প্রথম প্রেম
।।তৃণময় সেন।।
ছোট্ট শহরের মায়া ছেড়ে দিল্লি এসেছি বছরখানেক হয়ে গেছে। মাসতুতো ভাই এখানে একটা এমএনসি-তে চাকুরীরত, তাই থাকা-খাওয়ার জন্য তেমন কোনো অসুবিধা পোহাতে হয়নি আমাকে। বিএসসি করে আর পড়ার ইচ্ছে না থাকায় বাবা অনিচ্ছাসত্বেও পাঠিয়ে দিয়েছিল সেজদার কাছে। কয়েকমাস ঘোরাঘুরির পর ইস্ট দিল্লির লক্ষ্মীনগরে থ্রি-ডি অ্যানিমেশনের একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছি। এখানে একবছরের কোর্স শেষ করার পরে নাকি এরাই প্লেসমেন্ট দেবে! শেখার সাথে সাথে অ্যানিমেশনের জগৎটা বেশ ভালোই উপভোগ করছি আমি। বাড়ি আসার পর ল্যাপটপ নিয়ে বসলে কেমন করে যে তিন-চার ঘন্টা কেটে যায় বুঝতে পারি না। সেজদা সাড়ে আটটা নাগাদ অফিস থেকে ফিরে প্রায়ই আমার কোর্সের খবর নেয়। রোজ সকালে নাওয়া খাওয়া সেরে সন্তনগরের থার্ড ফ্লোরের ছোট ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি ইনস্টিটিউটের উদ্দেশ্যে। ঘর থেকে মেট্রো স্টেশন অবধি পায়ে হেঁটে গেলে মিনিট পনেরো লেগে যায়, তাই চৌরাস্তার মোড় থেকে রোজ সাড়ে ন'টায় লক্ষ্মীনগরের বাস ধরি আমি। এতদিনে পথঘাট সম্বন্ধে বেশ ভালোই ওয়াকিবহাল হয়ে গেছি। পঁচাশি নম্বরের সবুজ রঙের বাস গোল মার্কেট-মন্ডি হাউস-তিলক ব্রিজ-আইটিও হয়ে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় আমাকে পৌঁছে দেয় লক্ষ্মীনগর। বেশি ট্রাফিক জ্যাম হলে সময়টা বেড়ে এক ঘন্টাও হয়। এরকমই একটি ট্রাফিক জ্যামের দিনে ওকে প্রথম দেখি আমি।
সকালের একপশলা বৃষ্টিতে ফ্লাইওভারের নিচে জল জমে যাওয়ায়, কয়েক কিলোমিটার লম্বা যানজট লেগেছে আইটিও-তে। গাড়ির মাঝামাঝি একটা সিটে বসা আমি সামনে-পিছনে চোখ বুলিয়ে শেষ দেখতে না পেয়ে ইয়ারফোন গুঁজতে যাবো তখনই হলুদ সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি ভিড় ঠেলে আমার সামনে চলে আসায়, নিজের সিট্ ছেড়ে ওকে বসবার অনুরোধ করলাম। ঠোঁটে হালকা হাসি এঁকে হাত দিয়ে আমাকে বাধা দেওয়ায় দাঁড়াতে গিয়েও আবার বসে পড়লাম। গাড়িভর্তি ভিড়ে একজন মেয়েলোককে দাঁড় করিয়ে নিজে বসে থাকায় বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। কয়েকসেকেন্ড পরপরই ওর দিকে চোখ যাচ্ছিল। রোগা পাতলা চেহারার মেয়েটা খুব ফর্সা না হলেও বেশ সুন্দরী দেখতে। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ছাড়া তেমন কোনো সাজ নেই ওর। আমি নামার দুই স্টপেজ আগে নেমে গেল সে। বাসে রোজদিনের অপরিচিত অনেক চেহারার সাথে ওর চেহারাটা গুলিয়ে নিলেও ঠিক দুদিন পর গোল মার্কেট স্টপেজ থেকে ওকে উঠতে দেখে ভেতরে কেমন একটা ধুকপুকানি যেন শুরু হয়ে গেলো আমার। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে বেশ ফাঁকা বাসটা। আমার পাশের খালি সিটে এসে বসলে সৌজন্যমূলক হালকা হাসি ফুটলো দুজনের ঠোঁটে। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ততক্ষণে সোজা হয়ে বসেছি আমি। কচি সবুজ রঙের কুর্তিতে আজকে বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল ওকে। অনেক চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারছি না, তাছাড়া এতদিন এখানে কাটানোর পরেও হিন্দি উচ্চারণটা সঠিক না হওয়ায় কনফিডেন্সেরও অভাব। অসাবধানতাবশতঃ চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় ওকে জিজ্ঞেস করলাম "কাহাঁ যাওগে আপ?" উত্তর এলো "লক্ষ্মীনগর"..
সরকারি চাকরির জন্য লক্ষ্মীনগরের একটা নামি কোচিং সেন্টারে জয়েন করেছে সে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি আমার অ্যানিমেশন ইনস্টিটিউটের নাম বললাম ওকে। ওর নাম শানায়া যোশী, বাড়ি মথুরা। বড় বোনের ফ্যামিলি গোল মার্কেটে থাকে, ওদের সাথেই গত পাঁচমাস থেকে আছে শানায়া। বাস থেকে নামার সময় রোজ বাড়ি থেকে ওর বেরোনোর সময়টা আমাকে বলে যাওয়ায় নিজেকে একটু স্পেশাল বলে মনে হল আমার। তারপর রোজ দেখা হতে শুরু হল দুজনার। কয়েকদিনের দেখায় বেশ প্রগলভ হয়ে উঠেছে শানায়া। মথুরা বাঁকেবিহারী মন্দিরের গল্প থেকে শুরু করে ওর রাগী বাবার ব্যাপারে বলতে থাকে অনর্গল। আমি একটু বেশি বলতে গেলে মাঝেমাঝেই উচ্চারণটা বিগড়ে যায়, আর তাতে হাসিতে ফেটে পড়ে সে। তাতে আমি অপমানিত বোধ না করলেও লজ্জায় চুপ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ। আমার মনের অবস্থা বুঝে নিজেই সরি বলে শানায়া। ইনিস্টিটিউটে ক্লাস চলে সোম থেকে শুক্র কিন্তু ওকে দেখার জন্য শনিবারেও বাসে চড়ে বসি আমি। ফেরার সময়টা জানিয়ে দেই ওকে এসএমএস করে। ফেরার পথে ইয়ারফোনে কান লাগিয়ে শুনি "ফিরে লে আয়া দিল.." এভাবেই দিন কাটে আমাদের, একসাথে যাওয়া আসার মাস দুয়েক কেটে গেছে। শানায়ার চোখ দেখে আজকাল অনেক কিছুই পড়তে পারি আমি। রোজ ঘর থেকে ভেবে বের হই আজকেই ওকে বলবো কিন্তু বলতে গেলেই জিভ আড়ষ্ট হয়ে যায় যেন। আবোলতাবোল কথায় হারিয়ে যায় হৃদয়ের না বলা কথাটুকু। ঐদিন সকালে মেসেজের রিপ্লাই না পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফোন করলাম আমি। একটা রিং করতেই কেটে দিল সে। কি হয়েছে, কোথায় বা আছে শানায়া! প্রবল উৎকণ্ঠায় বারবার ফোনের স্ক্রিন দেখতে লাগলাম আমি। না, কোনও রিপ্লাই নেই। সারাদিন ক্লাসে মন বসলো না আমার। বেরোনোর সময় মোবাইল ভাইব্রেট করে উঠলে তাড়াতাড়ি মেসেজ পড়লাম আমি। শানায়া, বাড়ি গেছে। সাডেন হার্ট অ্যাটাক হয়ে ওর বাবা এখন হাসপাতালে আছেন। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম এলোনা আমার। পরদিন সকালে বেরোনোর পথে আবার ফোন করলাম ওকে, যদি একটু কথা হয়! ওর ফোন সুইচ্ড অফ্! আমার আর কিছুতেই ভাল্লাগছে না। ইনস্টিটিউট না গিয়ে সারা দিন বাইরে বাইরেই কাটিয়ে দিলাম। ইতিমধ্যে প্রায় শ-খানেক বার ওর নম্বর ডায়াল করেছি আমি। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। তারপর সপ্তাহ-দিন কেটে গেছে, চোখ-মুখ বসে গেছে আমার। আমাকে দেখে সেজদা জিজ্ঞেস করছে শরীর-টরির খারাপ না কি! শানায়া কি জানে ওকে কতটা ভালবাসি আমি...ওর কি একবারও মনে পড়ছে না আমার কথা! একবার ভাবলাম মথুরা গিয়ে খুঁজব ওকে, কিন্তু ওর বাড়ি কোথায় তা তো আমি জানি না। মনের কথা প্রকাশ করতে না পারাটা এখন কুরেকুরে খাচ্ছে আমায়। দুপুরে অপরিচিত নম্বরে ফোন আসলে একটা মেয়ের গলা। বললো শানায়ার বাবা মারা গেছেন, ও আর দিল্লি ফিরবে না। কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দেয় মেয়েটি। হাজার চেষ্টা করলেও ওই নম্বরে আর ফোন লাগে নি, আমার নম্বরটা বোধহয় ব্লক করে রাখা হয়েছিল।
তারপর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। প্লেসমেন্টের চাকরিটা ছেড়ে নতুন চাকরি ধরেছি, মোটামুটি ভালোই প্যাকেজ আমার। গতমাসে ক্লায়েন্ট মিট করতে সিঙ্গাপুর হয়ে এসেছি। সেজদা বিয়ে করে গুরগাওঁ শিফ্ট করেছে। আমি নয়ডা সেক্টর একাত্তরের একটা টু-বিএইচকে ফ্ল্যাটে একাই থাকি, বিয়েথা নিয়ে কথা উঠলেও মা-বাবার কথায় সাড়া দিচ্ছিনা। প্রমোশনটা পেয়ে যাই তারপর দেখা যাবে না হয়। আজকেও বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছে। কাঁধ থেকে ল্যাপটপের ব্যাগ নামিয়ে টাই ঢিলা করে এলইডি-র রিমোট প্রেস করি। টিভি চালালেই ইউপির লোকাল নিউজ চ্যানেলটি অবাধ্যের মতন খবর শোনানো শুরু করে দেয়। আজকের দিনটাও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আজকে চ্যানেল বদলাতে গিয়ে থেমে গেলাম আমি। উত্তরপ্রদেশের অপরাধের ঘটনা দেখাচ্ছে টিভিতে। শিক্ষিত পরিবারের এইসব বিক্ষিপ্ত ঘটনা মনকে সত্যিই নাড়িয়ে দেয়। দুইসন্তানের জননী মহিলাকে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে না পারায়, গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে একজন ব্যাংক কর্মচারী। ওদের বিয়ের ফটো টিভির পর্দায় ফুটে উঠতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। বধূ-বেশে সেজে থাকা মেয়েটি ছিল শানায়া, আমার প্রথম প্রেম!
Comments
Post a Comment