের বেশিরভাগ টাকা মেয়ের বিয়েতে লেগে গেছে। বাকি টাকা কম ছিল, তাই পুরানো মারুতি ভ্যানটা কেনার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কিছুটা লোন নিয়েছে শংকর। জমা পয়সা একটাও নেই, এদিকে ব্যাঙ্কের কিস্তি প্রতিমাসে ভরতে হয়। যে স্কুলে সে গাড়ি চালায় সেখানের সুপারভাইজারকে টাকার কথা বললে মুখের ওপর মানা করে দিয়েছে। স্কুল খুলতে আরও মাস দুয়েক লেগে যাবে, আর সরকার নাকি প্রাইভেট স্কুলকে ফিজ কম করার আদেশ দিয়েছে! কি হবে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। সুপারভাইজারের মুখে কথাগুলো শুনে গলা শুকিয়ে আসে বছর পঁচিশের যুবক শংকরের। কিস্তি না হয় নাই দিলো, কিন্তু খাওয়া-খরচার টাকাটা কোত্থেকে আসবে!
নির্ধারিত সময়ের আগে ক্লাবের বারান্দায় এসে পায়চারি করছে শংকর। এখনো কেউ আসেনি। মিসড কল করার মতো ব্যালান্স পড়ে আছে ফোনে। কয়েক'পা এগিয়ে শিরিষ গাছের তলায় দাঁড়িয়েছে, জনশূন্য পথে আধ কিলোমিটার সোজা দেখা যায় । আজকাল আবার পুলিশের ভয়, কাউকে বিনা কাজে বুঝতে পারলেই ধাওয়া দিচ্ছে। একটু অন্যমনস্ক হতেই একটা বাইক এসে সামনে দাঁড়াল। বাইক থেকে নেমে সোজা কাজের কথায় আসে নির্মল...
-- আইজকাল তুই ফ্রি আসস, না?
--হ, নির্মলদা।
-- একটা কাজ আছে রে! করবি?
জিজ্ঞাসু চোখে ঘাড় নাড়ায় শংকর। বিজন মনের অলিন্দে আশার আলো মিটমিট করে জ্বলে উঠছে।
-- শোন, তো তোকে গাড়ি লইয়া শিলচর যাইতে হইবো। আমগো ক্লাব থাইক্যা একজন সঙ্গে যাইবো তোর। ঔষধ-পত্র ছাড়া আরো কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আনবি তোরা। জিলা প্রশাসনের কাছ থাকি পাওয়া কাগজটার জেরক্স দিমু তোরে, গ্লাসে সাইট্যা দিলে গাড়িটারে আর পুলিশ ধরব না।
নির্মলের দিকে খোলা মুখে চেয়ে আছে শংকর। মুখে কোনো কথা নেই তার। কিছু না বলতে দেখে দ্বিধায় পড়ে নির্মল...
--কি রে, যাবি? আমি শুধু কালকের কথা কইতাছি না। এই ক'দিন ক্লাবের কাজকর্মে আমাদের সাথেই থাকবি। তেলের খরচা ছাড়া তিনশ টাকা করে পাবি। গরিব মানুষের সাহায্যে আশপাশের গ্রামে যাইতে হইবো।
আর কিছু বলতে পারে না, গলা ধরে আসে শংকরের। গত দু-দিন থেকে পেঁপে সেদ্ধ ভাত খেয়ে দিন গুজরান করছে মা-ছেলে। স্কুলে পড়াকালীন বাপ মরে গেলেও এতো দুঃখ-কষ্ট সইতে হয়নি। দখিন হাওয়া পরম স্নেহে শিরীষের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হলদেটে পাতাগুলো ফুলের মতো সন্তর্পনে ঝরে পড়ছে নির্মলদার শরীর বেয়ে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রয় শংকর।
*************
"ও আমার দরদী আজ জানলে...."
গুনগুন গানের সুরে মাইল দুয়েকের মেঠো পথ অবলীলায় পেরিয়ে চলে শুধন। মাঠের ওপারে মোহনপুর, বোন মিনার বাড়ি। অসুস্থতার খবর পেয়ে পড়ন্ত বেলায় বেরিয়ে পড়ছে সে। বসন্ত শেষের বৃষ্টিতে খড়গুলো পচে যাওয়ায় সবুজের জয় হয়েছে। আঁকাবাঁকা সরু আলের সীমানায় গোছা ঘাস যেন ঘাগরা ছড়িয়ে ঠায় বসে আছে। এই অসময়ে গরুটা চুরি গেলো। গত সপ্তাহের ঘটনা মনে হতেই বুক চিনচিন করে ওঠে শুধনের।
জন্মসূত্রে পাওয়া দারিদ্র্য সদাহাস্য শুধনকে কোনদিনই তেমন বিচলিত করতে পারেনি। বাঁশ-বেতের কারিগর শুধন গুনগুনিয়ে চাটাই, খালুই, ধামা, টোনা, মোড়া, ধুচুন আরো কত গেরস্থালি সরঞ্জাম বানিয়ে হাটে বিক্রি করেছে। একটা সময় ছিল শীতে-গ্রীষ্মে নদীপাড়ে ভালো সবজি ফলাতো, কিন্তু ক'বছর আগের বন্যায় মাটিটুকু ধ্বসে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। মাসদিন হলো বাজার বন্ধ। কয়েক পোজে ফটো তোলানোর পর যে চাল-ডাল পেয়েছিল, তাতে দশদিন চলার কথা হলেও তেরোদিন শেষে দুমুঠো চাল বাঁচাতে পেরেছে তার বৌ। রেশনের চাল দেবে দেবে করছে, আগামীকাল না দিলে...
সৎবোনটি ছোটবেলায় বড় স্নেহ আদরে লালন করেছে তাকে। তাই নিঃসন্তান বোনের স্বামী মারা যাবার পর সব বিক্রি করে দিয়ে চলে আসতে অনেকবার নিস্ফল অনুরোধ করেছে শুধন। ডাকাবুকো বোনটি ক্ষেত-কৃষি সব তদারকি করে সম্পূর্ণ একা বারোটি বছর কাটিয়ে দিলো। অসুখ-বিসুখ হলে তার 'বইনারি'রাই যত্ন-আত্তি করে সারিয়ে তুলেছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিটা অন্য। ভয়ে ঘরের বাইরে কেউ বেরোতে চাইছে না, সামান্য জ্বর-সর্দি নিয়েও হাসপাতালে গেলে নাকি সোজা শিলচর মেডিকেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে! আর একসাথে কয়েকজনকে দেখতে পেলে পুলিশ দাওয়াই দিচ্ছে। এমন অবস্থায় শুধন যখন মিনার বাড়ি পৌঁছল, তখন তুলসী তলায় প্রদীপ মিটমিট করছে। বিছানা থেকে শরীর টেনে তোলে মিনা, জলবসন্ত হওয়ার আজ পাঁচ দিন।
-- খালি চা খা রেবা, মুড়ি আনাত যাইতাম পারছি না।
-- অইবো, অইবো। ডাক্তর দেখাইসলায় নি?
-- না কম্পাউন্ডারে খবর পাইয়া দুইটা ঔষধ লেখিয়া দিসলা, ওগুইন খাইয়ার।
বাল্বের হলুদ আলোয় বোনের মুখপানে চেয়ে থাকে শুধন। সারাটা কপাল জুড়ে ছোট ছোট ফুস্কুড়ি, মলিন মুখে বয়সের ভার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ক’দিন ধরে একা একাই ঘরের কাজ করছে বেচারি, বড় মায়া হয় শুধনের। চায়ের কাপ তুলতে গেলে মানা করে মিনাকে। গা এলিয়ে দিয়ে আবার বলা শুরু করে মিনা..
-- ভালা অইছে তুই আইছস, ইবার চৈত মাসো মেঘ দেওয়ায় হবাড়ির আউয়ারে লইয়া পইচমর বিচরাত সবজি খেত করসিলাম। ভালা সবজি অইছে। বেচা গেলনে, কিন্তু মানুষ তো নাই। একবার টর্স লইয়া গিয়া দেখিয়া আছ না!
--না, কাইল সকালে দেখমু নে। আছি তো।
আনকোরা হাতে কি'ই বা রান্নাবান্না করবে, ডেকচিতে একমুঠো মুসুর ডাল সেদ্ধ বসায় শুধন। ক'দিন থাকতে পারলে ভালো হয়। রেশন কার্ড তো বৌয়ের কাছেই আছে। ছেলেকে নিয়ে গেলে দুজনে ধরে-পাকড় করে রেশন নিয়ে আসতে পারবে। বাঁশ-বেতগুলো পুকুরের হাঁটুজলে ভিজিয়ে এসেছে, একবার শুকিয়ে গেলে কাজ করা যায় না।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখন পূব আকাশ রক্তিম। ঘুলঘুলিতে দল বেঁধে খেলছে গুটিকতক উশৃঙ্খল চড়ুই। শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছে, উঠোনে পা রাখতেই মাটির শীতলতা শিরশিরানি দিয়ে গেলো সারা শরীরে। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সোজা সবজি বাগানে পৌঁছে গেলো শুধন। অনেকটা জায়গা জুড়ে ফসলের চাষ। ডান পাশে ঝিঙা, করলার লতি বাঁশের কঞ্চি বেয়ে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। মুঠোমাফিক ছোট-ছোট করলার ভারে বেঁকিয়ে গেছে কঞ্চি। চার-পাঁচ কিলো বিক্রিযোগ্য। ঝিঙে, কম করে তিন কিলো হবে। বামে অনেকটা জায়গা জুড়ে লাল শাকের চাষ, বড় গাছগুলো ডাঁটা হিসেবে ভালো দাম পাওয়া যাবে। একটু দূরে গিয়ে চোখ আটকে গেলো শুধনের। হলুদ-খয়েরি ফুলে টুইটুম্বুর হয়ে আছে গাছগুলো। ফুলের সাথে আঙুল সাইজের ঢেঁড়শ প্রতি ডালে কয়েকটি করে লেগে আছে। মিনিট দশেক হাঁটলেই বাজার। ওদের গ্রামের মতো এখানেও লক ডাউনে নিশ্চয় সকালবেলা শাক-সবজির বাজার বসে। হাজার দুয়েক টাকার সবজি বাগানে আছে, একটা ঠেলাগাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। মিনাকে নিমপাতা-গরম জল করে দিয়ে মেঠো পথে দ্রুত বাড়ির পথ ধরে শুধন। ঠেলাগাড়িটা নিয়ে আসতে হবে, সাথে কিছু কাপড় চোপড়।
শুধনের মনটা আজ বৃষ্টি ধোয়া আকাশের মতো ফুরফুরে, ঝলমল। দৃঢ় প্রত্যয়ে করে এগিয়ে চলে শুধন, নিরালা প্রান্তরে বাজে পায়ের ছপছপ ছন্দ। শুধন-শংকর-আরমানদের জীবনযুদ্ধের কাছে যুগে যুগে পরাজিত হয়েছে যত অশুভ শত্রু। শুধনরা এবারো জিতবে, আবার উদয় হবে নবীন সূর্যের।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন