ঋণ
#ঋণ
॥তৃণময়
সেন॥
-- আহ!
কিদৰে চলাই আছে গাড়িখন!
বাসের
ঝাঁকুনিতে মাথাতে ঠেস লাগতেই আর্তনাদ
মিশ্রিত মৃদু রাগ ধরা
দিল তপনের গলায়। রাস্তা এতো বেশি খারাপ
যে সামনের দিকে সিট পেয়েও
তেমন লাভ নেই। এক-একটা ঝাঁকুনিতে পেটের
ভাত মুখে চলে আসার
জোগাড়। ভাগ্যিস এখন আর তার
বমি হয় না, তাহলে আর উপায় ছিল না।
মনে পড়ে একবার মা-বাবার হাত
ধরে বাসে বরপেটা থেকে
গুয়াহাটি যেতে সেই কি
বমি হয়েছিলো তার! শরীর এতোটাই
দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো যে
আট বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়েই কামাখ্যা দর্শন করতে হয়েছিল মা-বাবার। ধূসর স্মৃতিরা অজান্তেই
ঠোঁটে হাসি নিয়ে আসে।
গাড়িতে
বসার আধঘণ্টা হয়ে গেছে, কিন্তু
এখনও একটা কথাও হয়নি
এমাদুলের সাথে। করিমগঞ্জের ভাগাবাজার নিবাসী এমাদুল, বরপেটিয়া তপনের থেকে প্রায় পনেরো বছরে বড় আর কর্মক্ষেত্রে
তো মোটর পার্টসের কাজ
এমাদুলের হাত ধরেই শিখেছে
তপন। শুরুর দিনগুলোতে এমাদুলকে চাচা বলে ডাকলেও
কিছুদিন থেকে কোনো কিছু সম্বোধন
ছাড়াই রোজনামচার সামান্য কথাটুকু তপন শেষ করতে
চাইছে, তা হয়তো নজর
এড়ায়নি এমাদুলের। ইচ্ছে করেই আধবুড়ো লোকটাকে
আজকাল সে পাত্তাটাত্তা কম
দেয়। ভাবটা এমন যে এদেরকে
অনেক মাথায় তোলা হয়েছে আর
নয়, উড়ে এসে জুড়ে
বসা লোক এরা! লাড্রিমবাই
থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার
আগে মাড়োয়ারি মালিক নতুন দোকান খোলায়
আজকাল নানা কাজে নতুন ঠিকানায় আসতে
হয় এমাদুলদের। গুয়াহাটি থেকে লাড্রিমবাই আসতে
হলে দু'শো টাকা ক্যাশ
হাতে ধরিয়ে দেয় মালিক। তার
মধ্যে থেকে বাঁচাতে পারলে
সেটা তোমার, হিসাব দিতে হয় না।
ক্যান্সার
ধরা পড়ার মাস ছয়েকের
মধ্যেই তপনের বাবা মারা যায়।
এক টুকরো ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই
না থাকায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়
তার। বাপ মরা তপন
একে একে চায়ের দোকান-রাজমিস্ত্রীর সাগরেদ-ইলেক্ট্রনিক্স দোকানের কর্মচারীর পেশা ছেড়ে 'বাবুজি'র মোটর পার্টসের
দোকানে প্রায় দেড় বছর ধরে
কাজ করছে। দোকানের অদূরে একটা বস্তিতে ওর
বয়সী তিনজন বন্ধুর সাথে মেসে থাকে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে মা আর
ছোট একটা ভাই। যথেষ্ট মেহনতি হওয়ায় বাবুজি আজ ওকে এমাদুলের
সাথে পাঠিয়েছেন। শনি-রবিবার কাজ
করে সোমবারে আবার লালগণেশের দোকানে
ফিরে আসবে ওরা। এমাদুলের
দিকে আড়চোখে দেখে তপন। গাড়ির
কাঁচের ওপারে একদৃষ্টে চেয়ে আছে কাঁচাপাকা
দাড়িওয়ালা নিষ্প্রভ এমাদুল। তার ভাবলেশহীন মুখখানা
দেখে মনের নাগাল হয়তো
ঈশ্বরও পান না। ক'বছর আগে অবধি
রাজনীতির মাথামুন্ডু না বুঝলেও আজকাল
তপন অনেকটাই রাজনীতি সচেতন। "কেলা বঙালি" আর
"মিঞা"দের তাই ঘৃণার
চোখে দেখে সে। পুরো
অসমটা এরাই একদিন দখল
করে নেবে, মেসের পার্টিবাজ বন্ধু অমিত-দুলালদের কাছ
থেকে কথাটা জানতে পেরেছে তপন। বন্ধুরা এইসব
ছোটখাটো কাজ ছেড়ে তাকেও
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জন্য
জোর করছিল, কিন্তু ওখানে বেতনের মতো ব্যাপারটা নেই।
টাকা-পয়সা আছে ঠিক,
কিন্তু সেটা মরশুম না
আসলে পাওয়া যায় না। পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে এতোদিনে
দুলালদের সাথে যোগ দিত
সে। সারা জীবন কি
আর তেল-মবিল ঘেঁটে
থাকা যায়! তারও তো
একটা ভবিষ্যৎ আছে!
সপ্তাহ দুয়েকের
অনাবৃষ্টিতে গাছের পাতায় ধুলোর পরত পড়ে গেছে।
মহানগরের শেষ প্রান্তের স্ট্রিটলাইটগুলো
নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী
হলদেটে রঙ মর্তে বিছিয়ে
দিলেও, সন্ধ্যাশেষে গেরুয়া আভা এখনও থেকে
গেছে আকাশের বুকে। দিনভর ব্যস্ত শহর চারচাকা-দুচাকায়
চেপে দ্বিগুণ ব্যস্ততায় নিজ-নিজ ঠিকানায়
ফিরছে। পথের দুই পাশে কংক্রিটের
দালানের বদলে শহরতলির গাছ-ডোবা-খোলামাঠ চোখ
বুলিয়ে দিচ্ছে এমাদুলের। নতুন দোকানটায় ব্যবসা আরেকটু চাঙ্গা হলেই লালগনেশ থেকে লাড্রিমবাই বদলির জন্য বাবুজিকে অনুরোধ করবে বলে ভেবে রেখেছে এমাদুল। দশ বছর হতে চললো মোটর পার্টসের দোকানটাতে কাজ করছে সে, আশা করি মানা করবেন না বাবুজি। শিলচর-করিমগঞ্জের বাসগুলো এই রাস্তা হয়েই ফেরে, এখান থেকে বাড়ি যেতে টাকা বা সময় দুটোই কম লাগবে তার। ছেলেমেয়ের স্কুলের যা খরচা, প্রত্যেক মাসে টাকা জমানোর নতুন পথ খুঁজতে হবে তাকে। শহরতলি ছেড়ে জঙ্গলের আঁকাবাঁকা পথ ধরেছে রাজ্য পরিবহন নিগমের পুরোনো বাসখানি। সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে শীতলতর হয়ে যাচ্ছে হেমন্তের কর্পূরমাখা হাওয়া। খানাপাড়ার আরও কিছুটা আগে থেকে বাস ধরায় দুইজনেই ভালো সিট পেয়ে গেছে। এমন রাস্তায় পিছনে সিট পেলে আর রক্ষে ছিলো না। গাড়ির পিছনদিকে সামান্য ঝাঁকুনিও তীব্র বলে মনে হয়। চাকার নিচে মাঝারি সাইজের গর্ত বা পাথর তপনদের পশ্চাদদেশকে শূন্যে দোলা খাইয়ে আবার যথাস্থানে বসিয়ে দিচ্ছে। সাদা মেঘের আস্তরণে ঘেরা চাঁদের হালকা আলোয় দূরের বড় গাছগুলোকে দৈত্যের মতো লাগছে দেখতে। পাতলা চাদর দিয়ে গা জড়িয়ে নেয় এমাদুল। পাশের সিটে ঘুমন্ত তপনের মাথাটা হেলে ওর কাঁধের উপরে এসে গেছে। শীত নিবারণের একমাত্র হাতিয়ার বলতে ফুলহাতা শার্টের গলার বোতাম লাগিয়ে সাদা গামছাখানা দিয়ে কান-মাথা মুড়িয়ে রেখেছে তপন। আলতো করে মাথাটাকে সোজা করে নিজেও সামান্য ঘুমানোর চেষ্টা করে এমাদুল।
"বাংলাদেশি
মিঞা" টিটকিরিটির সাথে অভ্যস্ত হয়ে
গেলেও হালফিলের উগ্র ছেলে-ছোকরাদের
দেখলে যে মনে ভয়ের সঞ্চার
হয়, তা অন্তত নিজের
কাছে অস্বীকার করতে পারে না
এমাদুল। পরিস্থিতি যেন আবার আগের
মতো হয়ে যাচ্ছে। রাতবিরেতে বাড়ি ফেরার পথে
তিন-চারটে বাইক একসাথে দেখলে
গা ছমছম করে ওঠে।
হয়তো কিছুটা এই কারণেই মহানগর
ছেড়ে আসতে মন চাইছে
তার। জঙ্গলে ঘেরা একটা এলাকায়
বন্য প্রাণীদের ভয় থাকলেও মানুষরূপী
গিরগিটিদের থেকে দূরে থাকা
যাবে!
রাত আনুমানিক সাড়ে
দশটার দিকে দোকানে পৌঁছে
যাওয়ায় কথা। দুইজন কর্মচারীর
সাথে স্থানীয় একটা লোক ওদের
জন্য অপেক্ষায় থাকবে। গাড়ির ভিতরে লাইট জ্বলে ওঠায়
চোখ খুলল এমাদুল। "কোই
বাথরুম যায়গা তো যাও" দরজা
খুলে সামনে থেকে বাস কন্ডাক্টর
চেঁচিয়ে বলল। একই রুটে
এতো বছর সফরের অভিজ্ঞতায়
বাসের চালক-কন্ডাক্টরদের মধ্যে
একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছে এমাদুল। এদের মুখের ভাষা
জায়গা অনুযায়ী বদলে যায়। গুয়াহাটি
থেকে শিলচর যেতে শুরুটা হয়
অসমীয়া দিয়ে, মাঝপথে হিন্দি আবার শেষ হয়
সিলেটি দিয়ে; আবার ফেরার
পথে উল্টোটা। মানে এরা আইসিবিটি-খানাপাড়ায় গাড়িতে অসমীয়া ভাষায় কথা বলে, মেঘালয়-লাড্রিমবাইয়ে ভাঙা হিন্দি আবার
রাতাছড়া পেরোতেই নিখুঁত সিলেটিতে কথাবার্তা শুরু করে দেয়।
এটা কি নিছকই যাত্রীদের
টানার কৌশল নাকি তার
ভিতরে অন্য ব্যাপার আছে, বুঝে উঠতে পারে না
সে। তবে এটা বুঝতে
পারে যে গন্তব্য আর
বেশি দূরে নয়।
মিনিট
পাঁচেক পরে বাস চলতে
শুরু করলে মেরুদণ্ড সোজা
করে বসে এমাদুল। আঁকাবাঁকা
পাহাড়ি পথে দুলে দুলে
চলছে বাসখানি। পথের প্রতিটি বাঁকের
নকশা যেন চালকের নখদর্পণে। ঠিক মেপে মেপে এগিয়ে
নিয়ে চলছে গাড়িটিকে। বিপরীত
দিকের বড় গাড়িগুলো গা
ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর আধঘন্টার মধ্যে
গন্তব্যে পৌঁছে যাবে, তাই ব্যাগগুলো
উপর থেকে নামিয়ে রেখেছে
সে। ঘুমে কাদা তপনকে
পাঁচ-সাত মিনিট পরে
জাগিয়ে দিতে হবে। স্টপেজটা
কন্ডাক্টরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়ায় কোনো অসুবিধা হবে
বলে মনে হয় না।
হঠাৎ তীব্র ঝটকায় কাঁচের জানলার উপরে আছড়ে পড়ে
এমাদুল। বাকি সব যাত্রী
ওর গায়ের উপরে এসে পড়েছে।
প্রচন্ড চিৎকার-চেঁচামেচির কয়েক মিনিট পরে একসাথে দু-তিনটে টর্চের আলো দেখতে পেল
এমাদুল। বিপরীত দিক থেকে আসা
একটা বেসামাল ট্রাক বাঁক নিতে গিয়ে
নাকি ওদের বাসের পিছনে
ধাক্কা মেরেছে। বাসের সামনের দুই চাকা রাস্তার উপরে থাকলেও পিছন
দিকটা পথ থেকে সরে
গিয়ে একটা গাছের গায়ে
সজোরে ধাক্কা খেয়েছে। ঝরঝর করে ভাঙা
কাঁচ ঝরার শব্দ শুনতে
পায় এমাদুল। কানে কাঁচ ঢুকে
যাওয়ার প্রচন্ড ব্যথায় বাকি চোটটা ঠিক
কোথায় লেগেছে বুঝতে পারে না সে।
শরীরটাকে টেনে বের করে
তপনকে আলো আঁধারির মাঝে
খুঁজতে থাকে। ঐতো পিছনে সিটের
নিচে পড়ে আছে তপন।
দৌঁড় দিয়ে তপনকে তোলার
চেষ্টা করে এমাদুল। টর্চের
আলোতে তপনের মুখ দিয়ে গড়ানো
রক্ত দেখে চিৎকার করে ওঠে সে।
দুইদিন
পরে আজকে চোখ খুলেছে
তপন। মাথার পাশে বসে থাকা
ওর মা ছেলেকে জ্ঞান
ফিরতে দেখে ফুঁপিয়ে ওঠে।
ভাঙা বাম হাতটা সযত্নে
ওর বুকের উপরে রাখা হয়েছে।
হাঁ করা মুখে ডান হাতখানা লাগাতে
গেলে নার্স মানা করে ওকে।
সামনের দুটো দাঁত পড়ে
গেছে, পাঁজরেও নাকি ভালো চোট
পেয়েছে সে। গা'টা
জ্বর জ্বর লাগছে তপনের।
খানাপাড়া থেকে বাসে বসার
কিছুক্ষণের পরে আর কিছুই
মনে করে পারছে না।
সাদা বিছানা, সবুজ পর্দার সাথে
ঔষধ ঔষধ গন্ধ অস্থির
করে তোলে তাকে। "লেটে
রহো, অভি উঠনে কা
কোশিশ মত করনা" নির্দেশ
দিয়ে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেলো পাহাড়ি নার্সটি।
মা আলতো করে হাত
বুলিয়ে দিচ্ছে ওর মাথায়। পুরো
শরীর জুড়ে তীব্র ব্যথা
অনুভব করে তপন। নার্সের
সাথে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢোকে এমাদুল।
একটা কান ব্যান্ডেজে বাঁধা
তার। ঐদিন আরও দুইজনের
সাহায্যে এমাদুলই নাকি তপনকে এই
সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। প্রচুর
রক্তক্ষরণ হওয়ায় দোকানের স্থানীয় কর্মচারীটি ওর জন্য রক্ত
দিয়েছে। ফোন করে লালগনেশে
জানানোর পরে বাবুজি তপনের
মা'কে ডেকে পাঠিয়েছেন।
এমাদুলের উদ্দ্যেশ্যে কিছু একটা বলতে
চাইলে বলতে পারে না
তপন। হাত তুলতে নিলে
সামনে থেকে বাধা দেয়
এমাদুল। দু-পা এগিয়ে
এসে তপনের সামনে দাঁড়ায় এমাদুল। তপনের চোখের জল কানের লতি
বেয়ে বালিশে গড়িয়ে পড়ে। জানালাটা খুলে
দিয়েছে নার্স। কুয়াশা কাটিয়ে আসা নবীন সূর্যের
আলো রড বেয়ে তপনের
গায়ের সাথে সাথে মনটাকেও
ধুয়ে মুছে সাফ করে
দেয়।
Comments
Post a Comment