বানভাসি
#বানভাসি
-- ও
কাক্কি.. কাক্কি.. এরে জল্দি ওঠো।
পুলর সামনে ডাইল চাউল দের
গো।
সাত-আট বছর বয়সী
রিনার ডাকে তন্দ্রা ভাঙলো
চল্লিশোর্ধ্ব সুরমার। সারা শরীরে ব্যথা।
গত দু'দিন থেকে যা খাটুনি
গেছে, তা এই স্কুলের
সব নব্য যাযাবর শরণার্থীরা
জানে। রংঘরের রবিদাস পাড়ার পাঁচ-সাত পরিবার
সোনাপুর পাবলিক স্কুলে, বাকিরা বিক্রমপুর হাসপাতাল আর হাইস্কুলে আশ্রয়
নিয়েছে। গত কয়েক ঘন্টায়
বৃষ্টি না হলেও জল
নাকি প্রতি ঘন্টায় প্রায় এক হাত করে
বাড়ছে। স্কুলের সামনের মুদির দোকানি রহমত আলীর মুখে
কথাটা শুনে কালো মুখে
ধূসর মেঘ জমা হয়
সুরমার।
-- ইতা
কইয়ো না বা রকমতচ্চা।
আমার ঘর থুড়া উঁচা থাকায় লালিরে ঘরো বান্ধিয়া থইয়া
আইছি। ইলা পানি বাড়লে
তো উপায় নাই।
শিরিষ
গাছের তলায় বসে পড়ে
সুরমা। গত মাঘ মাসে
দুটো পাঁঠা বিক্রি করে বাবুরবাজার থেকে
কিনে নিয়ে এসেছিলো লালিকে।
গরুটিকে বেঁধে চলে এসেছে জেনে
নৌকায় বসে ওকে উপদেশ
দিচ্ছিল পাড়ার নিমাই বুড়ো।
-- তুইন
বেটি বেআন্তাজ! ওলা বাদলিত গাই
আবার ঘর বান্ধিয়া আইননি!
এক তো পানি বাড়ের
আর ইলা মেঘর দিন
চুরি-চামারিও বড় জবর অয়।
গভীর
চিন্তার সমুদ্রে ডুবে যায় সুরমা।
গরুটা কি তাহলে ছেড়ে আসা
উচিত ছিলো! চারদিকে তো
জল আর জল, লালি
যেত কোথায়! সারা গ্রাম তো
তছনছ হয়ে আছে, পরে
যদি আর বাড়ি আসতে
পারে না লালি! নাহ,
আর ভাবতে ভালো লাগছে না।
শংকর নিরুদ্দেশ হওয়ার বারো-তেরো
বছর হয়ে গেল। ডিমাপুর
যাওয়া ওই দিনমজুরের দল
থেকে একজন ছাড়া বাকি
কেউই ফেরেনি আজ অবধি। ও
জানে আর কোনোদিন ফিরে
আসবে না, তবুও মন
মানতে চায় না। গ্রামের
লোকে অনেক কিছু বললেও
সধবার বেশ ছাড়েনি সুরমা।
লোকে বলে একযুগ ধরে
বেপাত্তা হয়ে থাকলে তাকে
নাকি মরে যাওয়াই ধরা
হয়। আর তাই নাকি
তার সধবা হয়ে থাকাটা
ঠিক নয়। সুরমা এইসব
কথা কোনোদিনই কানে তোলেনি।
সব যুক্তি-তর্ককে মিথ্যা করে যদি শংকর
হঠাৎ এসে সামনে দাঁড়ায়,
তখন কি তাকে বিধবার
বেশে দেখে সইতে পারবে
সে! তাই সুরমার কপালে
ইয়া বড় লাল টিপ,
সিঁথি সিঁদুরে রাঙানো। কয়েকদিন আগে এনআরসির নোটিস
পেয়েছে সুরমা। কাগজপত্র নিয়ে এনআরসি কেন্দ্রে
যেতে হবে, কিন্তু সুরমার
কোনো হেলদোল নেই। গ্রামের লোক
বলে..
--যাও
বেটি, বাদে টের পাইবায়
যখন পুলিশে ধরিয়া লইয়া যাইব.. আর
কাগজ না থাইকলে বাংলাদেশ
পাঠাইব।
সুরমা
বলে -- কাগজ-কুগোজ নাই
বা আমার..পাঠাইলে পাঠাউক বাংলাদেশ..অনো কষ্ট করি
কামাই খাই.. হনো গেলে অলাউ
থাকমুনে.. খালি লগে আমার
লালিরে পাঠাইলেউ অইলো।
প্রান
খুলে হাসে সুরমা... চারপাশ
সুপুরির কণা বাধানো খয়েরি
রঙের দাঁত দেখা যায়।
মায়ের মুখে শুনেছে কানাইঘাট
থেকে সুরমা নদীর পার হয়ে
রোজ জুতো সেলাই করতে
এইপারে আসত ওর বাবা
বসন্ত রবিদাস। বাপকে সুরমার মনে নেই.. এখন
ভাবে কত জোয়ার-ভাঁটা,
শীত-গ্রীষ্মে এই নদী পার
হয়ে হয়তো আসতে হতো
ওর বাপকে, তবুও এই নদীর প্রতি
এতটাই টান-ভালোবাসা যে
নিজের মেয়ের নামটাই সুরমা রেখে
দিল।
--এরে
চাচি তুমার খের লাগলে নিও।
আমরা আইতে সময় বাক্কা
খের আনছি।
বেশ
কয়েকটা মুসলিম পরিবারও আজকে সকালে এখানে
আশ্রয় নিয়েছে। তারাই সুরমার চটের বস্তার ভেতর
কিছুটা শুকনো খড় ঢুকিয়ে দিল।
--তুমরা
কান থনে আইছ? জিজ্ঞেস
করে সুরমা।
--আমরা
গাংপার থাকি আইছি গো
চাচি। পানি বাড়ের তো।
ঘরো-উন্দালো হাঁটু-পানি থইয়া আইছি। আর
থাকা ঠিক অইতো নায়।
এমতেউ আমরা গাউর এক
বুড়া বেটি ভাঙা ঘরোর
তলে পড়িয়া মরছে।
বাঁশ-বেতের ঘর সুরমার। ঘরের
লাগোয়া খড়ের বাথান। ভেঙে পড়লে
লালিটা বেরোবে কেমন করে! যদিও
গত শীতে নিজের থাকার
ঘরে কোনো কাজ না
করালেও লালির আবাসে নতুন খুঁটি লাগিয়েছে
সে। শোবার ঘরে বৃষ্টি হলে
আধপচা শন চুঁয়ে দুই
জায়গায় জল পড়ে। একটা
ইন্দিরা আবাসের জন্য কত দৌঁড়ঝাপ
না করল, তবুও কিছুতেই
কিছু হলো না। পঞ্চায়েতবাবু
তো বলেছিলেন "এসসি লিস্টও তুমার
নাম তো আছে, পাওয়া
তো উচিত"। টাকা-পয়সা দিতে অপারগ থাকায়
"আইচ্ছা একসের দুধ পাঠাইও, দেখি
কিতা করা যায়" বলে
আজ অবধি কিছুই করে
উঠতে পারেননি পঞ্চায়েতবাবু। উল্টে
মাসখানেক পরে ওনার গিন্নি
বলেন "আইলে তো চা
খাইয়া যাও গো, কিন্তু
তুমার দুধ ইতাত অতো
পানি মিলাও কেনে! আমার বাইচ্চাটা খাইতেউ
পারে না.."
কোনো
উত্তর না দিয়ে চায়ের
কাপটা পুকুর থেকে ধুয়ে এনে
দিয়ে চুপচাপ চলে এসেছিল সুরমা।
নিজের পাড়া ছাড়া সব
জায়গাতেই চা খেলে কাপ
ধুয়ে এনে দেওয়ার অভ্যেসটা
ছোটবেলা থেকেই মা করিয়ে রেখেছিল।
আর ওর এই দুধ
বিক্রির উপার্জনটা যে কতটুকু সৎ,
সেই ব্যাপারে কারও কাছে জবাবদিহি
করতে হলে তা মোটেই
পছন্দ নয় সুরমার।
--আমরা
এখন যাইমু গো নাও লইয়া,
তুমার বাড়িও দেখিয়া আইমু নে।
পাড়ার
যুবক নারায়ণের কথায় যেন একটু
আশার আলো খুঁজে পায়
সুরমা। রংঘরের উদ্দেশ্যে ওরা দু-তিনজন যাচ্ছে নৌকা নিয়ে। লোকাল
ক্লাবের ছেলেরা এসেছে চা আর নোনতা
বিস্কুট নিয়ে, সবাই এটাই লুফে
নিচ্ছে। সুরমা নিজের বিস্কুটটা মুসলিম বাচ্চাটাকে দিয়ে দিল। বাচ্চাটা
জ্বলজ্বল চোখে ওর দিকে
চেয়ে ছিল। আহারে সারা
দিন হয়তো কিছু খায়নি
বেচারা। শংকরের সাথে সাড়ে চার
বছরের সংসারে সন্তানমুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি সুরমার। তা
নিয়ে মরার আগের দিন
পর্যন্ত শাশুড়ি কম কথা শোনাননি
সুরমাকে। বাঁজা-নটি থেকে শুরু
করে যা কিছু মুখে
আসে। অথচ স্নান করিয়ে
দেওয়া থেকে শুরু করে
সন্ধ্যার পর কুপি বাতি
নিয়ে প্রস্রাব করানো পর্যন্ত সবকিছুতেই সুরমা ছাড়া চলতো না
বুড়ির। হাজার অপমানের পরেও মুখ ফুটে
কোনোদিন কিছু বলেনি সুরমা।
রাতে
রান্না করার জন্য শুকনো
কাঠ-খড় কিছুই পাওয়া
যাচ্ছে না। অঝোর বৃষ্টিতে
সবকিছু ভিজে পড়ে আছে।
ওদিকে আবার কেরোসিনের মশাল নিভু নিভু হয়ে
আসছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলে ভালো।
অগত্যা সবাই নিজের বিছানার
নিচ থেকে একটু একটু
করে শুকনো খড়ের যোগান দেয়।
আলাদা আলাদা করে উনুন ধরানো
যাবে না, তাই হিন্দু-মুসলিম সব পরিবারগুলোর জন্য
রান্নার দায়িত্ব বর্তায় সুরমার ওপর। হাসিমুখে রাজি
হয় সুরমা। বাড়ন্ত জল ততক্ষণে স্কুলের
বারান্দায় এসে পৌঁছেছে। এই
আশ্রয়স্থানটিও আর বেশিক্ষণ নিরাপদ
নয়। পুরুষরা রাতের বেলা জেগে থেকে
পরিস্থিতি দেখভাল করবে। এই আস্তানায়ও জল
ঢুকে পড়লে তার পরের
ঠিকানা কি হবে, তা
এক্ষুণি কেউ বলতে পারবে
না। ইতিমধ্যে নারায়ণরাও ফিরে এসেছে।
--তুমার
ঘরর তরজার বেড় আফালে ভাঙ্গি
গেছে গো কাক্কি, আর
তুমার গাইও দেখলাম না!
ভাবলেশহীন
মুখে সুরমাকে জানায় নারায়ণ। সুরমার মুখে কোনো কথা
নেই। ক্ষিপ্রবেগে সবার জন্য
পাতে খাবার বাড়ছে সুরমা। সবাইকে খাওয়াতে হবে, জল যেভাবে
বাড়ছে তাতে নিরাপদ আশ্রয়ের
খোঁজে যেকোনো সময় আবার হয়তো
বেরিয়ে পড়তে হবে... রাত
ঘনিয়ে আসছে যে।
Comments
Post a Comment