মুক্তির স্বপ্ন

।।তৃণময় সেন।।
১.
-- ফুঁ দিয়া খাও রেভো, জিভরা জ্বলি যাইব! পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ দিনমনি রায়কে কথাটি বলে নিজের পাতের গরম খাবার ঠান্ডা করতে থাকে ফজর। একটু আগের বুকফাটা কাশি দেখে মনে হচ্ছিল যে এই বুড়ো আজকেই অক্কা পাবে। কিন্তু খিচুড়ি দেখে ওর সব অসুস্থতা যেন গায়েব হয়ে গেছে। ড্যাবড্যাবিয়ে দিনমনিকে দেখে যাচ্ছে ফজর আলী। কিন্তু দিনমনির তাতে কোনো ভ্রক্ষেপ নেই, ফজরের কথায় কান না দিয়ে হাপুস হাপুস করে খিচুড়ির গ্রাস মুখে তুলতে থাকে সে। খেতে খেতে গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মোছে, শেষবার কবে যে এমন সুস্বাদু খিচুড়ি খেয়েছিল মনে করতে পারে না। আজ খেয়ে দেয়ে একটা জব্বর ঘুম দিতে হবে। তার আগে মনের দেয়ালে সেঁটে থাকা দুঃশ্চিন্তাগুলোকে ঢাকতে হবে আঙ্গুলে গোনা সুখ-স্মৃতির চাদর বুনে। মনটা ভাল থাকলে, চোখে ভাল ভাল স্বপ্ন ধরা দেয় । গতকাল সারাদিন মাছের কথা ভাবছিল বলে রাতে ইলিশসেদ্ধ খাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। পদ্মার ইলিশ...আহা! কি স্বাদ… ভাবতেই জিভে জল আসে। চেটেপুটে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পুজোকমিটিকে প্রানভরে আশীর্বাদ করে দিনমনি। নবমীর দুপুরে ঢাকের বাদ্যি বেজেই চলেছে.. চোখবুজে মা দুর্গাকে প্রণাম জানিয়ে চটের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ছেলেবেলার পুজোর দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যায় সে।
২.
পুজোর প্রথম দিনে বন্ধুদের সাথে পুজোর ছোট-ছোট আয়োজন করে চলেছে কিশোর দিনমনি। সাদা তিল, কুয়াশার জল, একশো আটটি বেলপাতা, নারিকেলের ছোবা কেটে ধুনুচিতে দেওয়া আরও কত কিছু কাজে খুব ব্যস্ত সে। অদূরে নদীতীরে উঁকি দিচ্ছে শ্বেতশুভ্র কাশবন। নানা রঙের বেলুন, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ, নতুন কাপড়ের গন্ধ সবমিলিয়ে একটা আনন্দের আবহ তৈরী হয়েছে। আজকে সন্ধ্যায় দাদুর দেওয়া শেষ উপহার একতারা বাজিয়ে পল্লীগীতি শোনাবে দিনমনি, মনে চাপা উত্তেজনা আর আনন্দে তর সয় না তার। হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে আসে আর্তচিৎকার! পূর্ব-পাকিস্তানের এই জেলায় নাকি উগ্রবাদীরা আক্রমণ করেছে, সবাই প্রানভয়ে পালাচ্ছে। যাদের নৌকা আছে তাদের হাতে ছোট-বড় বোঁচকা আর যাদের নেই তারা নিজেরাই জানে না কেমন করে নদী পার হবে। নদীর ওপারে যেতে পারলেই প্রাণরক্ষা হবে, না হলে আজকে আর উপায় নেই। ট্যাঁকে সামান্য জমা টাকা নিয়ে দৌড়ে চলে এসেছে দিনমনির বাবা। ঐ’তো একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে নরপশুদের, হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ক্ষিপ্রবেগে ধেয়ে আসছে। প্রানপ্রিয় একতারাটি প্যান্টের পিছন দিকে গুঁজে মা-বাবার সাথে নদীতে ঝাঁপ দেয় দিনমনি। মাঝনদীর ঢেউ নাকে ঢুকে গেলেও আজকে থামলে চলবে না। ডুবসাঁতারে দক্ষ দিনমনি ধীরে ধীরে তীরে চলে আসে। অদূরে বাবাকে দেখা যাচ্ছে কিন্তু মা কোথায়! নদীর দিকে মুখ করে সজোরে চিৎকার করে দিনমনি। মা...আ...আ...মাগো.. ও... ও...
৩.
সকল আটটা বেজে গেছে, কিন্তু দিনমনি ঘুম থেকে ওঠে নি। ফজর, আশুরা তাকে জাগানোর বৃথা চেষ্টা করার পর গেটের সামনে গিয়ে পুলিশ ডেকে এনেছে। অনেকদিন থেকে অসুস্থ দিনমনিকে ডাক্তার দেখানো হয়নি। "কাইলউ তো আমার লগে খিচুড়ি খাইলা, ইলা আখতা করি যে..." বলে থেমে যায় ক্যাম্পের আরেক বন্দী জগন। দিনমনির মাথার পাশটাতে পড়ে আছে ধুলোমাখা একতারা। ক্যাম্পে বাজানো বারণ থাকায় অনেকদিন থেকে হাত পড়েনি যন্ত্রটিতে। আর কোনওদিন হয়তো এই একতারার তারে পড়বে না কারো আঙুলের ছোঁয়া । সর্বহারাদের উত্তরাধিকারের দাবি সচরাচর কেউ করে না এই দুনিয়াতে।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন