ভালবাসা কারে কয়

|| তৃণময় সেন||
কার্তিক সংক্রান্তি দোরগোড়ায় থাকলেও শহরের আকাশটা আজ আমার মতনই গোমড়ামুখো হয়ে আছে। এভাবে হুট করে এর আগে বাড়ি আসিনি আমি। 'তোর হয়েছে টা কি?' মা জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে বাহানায় ল্যাপটপ হাতে তুলে নিয়েছি। অ্যান্ড্রয়েড/ল্যাপটপ হাতে নিয়ে আমরা প্রায়ই তো মা'র মতন পুরোনো, সেকেলে মানুষদের ফাঁকি দিয়ে থাকি... কথাটা ভেবে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল আমার। কি বলব, কেমন করেই বা বলব যে আমার কি হয়েছে, কেন না জানিয়ে হঠাৎ সকালের ফ্লাইটে বাড়ি চলে এসেছি!
অনন্যা রয় ওরফে অনুকে আমি প্রথম দেখেছিলাম কলেজে সিনিয়র-জুনিয়র পরিচয়পর্বের দিনে। কলেজে আসা নতুন সবাই এক-এক করে সিনিয়রদের সামনে নিজের পরিচয় দিচ্ছিল। গানকে হবি হিসাবে বলায় অনুকে যেকোনো একটা রবীন্দ্রসংগীত আইটেম সং 'বিড়ি জ্বালাইলে'র সুরে গাইবার টাস্ক দিয়েছিলাম আমি। গানের গলা ভীষণ ভালো ছিল অনুর। সেদিন দুলাইন গাইবার পর ওকে থামিয়ে দিলেও সেবছর বসন্ত উৎসবে অনুর গলায় "আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে..." শুনে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম আমি। বন্ধুত্বের হাত আমার 'রেডিও ফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স' ডিপার্টমেন্টের এক বান্ধবীর মাধ্যমে ওর কাছে পাঠিয়েছিলাম। কাজটা বেশ কঠিন মনে হলেও বেশ সহজেই অনু বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিল আমায়। আপাতদৃষ্টিতে চাপা স্বভাবের অনু দিনে দিনে আমার কাছে ওর প্রিয় হলুদ গোলাপের সুগন্ধের মতন প্রগলভ হয়ে উঠেছিল। ক্লাসের ফাঁকে, পথের বাঁকে ওর গলায় "কতবার ভেবেছিনু/একটুকু ছোঁয়া লাগে/মায়াবন বিহারিণী" গানগুলো আমাদের হৃদয়ে প্রেমের রংটাকে আরও গাঢ় উজ্জ্বল করে দিয়েছিল।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দিল্লিতে একটি প্রাইভেট নিউজ চ্যানেলে চাকুরী পাবার পরেই সোজা অনুদের বাড়ি গিয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম আমি। আমার পরিবারে কোনো অমত না থাকলেও অনুর বাবা মেয়ে বিয়ের জন্য সরকারি চাকুরীওয়ালা ছেলে চাইছিলেন। যদিও মেয়ের জেদের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল ওনাকে। বিয়ের পর নয়ডা ফিল্ম সিটি'র অদূরে জলবায়ু বিহারে ভাড়া থাকতে শুরু করেছিলাম আমরা দু'জন। দিল্লির মত বড় শহরের সাথে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধাই হয়েছিল সাহিত্যে স্নাতক অনুর। কয়েকমাস পরে ওর শরীরে ডেঙ্গু ধরা পড়ায় সব কিছু ছেড়ে প্রায় দিন দশেক হাসপাতালেই ছিলাম আমরা। প্লেটলেটস কমে যাওয়ায় প্রবল উৎকণ্ঠায় কয়েকটা দিন কাটিয়েছি। আমার ভালবাসামাখা শুশ্রূষায় ধীরে ধীরে সেরে উঠেছিল অনু। বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলে পা কাঁপায় বেশ কিছুদিন ভারী কোনো কাজ করতে দেইনি ওকে। বাড়ি ফেরার সময় পথের মোড়ের ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে হলুদ গোলাপ নিয়ে যেতাম ওর জন্য। ছোট ছোট ব্যাথা, হৃদয়ের কথা বুঝতে পারার নামই তো প্রেম। অফিসের পাশাপশি আমাকে ঘর সামলাতে দেখে অসুস্থ শরীরেও ভরা চোখে আমায় গান শোনাত অনু "মম হৃদয় রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া...."
আমি অফিস চলে গেলে সারাদিন একা কাটানো ছাড়াও স্বাবলম্বী হবার ইচ্ছেটা বরাবর ছিল অনুর। একটা কোম্পানিতে শর্টলিস্ট হয়ে গেলেও রোটেশনাল শিফ্ট টাইমিংয়ের জন্য জয়েন করেনি সে। ওর ব্যাকুলতা দেখে আমার অফিসে কন্টেন্ট ক্রিয়েশন অ্যান্ড ভ্যালিডেশন ডিপার্টমেন্টে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। প্রাইভেট কোম্পানিতে পেশাদারীত্বের সাথে টিকে থাকার কৌশলগুলো শিখিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। কাজের ততটা চাপ না থাকায় বেশ ভালোই কাটছিল আমাদের দিনগুলো। সময়ের সাথে সাথে কাজে বেশ পটু হয়ে উঠেছিল অনু। গান, বাড়ি, পুরোনো দিনের কথার বদলে অফিসের আলোচনা আমাদের ডাইনিং/বেডরুম দখল করে নিল। শোবার আগে প্রায়ই ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশন, রিপোর্টস তৈরি করে নিত অনু। কাজের প্রতি ওর এই একনিষ্ঠতা ভাল লাগত আমার। কিন্তু আশ্চর্য সেদিন হয়েছিলাম যেদিন দিওয়ালি পার্টিতে সবার সামনে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘোষণায় নতুন পাঁচজন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের লিস্টে থার্ড নামটি ছিল অনন্যা রয়।
অনুর এই পদোন্নতিতে খুশিই হয়েছিলাম আমি। এই সফলতা আমার অনুপ্রেরণার জন্য এসেছে বলে সবাইকে বলত সে। কিন্তু কখনো দেরি করে আসা তো কোনো উইকেন্ডে অফিস করাতে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বিরক্ত হতে লাগলাম আমি। চাকরি তো আমিও করছি তাই বলে এতো অফিস অন্তঃপ্রাণ তো কোনোদিন হই নি! সারা সপ্তাহ কাজ করার পর ছুটির দিনটি একা একা কাটানোর রাগটা অনুর ওপর ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও নিজেকে ঠিক সামলে নিচ্ছিলাম। কিন্তু দু'দিন আগে গায়ে জ্বর ভাব থাকায়, কয়েক ঘন্টা আগে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম আমি। একটা জরুরি মিটিং শেষ করেই বাড়ি চলে আসবে বললেও সেদিন রাত ন'টায় বাড়ি ফেরে অনু। পরদিন সকালে আবার তাড়াতাড়ি চলে আসবে বলে বেরিয়ে গেলেও আমি আর ওর আসার অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়েছিলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
গায়ে জ্বর ছেড়ে দিলেও তপ্ত হৃদয়ে আজ ভাবছিলাম সেই রঙ্গিন দিনগুলোর কথা। বৃষ্টি, নদী, কুয়াশা, সবুজ - সবই তো ছিল আমার এই ছোট শহরে। নিজেকে চেনা, হারানো দুটোই এই শহরের বুকে হয়েছিল আমার। যে টানাটানা চোখদুটোতে নিজেকে হারিয়েছিলাম সেই চোখ আজ আর আমার মনের ফ্যাকাসে রংটা ধরতে পারেনা। সাইলেন্ট মোডে রাখা ফোন হাতে নিলে তাতে বাহান্নটা মিসকল আর সতেরটা আনরিড মেসেজ দেখে বালিশের পাশে উল্টে রেখে দিই আমি। রাতে খাবার শেষ করে শুতে গিয়ে ধীরপায়ে আমার ঘরে বাবাকে ঢুকতে দেখে বসে পড়লাম। হাতের লাঠিটা দাঁড় করিয়ে রেখে বিছানায় বসে পড়ল বাবা।
--কি রে শুয়ে পড়েছিলি?
--না বাবা, শোব কিছুক্ষন পরে। এগারোটার আগে ঘুম কোথায় আসে!
একগাল শুকনো হাসি হেসে বাবার দিকে চেয়ে দেখলাম আমি। এলইডির আলোয় মুখের বলিরেখা দিনের মতনই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বসার ঘরে টাঙ্গানো মা-বাবার বিয়ের ফোটোটায় শশী কাপুরের মতন বাবার কানঢাকা চুলের জায়গায় এখন ক'গাছা মাত্র চুলের ফাঁকে চকচকে মাথা দেখা যায়। ঠান্ডা ততটা না পড়লেও দুর্বল বৃদ্ধ শরীরে চাদর জড়িয়ে রয়েছে বাবা। আমার দিকে চেয়ে মনের ভাবটা যেন পড়ে নিল।
-- দ্যাখ্ বাবা, তুই হঠাৎ করে কেন এসেছিস, এসেছিসই যখন বৌমাকে আনলিনা কেন, মনমরা হয়েই বা কেন আছিস এসব কিছুই জিজ্ঞেস করব না। শুধু এটাই বলতে চাই যে সংসার জীবনটা বুঝতে পারলে খুব সহজ আর না বুঝলে তার থেকে জটিল আর কিছুই নয়। আজ বত্রিশ বছর হল তোর মা-আমি একসাথে আছি। মতের অমিলে ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি করে থাকলেও, মনের অমিল কখনোই হয়নি। নিজেকে তার জায়গায় রেখে ভাবতে শিখলেই সব মুশকিল আসান হয়ে যায়। একটা স্থায়ী আর দৃঢ় সম্পর্কের নাম বিবাহ কিন্তু তাতে নিজেকে স্বামী বা স্ত্রী ভেবে মনে অধিকারবোধের সাম্রাজ্য গড়ে নিলে অশান্তি দানা বাঁধতে শুরু করে। পরষ্পরকে বন্ধুর মতন ভাবতে পারলে ছোটছোট ত্রুটিগুলো সহজে চোখে পড়ে না। আর ভালবাসা, তা তো রামধনুর মতন। সময়ের, বয়েসের সাথে সাথে রং বদলায়। জীবন আকাশের ক্যানভাসে সব রংয়েরই গুরুত্ব সমান। কালো মেঘ, ঘন কুয়াশাতে ঢেকে গেলেও আকাশের রংটা কখনও হারিয়ে যায় না, সাময়িক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে আমাদের মাথার উপর সেই চিরপরিচিত নীলাভ সামিয়ানা ফের মেলে ধরে। একটু গভীরে ভেবে দ্যাখ্ , সব ঠিক হয়ে যাবে।
পিঠ চাপড়ে লাঠিতে ভর উঠে দাঁড়াল বাবা। এভাবে কোনদিনও কথা বলেনি আমার সাথে। ঠকঠক করে এগিয়ে গেলে তার দীর্ঘ প্রতিচ্ছায়া ঢেকে নিলো আমায়। নিজেকে আঁকাবাঁকা পথে খুঁজতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাই নি।
চোখে আলো পড়তেই রাত পোহালো আমার। মা জানালাগুলো খুলে দিয়ে গেছেন। গায়ের চাদর সরিয়ে গ্রিলের সামনে গিয়ে বাইরের জগতে চোখ রাখলাম আমি। রাতের হালকা বৃষ্টির ফোঁটা পাতার ধুলো ধুয়ে দিয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে কুয়াশার চাদরে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া দূরের পাহাড়টা আজ স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে। এক কাঁধে গামছা আর আরেক কাঁধে বাক্সের চারদিকে গোলাপি শনপাপড়ি বেঁধে সাতসকালেই ডমরু বাজিয়ে বেরিয়ে পড়েছে শনপাপড়িওয়ালা। রোদ সোজা গায়ে এসে পড়ায় একটু সরে বসল বাবা। আজকে বৃহস্পতিবার, মা পুজো না দিয়ে কিছু খাবে না। চায়ের টেবিলটা রোদে থাকলেও মায়ের চায়ের কাপটা প্লেট দিয়ে ঢেকে দিলো বাবা। আমি জানি, প্রত্যেক বৃহস্পতিবারের মতনই "মোটেই ভাল হয়নি" বলে চা'টা শেষ করবে মা। ভালবাসা বুঝি একেই বলে... অনুর কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। গত ছয়মাসে একটাও হলুদ গোলাপ নিয়ে যাইনি ওর জন্য। বাইরে কাজের ইচ্ছে থাকলেও সোজা মনের অনুকে তো ছল-কৌশল শিখিয়ে কর্পোরেট জগতের যোগ্য বানিয়েছি। পুরোনো হারমোনিয়ামটার ফটো তুলে ওএলএক্সে আমিই আপলোড করেছিলাম। ফোনে রেকর্ড করে পাঠানো গানগুলো ফরমেট করার আগে একবারও তো ভাবিনি যে এই গানগুলোর হাত ধরেই দুটো মন এক হয়ে গিয়েছিল। অপরাধবোধ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে আমায়। "মা, আমি বিকেলেই চলে যাব" বলে ফোনটা হাতে তুললাম আমি।
ফোন করার সাহস না করতে পারলেও, হোয়াটসএপে মেসেজ দেখে সব কিছু বুঝে ফেলেছিলাম আমি। এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাব বুক করে বাড়িতে গিয়ে কলিং বেল বাজানোর মিনিটদুয়েকের মধ্যে দরজা খুলল অনু। ওকে এভাবে বাড়িতে পেয়ে যাব ভাবিনি।চোখের নিচে ফুলে যাওয়ায় অসুস্থ দেখাচ্ছে ওকে। আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতে তিনদিনের ছুটির সাথে ঘরখানা লাল-হলুদ থিমে সাজিয়ে সেই পুরানো আমিকে ফিরে পেতে চাইছিল অনু। সারপ্রাইজ দেবার জন্য আমাকে কিছুই বলে নি, ঘর সাজানোর জন্য আর্টিস্টদের সাথে কথা বলে ফাইনাল করে রেখেছে। পুরোনো আলব্যামের সব ফটো বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমার ছোট শহরের দোকান থেকে নেওয়া চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া হলুদ গোলাপ হাতে নিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে অনু। গোলাপের আড়ালে আমাদের দূরত্ব আর দেখা যায় না। অনেকদিন পর আবার গুনগুনিয়ে উঠে অনু "যদি আর কারে ভালবাসো/যদি আর ফিরে নাহি আসো/তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও/আমি যত দুঃখ পাই গো/আমার পরান যাহা চায়.... "

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন