টোপ
।। তৃণময় সেন।।
পর্দার ফাঁক দিয়ে এসে আগুনে পোড়া লৌহদণ্ডের মতো দেওয়ালে সেঁটে গেছে পড়ন্ত সূর্যের একফালি আলো। একটা অ্যাম্বুল্যান্সের তীক্ষ্ণ শব্দ দূরে যেতে যেতে ক্রমশঃ মিলিয়ে গেলো। রিসেপশনের দেওয়াল ঘড়ি হালকা সুরেলা শব্দে সন্ধ্যে ছ'টা বাজবার জানান দিয়ে আবার ডুবে গেলো মৌনতায়। গতকালকে স্বাধীনতার একশো বছর সম্পূর্ণ হয়েছে। পাশে মিউট করে রাখা বিশাল এল-ই-ডি'তে পুরোনো দিনের সাদাকালো ভিডিও চলছে। আবছাভাবে ফুটে উঠছেন গান্ধীজি-নেতাজিরা। হাসপাতালে রোগীদের আত্মীয়স্বজন নিজেদের অসুস্থ আপনজনকে দেখে কার-ক্যাব-মেট্রোতে করে বাড়ি ফেরার পথ ধরছেন। স্বাভাবিকভাবেই সেকেন্ড ফ্লোরের দুশো এগারো নম্বর রুমের পেশেন্টকে আজও কেউ দেখতে আসেনি। ছোকরা মতো দুই যুবক পেশেন্টকে নিয়ে আসা অ্যাম্বুল্যান্সের সাথে সেদিন এসেছিলো আর তাদের দেখা নেই। আজকে তেত্রিশ দিন হলো বি-এল-কাপুর সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে পড়ে আছেন সিদ্ধার্থ শংকর দেব। ভাগ্যিস সিসিটিভি কোম্পানির অ্যাপটা ইনস্টলড ছিল স্যামের মোবাইলে, না হলে ঐদিনই কিছু একটা হয়ে যেতে পারতো সিদ্ধার্থবাবুর। সুদূর ভিয়েতনাম থেকে বাবাকে হঠাৎ পড়ে যেতে দেখে "কেয়ার" এজেন্সির এমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করেছিল সে। শেষবার জুন মাসে যখন বাড়ি এসেছিলো, তখনই কিচেন থেকে শুরু করে ব্যালকনি সব জায়গায় অ্যাডভ্যান্স টেকনোলজির সিসিটিভি লাগিয়ে গিয়েছিলো। সাথে অ্যাপ ইনস্টল করেছিল, যাতে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটলে ফোনে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। কোম্পানির গ্লোবাল অডিট হেড সৌমিল ওরফে স্যাম, চার বছর থেকে নিউ-ইয়র্কে আছে। মাঝে মাঝে অন্যান্য দেশেও ট্যুর লেগেই থাকে। গত বছর দেশ থেকে বন্ধুর মাধ্যমে এরকম একটা অফার পেলেও ফিরিয়ে দিয়েছিল সে। ইন্ডিয়াতে আর ফেরার ইচ্ছে নেই। শহরগুলো বড্ড নোংরা, পরিবেশ এতটাই দূষিত যে বাইরে বেরোলেই মাস্ক পরতে হয়। মানুষে ভর্তি দেশে না আছে কোনো ট্রাফিক নিয়ম না ভালো সুযোগসুবিধা। তাছাড়া অনেক বছরের জন্য ভিসা, থাকার ব্যবস্থাসহ আলাদা ইনসেন্টিভের টোপ হাতছাড়া করাটা বোকামি হবে, পূরবীও তো তাই বলছিল।
চারদিন হলো আই-সি-ইউ থেকে বেরিয়েছেন সিদ্ধার্থবাবু। প্রথম দুদিন হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারলেও, আজকে শরীরটা একদম অসাড় লাগছে। আর ভাল্লাগছে না, এবার মরতে পারলে বাঁচেন তিনি। দু-ঘন্টা আগে স্যাম থ্রি-ডি ভিডিও কল করেছিল ওনাকে। সাথে বৌ আর ছেলেকেও নিয়েছিল। নার্স রিমোট দিয়ে বিছানাটাকে একটু সোজা করে তুলে ধরলে স্যামকে একেবারে কাছে দেখতে পারছিলেন সিদ্ধার্থবাবু। মনে হচ্ছিল যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। নাতির "কেমন আছো ড্যাদু’র উত্তরে অনেক চেষ্টা করেও আঙুল আর ঠোঁট নাড়াচাড়া করা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি তিনি। আগামী ক'দিন ব্যস্ত আছে স্যাম। মেক্সিকো যাচ্ছে। তিন-চার মিনিট কলের শেষে এই কথা বলে ছেড়ে দিল। বাবাকে নিউ-ইয়র্ক নিজের কাছে রাখতে চায়নি তা কিন্তু নয়, সিদ্ধার্থবাবু নিজেই যেতে চাননি। নিজের দেশেই মরতে চান। ইচ্ছে তো ছিল শেষের দিনগুলোতে গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবেন, গিয়েওছিলেন কিন্তু যে গ্রামটার ছবি সারাজীবন হৃদয়পটে লালন করে রেখেছিলেন সেই গ্রাম এখন আর আগের মতো নেই, সবকিছু বদলে গেছে। পুরোনো স্টেশনটার পাশে যেখানে অমিয়দার চা-সিঙ্গারার ছোট দোকান ছিল, সেখানটার তিনতলা বিল্ডিঙয়ে সাইবার ক্যাফে থেকে শুরু করে ইউনিসেক্স সেলুন সবই আছে। বাজারে লোকজন খুব একটা আসে না, বিগবাস্কেট - গ্রফার্স আলু-ফুলকপি-বেগুন সব ঘরে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে। তেমাথার কালীবাড়ি বিশাল গম্বুজাকৃতির হয়ে গেলেও, বিকেলবেলা সিদ্ধার্থবাবুর মতো হাতেগোনা তিন-চারজনকে দেখা যায়। ওনার বয়েসী কেউ নেই। কিছু প্রৌঢ়রা ওনার নাম জানলেও, চেনেন না। তপতীদের পরিবারেরও কেউ এখানে থাকে না। ওনার কাকার ছেলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ফিরে এসেছিলেন সিদ্ধার্থ। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে পড়াশুনা করাবার পর তার সফলতা চোখে দেখা হয়নি তপতীর। তেরো বছর ইএমআই দেওয়ার পরেও, বিল্ডারের সাথে মিউচাল আন্ডারস্টেন্ডিংয়ের মাধ্যমে ওরা ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছিলেন শুধু ছেলেকে বাইরে থেকে এমবিএ পড়ানোর খরচ যোগাবার জন্য। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শুধু গৃহবধূ না হয়ে প্রাইভেট জব জয়েন করেছিলেন তপতী। স্যামের জন্মের পরে কতগুলো বছর ছেড়ে দিলে হার্টের রোগ ধরা পড়ার আগে অবধি চাকরি করে গেছেন।
--"আমি কিন্তু তোমার আগেই মরতে চাই, তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না" বরাবরই বলতেন তপতী।
-- আঃ, ফালতু কথা বলা বন্ধ করো তো তপা।
বড় নিঃস্বার্থভাবে সারাজীবন সিদ্ধার্থকে ভালোবেসে গেছেন তপতী। পরস্পরের বোঝাবোঝির মাধ্যমে ওনার সাথে সংসার জীবন ভালোই কাটিয়েছেন সিদ্ধার্থ। ঘরের কাজ থেকে শুরু করে হাট-বাজার দুজনেই চারহাতে সামলে নিতেন। গ্রাজুয়েশন করার পর নিজের গ্রাম থেকে কয়েকমাইল দূরের প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করাকালীন তপতীর সাথে পরিচয় হয়েছিল সিদ্ধার্থর। অনেক চেষ্টা করেও সরকারি কিছুর ব্যবস্থা না হওয়ায় ভবিষ্যতের সাথে সাথে বেশি রোজগারের আশায় সহপাঠী অজয়ের কাছ থেকে বড় শহরে আসার টোপটা নির্দ্বিধায় লুফে নিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ। তারপর দু-বছর পরে তপতীকে বিয়ে, স্যামকে নিয়েছিলেন তার চারবছর বাদে।
গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে সিদ্ধার্থর। নাইটল্যাম্পের হালকা আলোয় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রাত ক’টা বাজে কে-জানে! ঢোক গিলতে পারছেন না, গলায় আঠা লেগে যাচ্ছে যেন। আস্তে আস্তে চোখ বোজেন সিদ্ধার্থ। দুফোঁটা জল চোখ থেকে কানের লতি ধরে বালিশে মিলিয়ে যায়। ছেলেবেলার ছবি ভেসে ওঠে সিদ্ধার্থের চোখে। বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছর বাড়ির পাশে নদীতে সমবয়েসী সবাই স্নান করতে যেত। অন্ততঃ ঘন্টাখানেক আগে ফেরার নাম নেই। বাড়ি থেকে মা-পিসিরা ছড়ি নিয়ে আসলে যে যেদিকে পারে দৌড় দিত। আম-কাঁঠাল-কালোজাম-আনারসের দিনে তো সেই মজা। বালতি ভরে আম, কালোজাম কুড়িয়ে আনতো সবাই। স্কুলের পাশে ছিল জলপাই-হরিতকির গাছ, একটা পেন্সিলের বদলে তিনটা হরিতকির লেনদেন হতো নিজেদের মধ্যে। বাড়ির পিছনে পুকুর ঘিরে নারকেল গাছের সাথে বড় পাতাওয়ালা সেগুন গাছের পাতা বৃষ্টি-তুফানে ঝরে পড়লে জমা করে রেখে দিতো ভাইবোনেরা। ভাত খাওয়ার সময় ওতে বসেই খেতে হবে। পুকুরের ওপারে বিস্তৃত ক্ষেতের মাঠ। ঋতু বদলের সাথে সাথে সবুজ-সোনালী-হলুদ রংয়ে রাঙিয়ে দিত দুচোখ। মাঠটা দূরের পাহাড়ের গা ঘেঁষে শেষ হয়েছে। শীতকালে কুয়াশার চাদরে ঢেকে যেত পাহাড়টা, আবার বসন্তের প্রথম বৃষ্টিতে স্পষ্ট ফুটে উঠত তার অবয়ব। ছোট সিধু পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ঘরবাড়িগুলো গুনতো আর ভাবতো একদিন এই পাহাড়টাতে যাবে। ঘর-গাছগুলো নিজের হাত লাগিয়ে ছুঁয়ে দেখবে। তার সাথে আরেকটা শখও ছিল তার, তা ছিল ছিপ দিয়ে মাছ ধরা। ক্ষেতের আল ধরে আধামাইল উত্তরে গেলে একটা সরকারি ডোবা ছিল, নাম ইংলাই। গ্রামের লোক ওটাকে বিল বলতো। মাঠের নরম পলিতে আস্তে আস্তে পা ফেলে চলতে হয়। মাঝে মাঝে ক্ষেতে জল সেঁচ করার ছোট-বড় গর্তে পা ধুয়ে নেয় সিধু। সারাদিনের রোদে ঈষৎ উষ্ণ জলে পা ডুবিয়ে রাখলে, আরামে যেন ঘুম এসে যায়। উষ্ণতার আবেশে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বিলে প্রচুর জিওল মাছ আছে, জাল ফেলে মাছ ধরা নিষেধ, তাই তেরো-চৌদ্দ বছরের সিধু ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো বড়শি নিয়ে পৌঁছে যায় সেখানে। সাত-আট জন লোক একেবারে নিঃশব্দে আলাদা আলাদা জায়গায় বসে আছে। বাড়ি থেকে আটাতে সিঁদল মেখে টোপ বানিয়ে নিয়ে এসেছে সে। সূক্ষ্ম লোহার কাঁটাতে ভালো মতো টোপটা সেঁটে জলে ছুঁড়ে ফেলে। একদৃষ্টে দেখতে থাকে ফাৎনাটা। এই বুঝি নড়ে উঠলো, এই বুঝি মাছ টোপটা গিলে ফেললো...
'দ্য নাম্বার ইউ আর ট্রায়িং টু কল, ইজ নট রিচেবল অ্যাট দিস মোমেন্ট' অনেকবার চেষ্টা করার পরেও সৌমিল দেবকে ফোন করলে একই আইভিআর বেজে উঠছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ই-মেইল করলেও, তার কোনো জবাব আসেনি এখনো। কাল রাতেই মারা গেছেন দুশো এগারো নম্বরের পেশেন্ট মিস্টার দেব। যন্ত্রের জোরে এতদিন রাখলেও, আর যে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না তা জানতো কর্তৃপক্ষ। নতুন সার্কুলার হিসেবে, বিশিষ্টদের নিয়ে টিম বানিয়ে সব হাসপাতালে তদারকি করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। মরণাপন্ন রোগীকে অযথা বেশিদিন আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনে রেখে টাকা রোজগার করা চলবে না। তবুও মোটা টাকার পার্টি হলে টিমের সাথে একটা বোঝাপড়া করে টোপ গেলাতে খুব কষ্ট হয় না কর্তৃপক্ষের। মিস্টার দেবের ক্ষেত্রে সেই সময়সীমাও অতিক্রম করেছিল। ঘড়িতে বেলা দুটো বাজে, মর্গের শীতল ঘরে জমে পাথর হয়ে গেছেন সিদ্ধার্থবাবু। স্যাম এখনো ফোন তোলেনি...
Comments
Post a Comment