বিয়ের_সানাই
॥তৃণময় সেন॥
ঠাস!!
ড্রাম-সানাইয়ের সামনে শব্দটি এতটা তীব্র না
হলেও তার তীক্ষ্নতা কারও কান এড়ায়নি। কনের সাথে
দাঁড়িয়ে থাকা বৌদি থেকে
শুরু করে সানাই হাতে
লাখমল সবার চোখ অতর্কিত
শব্দের উৎসস্থল এক লহমায় আবিষ্কার
করে ফেলল! বড় মেয়ের বিয়েতে
হঠাৎ এই অঘটনে বুক
ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলেও মুখ
চাপা দিয়ে নিজেকে সামলাচ্ছেন
নীলিমা। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে ঠোঁটে
বাঁকা হাসি হেসেছেন মেয়ের
পিসেমশাই জয়ন্তবাবু। কাকু শিবেনের পায়ের
তলা থেকে মাটি সরে
গেছে, কি-ই বা
বলবেন.. কেমন করেই পরিস্থিতি
সামাল দেবেন... এখন দাদা হরেনকে
চোখের সামনে দেখতে পেলে যেন হাঁফ
ছেড়ে বাঁচেন তিনি। মেয়ের বান্ধবী তনু, মামার ছেলে
আয়ুষ সবাই বড়বড় চোখে
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ওদিকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন
বরপক্ষের প্রধান অভিবাবক ওরফে ছেলের খুড়ো
হরদয়াল চৌধুরী। জামাইবাবু সুরেন্দ্র অপমানে লাল হয়ে গেছেন।
মহিলারা নিজেদের ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে
ছেলেপিলেদের খুঁজে বের করছেন। ছেলের
বন্ধুরা কি রিয়েক্ট করবে
ভেবে উঠতে না পেরে
আড়চোখে সবার চেহারা নিরীক্ষণ
করে যাচ্ছে। সপাটে চড় খসানোর পরেও
থেমে নেই জিয়া, রক্তচক্ষু
দিয়ে যেন গিলে ফেলবে
ছেলেটাকে।
পিয়া
আর জিয়া.. দুটি মেয়ে নিয়ে
মাঝারি গোছের পরিবার হরেন গোসাঁইয়ের। একটা
ছেলের খুব শখ থাকলেও
ভগবানের কাছে সেই প্রার্থনা মঞ্জুর
হয়নি তার। কিন্তু ছোট
মেয়েটার আদব-কায়দা কিছুটা
ডানপিটে ছেলেদের মতো। ছোটবেলা থেকে
ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলা
থেকে শুরু করে আজকাল
বাইক চালানো, তার সব কার্যকলাপই
যেন সাধারণ মেয়েদের থেকে একটু আলাদা।
সাজগোজের দিকে মোটেই নজর
দেয় না সে, কোনো
অনুষ্ঠানে যাবার আগে মা গজগজ
করলে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে দিদির লিপস্টিক
আর টিপ পরে নেয়
এই যা। জিয়ার এই
ছেলেমার্কা স্বভাবের জন্য জয়ন্তবাবুর মতো আত্মীয়রা পরোক্ষে হরেনকে বোঝাতে চাইলে তা কানে তোলেননি হরেন। যদিও নীলিমা একটু
খুঁতখুঁতে স্বভাবের। মেয়েদের ব্যাপারে কোনো উড়ো কথা
কানে আসলে উপায় নেই।
মেয়েদের উপরে মেজাজ করেন
বটে, কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে
করে এতটুকু হয়ে যান। তার
উপরে জিয়ার ছেলেমানুষি চলাফেরায় আজকাল বেশ উদ্বিগ্ন থাকেন
তিনি। বাইশ বছরের হয়ে
গেল জিয়া, পিয়াকে বিয়ে দেবার পরের
বছর থেকেই পাত্র খোঁজা শুরু করে দিতে
হবে। কিন্তু ওর কি আর
এইসবের জ্ঞান আছে! কানেই তোলে
না মায়ের কথা। মেয়েকে প্রশ্রয়
দেওয়া নিয়ে বৌ প্রায়ই
বকাঝকা করলে তা মোটেই
গায়ে মাখেন না হরেনবাবু। উল্টে
মেয়েদের বলেন
-- সারা
জীবন ইলেকট্রিক ডিপার্টমেন্টে চাকরি করায় দুনিয়াশুদ্ধ লোকের
গালমন্দ খেয়েছি। তাই আজকাল আর
তোদের মা কিছু খারাপ
বললে তা কানেই যায়
না আমার। হা হা হা...
ওনার রসিকতায় আরও তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন নীলিমা।
-- আমার
কথা আজ কানে যাচ্ছে
না...কিন্তু বলে রাখি এই
মেয়ে বিয়ে দিতে টের
পাবে তুমি।
দিদিকে প্রমিস করায় বিয়ের সন্ধ্যেতে কমলা রঙের লেহেঙ্গা পরেছে জিয়া। কালকে দিদি চলে যাবে ভেবে বিকেলবেলা একটু মন খারাপ হলেও পিয়াকে তা একটুও বুঝতে দেয়নি সে। কানে ঝুমকো, চোখে কাজল, গলায় পাথরখচিত মালা, তার সাথে ম্যাচিং ব্যাগ হাতে জিয়াকে চেনাই যাচ্ছিল না আজ। মেয়ের সুমতি হচ্ছে দেখে খুশিই হয়েছেন নীলিমা। শার্ট-জিন্স ছেড়ে এগুলো মাঝে মাঝে তো পরতেই পারে! সঙ্গীসাথীদের নিয়ে নতুন জামাইবাবুকে ঘিরে বসে আছে জিয়া। জামাইবাবুর ভাগ্নে শুভদীপ ওর বয়সী, গুয়াহাটি বি বড়ুয়া কলেজ থেকে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করছে সে। প্রথমে কথাবার্তা ভালো লাগলেও ক্রমশঃ যেন গায়ে পড়া হয়ে উঠেছে। নিজে একটু ছেলেগোছের হলেও একটু আড়ালে ওর ইঙ্গিতগুলো মোটেই ভালো ঠেকছে না জিয়ার। ছোট শহরের হলেও ওর বন্ধু পিঙ্কু, অনুপরা কোনোদিনও কথাবার্তায় এইরকম অশালীন ইঙ্গিত দেয়নি ওকে। তাই বলেশালীন-অশালীনের জ্ঞান হয়নি বললে, সেটা ভুল হবে। বাসে-অটোতে নানা রকমের তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়া মোড়ের দোকানের কাঁচাপাকা চুলদাড়িওয়ালা কাকুটার চোখ ঠিক চিনতে পারে জিয়া। যদিও এইসব ব্যাপারে বাড়িতে কোনোদিনই কিছু বলেনি। ভাবছিল আজকে দিদির বিয়ে না হলে উচিত শিক্ষা দিত ছেলেটিকে। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলে পিছন পিছন ঠিক চলে আসছে নাছোড়বান্দা ছেলেটা। কিছুক্ষণের জন্য দিদিকে সাজানোর ঘরে গিয়ে নিস্তার পেলেও আসল ঘটনাটা ঘটল সাতপাকের বেলায়। ভিড় ঠেলে কুঞ্জের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল জিয়া। ইচ্ছেকৃত হালকা ধাক্কাতে চুপ থাকলেও একটা হাত ওর পিঠ বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করলে পিছন ফিরে ক্ষিপ্রবেগে চড় বসিয়ে দিয়েছিল হাতওয়ালার গালে। চেহারা দেখে আর নিশ্চিত হবার দরকার হয়নি।
একে
তো বরপক্ষ, তার উপরে
খোদ ছেলের ভাগ্নের গায়ে এইভাবে হাত
তোলাতে বিয়ের পরিবেশটা হঠাৎ থমথমে হয়ে
গেছে। কানাঘুষোর অস্পষ্ট ফিসফিসানি ভাসছে চারদিকে, বিয়েটা বুঝি ভেঙেই গেলো!
বিয়েবাড়িতে তো একটু-আধটু
ঠাট্টা তামাশা চলেই, তাই বলে কি
ছেলেটার উপর হাত তুলবে!
এই মেয়ের জন্য একদিন গলায়
দড়ি দিতে হবে। বাড়ির
সকলে অপরাধীর মতো যে যেখানে
ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে হেঁসেলের
খবর নিয়ে বিয়ের মন্ডপে চলে
এসেছেন হরেন। কাছে এগিয়ে গিয়ে
ব্যাপারটা দাদার কানে ঢেলে দেন
শিবেন। নিজের মেয়ে অকারণে কারও উপর হাত তুলবে না
বলে নিশ্চিত থাকলেও এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়, কিছু বুঝে উঠতে
পারছেন না তিনি। চড়
মেরে সেখানেই শুভর চোখে ক্রোধে
ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে জিয়া।
কে ঠিক, কে বেঠিক
আপাতদৃষ্টিতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
ষাটোর্দ্ধ হরদয়াল জিয়া-শুভদের দিকে
এগিয়ে গেলে তাকে অনুসরণ
করেন হরেন। তাতে জিয়ার মধ্যে
কোনো পরিবর্তন না দেখা গেলেও
ধীরে ধীরে চোখ নিচে
নামায় শুভ। লজ্জায়-অপমানে
এখন ধরণী দ্বিধা হলে
বাঁচে সে। নিচু মাথায়
মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে গেলেও
পথের হ্যালোজেনের আলোতে অস্বস্তি বোধ করে শুভ।
দৌঁড়ে গিয়ে অন্ধকারের মাঝে
লুকিয়ে নেয় নিজেকে। ততক্ষণে
মন্ডপে সবাই সব কিছু
বুঝে গেছে। ধীর পায়ে ফিরে
গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়েছেন হরদয়ালবাবু।
"তাড়াতড়ি করুন, লগ্ন পার হতে
চলল যে"... পুরুতঠাকুরের কথা সবাই যেন
সম্বিত ফিরে পেল। নতুন
উদ্যমে গেয়ে উঠল লাখমলের
সানাই, বিয়েবাড়ি আবার ড্রাম-সানাইয়ের
যুগলবন্দিতে মুখরিত হয়ে উঠল॥
Comments
Post a Comment