ঝিঙ্গাবুড়া


।।তৃণময় সেন।।

--পরতেক বছরঅউ তো বাক্কা টেকার সবজি বেচ রেবা ঝিঙ্গাবুড়া, আবো সবজি টানার লাগি অটো এখান কিনতায় পারলায় না নি! আর কত ঠেলা ঠেলতায়?

হাসিমুখে আনোরকে জিজ্ঞেস করল জসীম। যাত্রাপুরের বাজারের সবচেয়ে পুরানো ফল বিক্রেতা।

--আর মাতিওনা জসীম ভাই। ইবার কি পরিমান হিল পইড়ল। সারা ঝিঙ্গা একেবারে ঝাড় সুদ্ধা ছেঁচিলাইসে। মনে তো আসলো ইবার মাল টানার লাগিন গাড়ি এখান লামাইমু..কিন্তু কপালো না থাইকলে আর কিতা করবায়!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ঠেলাগাড়ির পিছনে ধাক্কা লাগায় 'ঝিঙ্গাবুড়া'। জসীমের ঠোঁটের হাসি ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে। করুণা হচ্ছে মানুষটার প্রতি। ঈশ্বরের খামখেয়ালিপনাকে উপেক্ষা করে এই বয়সেও বেদম খেটে যাচ্ছে মানুষটা, সুখ বুঝি ইহজীবনে নসিব হবে না। 'ঝিঙ্গাবুড়া'র আসল নাম আনোর হুসেন, কিন্তু অনেক বছর থেকে এই তল্লাটে সিজনের শুরুতেই সবার প্রথমে ঝিঙে বাজারে নিয়ে আসে, তাই লোকমুখে ওর প্রচলিত নাম 'ঝিঙ্গাবুড়া'। এই নামটা কে রেখেছিল কেউ জানে না। শীতকালে লাউ নিয়ে বাজারে বসায় আবার কেউ কেউ ওই সময়টাতে ওকে 'লাউবুড়া' নামেও ডাকে। বলতে গেলে আনোরের নাম শীত-গ্রীষ্মে দু'বার বদলায়। 

ঝিঙ্গা বা লাউবুড়া নাম খ্যাত হলেও আনোর গ্রীষ্মকালে কাকরোল, ডেঙ্গা, ভেন্ডি, করলা আদি চাষ করে আর শীতকালে বরাকপাড়ে বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি মাথায় সত্তর শতাংশ পাকা চুল, শরীর বয়সের তুলনায় বেশ শক্তসমর্থ; তবুও এখন বেশিক্ষণ ঠেলাগাড়ি টানলে শরীরে তেমন জোর পায় না ঝিঙ্গাবুড়া, বিশেষত রানীঘাটের সেতু চড়াই-উতরাই করতে। ঠেলাগাড়ি ওই উঁচুতে চড়ানোর সময় যতটা গায়ের জোর প্রয়োগ করতে হয়, নামতে ততটাই টেনে ধরতে হয়।

সপ্তাহে পাঁচদিনই মাথায় ছাতা বেঁধে, সবজি ঠেলাগাড়িতে চড়িয়ে ঝিঙ্গাবুড়া বেরিয়ে পড়ে শিলচরের উদ্দেশ্যে। আসা যাওয়া নিয়ে প্রায় বিশ কিলোমিটার। শীতকালে পায়ের গোড়ালি ফেটে রক্ত ঝরে, গ্রীষ্মে ঘামে ভেজা জামা আবার গায়েই শুকায়। যদিও রমজান মাস থাকায় আজকাল তিন দিন করে শিলচর যাচ্ছে, বাকি দুইদিন যাত্রাপুর আর ভাঙ্গারপার। যাত্রাপুর বা ভাঙ্গারপার বাজার বিকেলবেলা বসলেও শিলচরের উদ্দেশ্যে সকাল সাতটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে ঝিঙ্গাবুড়া। বালিঘাট-জয়নগর-মাছিমপুর-তোপখানা হয়ে ইএনডি কলোনি পৌঁছতে পৌঁছতে সব সবজি বিক্রি হয়ে যায় তার… পথের ধারে শ্যামলের দোকানের সিঁদল চাটনিওয়ালা পোলাও খেয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরে সে... রমজান মাসের জন্য তাও আপাতত বন্ধ রয়েছে। ঈশ্বর পরম শক্তিমান বলেই তো সে খালি পেটে এতো খাটতে পারে! যথাসময়ে পথেই নামাজ সারে ঝিঙ্গাবুড়া।

ক্লান্ত হয়ে পড়লেও এই জীবনে থেমে থাকার জো নেই ঝিঙ্গাবুড়ার.. একমাত্র ছেলে আবুল বিয়ে করার পর বৌ নিয়ে আলাদা থাকে। অথচ আবুলের অপেক্ষায় এক এক করে চার কন্যাসন্তানের জননী হয়েছিল জরিনা বিবি। খুব আদর আহ্লাদে বড় করছে ছেলেকে। ডানপিটে ছেলের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসলে রুখে দাঁড়াতো। বড় বোনেরা হামেশাই কোলে কাঁখে করে রাখতো তাকে। সেই আবুল আজকে মা-বাপের খবরই নেয় না। সবই অদৃষ্ট বলে আনোর নিজেকে বুঝিয়ে নিলেও তার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে জরিনার চোখ দিয়ে জল ঝরে। 

শিলচর-কালাইন রোডে কুদ্দুস সাহেবের ছেলের টাটা সুমো চালায় আবুল। সকাল সাতটা হতেই গাড়ি নিয়ে সোজা কালাইন। লোকে বলে ওর গাড়ি চালানো নাকি খুব বাজে। বেশি যাত্রী টানার লোভে এই লাইনে চলা বাকি সুমো-ক্রুইজারগুলোকে ওভারটেক করতে ওস্তাদ আবুল। দিন পনেরো আগে বেলাকোনা চৌরঙ্গীতে ওর গাড়ির ধাক্কায় একটি গরু প্রাণ হারিয়েছে। মালিক পক্ষকে ক্ষতিপূরণও দিতে হয়েছিলো। হাতে-পায়ে ধরে সেইবার আবুল চাকরি বাঁচিয়েছে। যদিও তার গাড়ি চালানো দেখে সেরকম কিছু বোঝার উপায় নেই। সবকিছুই কানে এসেছে আনোরের, কিন্তু নিজে থেকে ছেলেকে কোনো আদেশ-উপদেশ দিতে যায়নি একখান পুরানো ঠেলাগাড়ির মালিক ঝিঙ্গাবুড়া কোনোদিনই ছেলের চারপায়া গাড়িতে চড়েনি।

একে একে চারটে মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছে ঝিঙ্গাবুড়া.. দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ে হয়েছে জয়নগর। শিলচর যাবার পথে মেয়ের বাড়ির সামনে সামান্য জিরিয়ে নেয় সে। বাড়ি ফেরার পথে মেয়ের বাড়ির পথের ধারেই বসে থাকে, বাড়িতে ঢোকে না। আব্বা আসার সময় ঠিক জানা আছে মেয়ের। সে জানে আব্বা এসে শিরিষ গাছের তলায় বসে থাকবে। হাজার বললেও বাড়ির ভেতরে আসবে না। জোর করলে ঘুরেফিরে সেই একই বক্তব্য -

-- পুড়ির বাড়িত ইলা খালি আতে রোজ রোজ জাইননা রে মাই।

মেয়ের জোরজারিতে জামাইও দু-একবার বাড়িতে ঢুকে একটু জলপান করতে বলেছে বটে, কিন্তু শ্বশুরকে টলাতে পারেনি।

আজ ফেরার পথে ইফতার নিয়ে যেতে হবে জয়নগর। বদরপুর-গনিরগ্রাম-কাশিপুর ইফতার পাঠানো হয়ে গেলেও জয়নগর নিজেই যাবে যাবে বলে যাওয়া হয়নি ঝিঙ্গাবুড়ার.. তাই আজ ঠেলাগাড়ি শ্যামলের জিম্মায় রেখে তারাপুর বাজার থেকে ব্যাগ ভরে খেজুর, আম, লিচু সাথে কয়েক কিলো জিলিপিও নিয়েছে ঝিঙ্গাবুড়া। জিলিপিগুলো যাতে পথেই নেতিয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে ভালো করে প্যাক করিয়েছে। জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম, রমজান উপলক্ষ্যে ফল-মাছ-সবজির বাজারে যেন আগুন লেগেছে। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। যদিও তা নতুন কিছু নয়, প্রত্যেক রমজান মাসের এমনটাই হয়। একটু কমে পাবে বলেই তারাপুরে আসলেও যাত্রাপুরের সাথে যে দামদরের খুব একটা তফাৎ নেই, তা ঠিকই বুঝতে পারে ঝিঙ্গাবুড়া। গত দু'দিনের রোজগার থেকে কিছুটা টাকা বাচিয়েছিল, তার সাথে আজকের পুরোটাই লেগে গেছে। ওদিকে ঘরে তেল বাড়ন্ত, তিন দিন থেকে নুন আর কাঁচালঙ্কা সহযোগে সবজি সেদ্ধ করে চলছে জরিনার দুই পেটের সংসার।

আজকে বাড়ি যেতে বেশ দেরি হয়ে যাবে। বাজার করতে অনেকটা সময় চলে গেছে। রাস্তাতেই কোথাও সারতে হবে ইফতার। জরিনা বিবি আজ সকালেই ওকে ইফতারের সময় বলে রেখেছে। তাই তাড়াতাড়ি পা চালায় ঝিঙ্গাবুড়া। বালিঘাট মসজিদ পার হবার পর আর এগোতে যেমন কষ্ট হচ্ছে ওর। আজকে ভোরবেলায় সেহরিতে ভালো মতো খাওয়া হয়নি। অবেলায় খাবার ভালো না হলে গলা দিয়ে উতরে না। এই গতিতে এগোতে থাকলে মেয়ের বাড়ি পৌঁছতেই সন্ধ্যে হয়ে যাবে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। পনেরো-কুড়ি মিনিটের মাথায় ইফতারের সময়। অন্যদিন হলে একটু বসেই অপেক্ষা করতো, কিন্তু আজকে আর জিরানোর সময় নেই। পা-চালাতে পারলে যথাসময়ে পৌঁছানো যেত। গুমোট আকাশে ঘন মেঘ জমেছে, শেষ বিকেলে তাই নেমেছে অকাল সন্ধ্যা। একে তো এই অবেলায় ঠেলা চালানোর অভ্যেস নেই ঝিঙ্গাবুড়ার, তার ওপরে এই সামনে থেকে আসা গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলো সোজা চোখে এসে পড়ছে। দু'চোখে অন্ধকার দেখে ঝিঙ্গাবুড়া তাও থামে না। সহসা সামনে থেকে দুটো গাড়ি একসাথে আসায় ঠেলাগাড়ির নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হয় ঝিঙ্গাবুড়া। দুটো গাড়ি হঠাৎ আড়াআড়িভাবে আসায়, ঠেলাগাড়িটি সরিয়ে নেবার মতো পর্যাপ্ত জায়গাও ছিল না। একটি গাড়ি সজোরে ধাক্কা মারে ঠেলাগাড়ির সামনের দিকটায়। হাতলটা আছড়ে পড়ে ঝিঙ্গাবুড়ার বুকের পাঁজরে সজোরে আঘাত হানে। কয়েকহাত দূরে ছিটকে পরে ঝিঙ্গাবুড়া। কয়েক সেকেন্ড কেঁপে স্থির হয়ে যায় তার শ্রান্ত শরীর। অনতিদূরে মসজিদের মাইক থেকে আজানের ধ্বনি আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। সুমোর দরজা খুলে আবুল ততক্ষণে আবছা অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন