আত্মহনন

।।তৃণময় সেন।।

ডেস - পা - সিতো।
দুর্বোধ্য গানের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারেন না মৃগাঙ্কশেখর। ডান হাতের তর্জনী আর কনিষ্ঠা উঁচিয়ে দাদুর ঘরে ঢোকে মিকি। শীত-গ্রীষ্ম নির্বিশেষে তার মাথায় শোভে উল্টো টুপি আর বিশাল আকৃতির টি-শার্ট, যা কোমরের আধা হাত অবধি প্রসারিত হয়ে নিম্নদেশে কিছু পরিধান করার যাবতীয় প্রয়োজনীয়তাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিচ্ছে।
-- "It has been extended for two more weeks দাদাই। কোত্থাও বেরোবে না। ঘরে থাকো, চিল করো।"
আশঙ্কা সত্যি হলো। দেশে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। অবশ্য লক ডাউন খুলে গেলেও, মৃগাঙ্কশেখরের বাইরে যাওয়াতে অনির্দিষ্ট কালের স্থগিতাদেশের হেরফের হতো না। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর এই ঘাগু অফিসার মৃগাঙ্কশেখর বসু কাউকে পরোয়া করেননি জীবনে, কিন্তু প্ল্যাটিনাম জুবলী উদযাপনের তিন দিনের মাথায় বাথরুমে পড়ে গিয়ে লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ার পর থেকে পরজীবীর এই জীবন আর সহ্য হচ্ছে না তার, এবার মরণই বাঁচার একমাত্র রাস্তা। সারাদিনে এক-ঘন্টা পার্কে বেড়ানো বন্ধ হওয়ার দুইমাস হয়ে গেছে। সংক্রমণের খবর পেতেই হুইল চেয়ার ভাঁজ করে রেখে বিট্টুকে আসতে মানা করেছে ছেলে মৃন্ময়।
একটা রুটি আর দু'মুঠো ট্যাবলেট-ক্যাপসুলে রাতের বেলা দিব্বি পেট ভরে যায়। ওয়াকার স্ট্যান্ড ও ছেলের সাহায্যে কোমডে বাথরুম সারেন মৃগাঙ্ক। তারপর বড়জোর চার ঘন্টা ঘুমের পর শুরু হয়ে যায় আলো ফোটার অপেক্ষা। অপ্রার্থিত সকাল রোজ বেহায়ার মতো আসে, একা বিড়বিড় করেন মৃগাঙ্কশেখর। খাওয়া, শোওয়া আর স্মৃতি হাতড়ানোর রোজনামচায় দিন কাটানো ক্রমশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে।
মনোরমার ওপর আজকাল রাগ হয় মৃগাঙ্কশেখরের। শরীরে অনাহুত অতিথিদের ঘর বাঁধার ছয় মাসের মধ্যেই দুম করে চলে গেল। অবসর জীবনের দু'টো বছর পার হয়নি তখনও। রঙিন শাড়িতে শাখা-সিঁদুর পরে বাড়ির উঠোনে যখন সে সটান শুয়ে ছিল, তখন তার ঠোঁটে লেগে থাকা হালকা হাসির ছোঁয়া শুধু মৃগাঙ্কশেখরই দেখতে পেয়েছিলেন। সম্ভবত সেটা উপহাস ছিল, মৃগাঙ্কের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের ওপর।
মা চলে যাবার পর বাবার একগুঁয়েমির পাত্তা দেয়নি মৃন্ময়। বাড়ি বিক্রি না করার কথা দিয়ে, নিজের কাছে চলে নিয়ে এসেছিল। তারপর অনেকগুলো বছর বহুতল বাড়িতে থেকে মাটির সাথে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করে গেছেন মৃগাঙ্কশেখর। পার্কের অবসরপ্রাপ্ত সমবয়সীদের হাত ধরে ক্ষয়াটে তুলির আঁচড়ে রঙিন সুতোয় বাঁধতে চেয়েছেন হৃদয়কে। তবুও মাঝেমাঝেই বড়ো একা লাগতো তার; নিজের শহর, ভিটে-মাটি ছেড়ে এভাবে বাঁচতে মন চাইতো না।
রুটিন করে সবাই খবর নিচ্ছে। প্রত্যুত্তরে ভালো থাকার আশীষ দিলে উল্টে "তুমি ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকব" বলে ভালো থাকার যাবতীয় দায়িত্ব মৃগাঙ্কশেখরের কাঁধে তুলে দিতে পছন্দ আপনজনের। আচ্ছা, করোনা কি শুধু ওনাকে মারার কোনো একরারনামা স্বাক্ষর করে এসেছে! বিরক্তি চোখ-মুখে প্রকাশ পায় মৃগাঙ্কশেখরের।
আঁধার নামতেই অদ্ভুত চপলতা মৃগাঙ্কশেখরের কথা-বার্তায়। সারাদিনের স্কাইপ কলের শেষে বৌয়ের কথায় উঁকি মেরে বাবাকে প্লেটে সুড়সুড়িয়ে চা খেতে দেখাটাকে শারীরিক অবস্থার উন্নতি বলে ধরেছে মৃন্ময়। মিকি আজ চুপিসারে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলিয়েছে দাদাইকে।
ব্রহ্মমুহূর্তের স্নিগ্ধতা ভেঙে কলকাকলিতে ধীরেধীরে আকাশ-বাতাস মুখরিত করছে পাখ-পাখালিরা। প্রতীক্ষার সমাপ্তি হয়েছে, তাই নিশ্চিন্তে চোখ বুজে আছেন মৃগাঙ্কশেখর। ঠোঁটের কোণে মনোরমার মতোই হালকা হাসি। দুপুরবেলা ঘরের ডাস্টবিন সাফ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই দুর্ভাবনা দূর হয়ে গিয়েছিল তার। ঘুমের ঔষধের খালি কৌটোটা পেলে মুশকিল হয়ে যেত। সুইসাইড সন্দেহ হয়ে গেলে পরে আবার লক ডাউনের মধ্যে হাসপাতাল-পোস্টমর্টেমের ঝামেলা পোহাতে হতো মৃন্ময়কে। শুধু মনোরমার সাথে একবার দেখা হলেই হয় মৃগাঙ্কশেখরের।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন