ঈশ্বরের আঁখি
।।তৃণময় সেন।।
অবশেষে প্রার্থনা সফল হয়েছে। বহু যুগ ধরে সমস্ত প্রাণীকুলের প্রাণের আকুতি মঞ্জুর হয়েছে ঈশ্বরের কাছে। অশীতিপর বটগাছের ললাটে প্রশান্তির আভা। ছেলেবেলায় অমন বসন্ত শেষবার দেখেছিল মনে পড়ে, তারপর বৈচিত্র্যময় জীবনে অনেক বসন্ত কেটে গেছে... পাকুড়ের সাথে তার বিয়ে, বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়, বায়ুতে বিষ মেশানোর ব্যবসা থেকে শুরু করে চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় পাকুড়কে নির্বিচারে হত্যা সবই - এই জীবনে দেখেছে আজানুলম্বিত ঝুড়িবিশিষ্ট এই বট। বসন্তের নির্মল বাতাসে তার পাতার শব্দ পতপত করে বাজে। মগডালে বসে অবিরাম কুহু ডাকে কানে মধু ঢেলে দিচ্ছে একজোড়া প্রেমী কোকিল। নীলাকাশে থিতু হতে পারছে না ধূসর মেঘ, সাদা ভেলা ভেসে যাচ্ছে নিরুদ্দেশের পানে। নিরন্তর কলতানে আকাশ বাতাস মুখর করে পরিযায়ী পাখির দল উড়ে গেলো দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা ধরে। অদূরে তরুণী রাধাচূড়া আর পলাশের ছয়লাপ, সাময়িক জ্বরাগ্রস্ততা কাটিয়ে আগুন-হলুদে উজ্জ্বল করে রেখেছে চরাচর। কচি পাতার কাঁপনের সাথে মুকুলভরা আমবাগানে খাদ্য সংগ্রহে পা টিপেটিপে চলছে একটি ময়ূর। প্রবাহমান নদীতীরে আজ সপরিবারে এসেছে হাতিরা। তারা ঢকঢক করে আকণ্ঠ পান করে পাহাড়ি নদীর মিঠা পানি। অথচ ক'দিন আগেও প্রাণভয় বিরাজ করত সর্বত্র, কেউ একজন সমতলে আসলে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাত পুরো পরিবার।
সন্তানের সুখ কে না চায়, তাই আজকের দিনে তাঁর ঠোঁটেও ফুটে হাসির রেখা। মেঘের ভেলা থেকে নেবে আসলে মৌমাছি গুঞ্জনগানে স্বাগত জানায় তাঁকে। দমকা হাওয়ায় পাপড়ি ছড়িয়ে লাল রঙের পসরা সাজায় কৃষ্ণচূড়া। এই অতিপ্রাকৃত পরিবেশে মন মুগ্দ্ধতায় হারিয়ে যেতে বাধ্য, কিন্তু তার দুচোখ হারানোর ব্যাথা আর প্রাপ্তির প্রশান্তিতে আলাদা আলাদা রূপ নিয়েছে। তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণীর জীবনে নেমে এসেছে আজ ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। চারদিকে হাহাকার, প্রতি ক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। অদৃশ্য শত্রু থাবা বসিয়েছে তাদের সভ্যতার ওপর। এই দুর্দিনের জন্য কে দায়ী! বুকভরা আশা নিয়ে তাদের পাঠিয়েছিলেন স্রষ্টা। কিন্তু দিনেদিনে লোভ, দম্ভ,আত্মসর্বস্বতা, ক্ষমতার লড়াই, দুর্বলের প্রতি অত্যাচার নিয়ে গেছে তাদের সর্বনাশের পথে। এই পতন তো হওয়ারই ছিল, কিন্তু তাই বলে কি ধ্বংস রোধ করা যেত না! চোখের সামনে শ্রেষ্ঠ জীবের এই বিনাশকাল ঠায় বসে দেখতেন স্রষ্টা! কিন্তু কর্মফল সবাইকেই ভোগ করতে হয়। শ্রেষ্ঠ হয়ে জন্মালেও আসল শ্রেষ্ঠত্ব কর্মই প্রমাণ করে আর তাতে ঈশ্বরেরও করণীয় কিছু থাকে না। তবুও তো সন্তান, তাই এক আঁখি থেকে আবেগ তো আরেক আঁখি থেকে বিষাদ অঝোরে ঝরে স্রষ্টার।
Comments
Post a Comment