সমাপতন
ঝিরিঝিরি
বৃষ্টির ভেজা চাদর ভেদ
করে স্টেশনের ওপারে চোখজোড়া যা দেখল তা
কি সত্যি না নিছকই চোখের
ভুল তাই ভাবছে অতনু।
তিন ঘন্টা হয়ে গেলো হাফলং
স্টেশনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে
ট্রেনটা। এনকোয়ারিতে
ইতিমধ্যেই দু'বার গিয়ে
খবর নেওয়া হয়ে গেছে। ডিটেকছড়া
আর বান্দরখালের মাঝামাঝি কোথাও নাকি একটা দুর্ঘটনা
ঘটেছে তাই সিগন্যাল পাওয়া
যাচ্ছে না। বৃষ্টিটা না
হলে একটু বেরিয়ে গিয়ে
বাড়ি যাওয়ার অন্য্ বিকল্প খুঁজে দেখা যেত কিন্তু
কিছু করার নেই..
ব্যাঙ্গালোর থেকে গতকাল ফ্লাইটের
উইন্ডো সিটে বসে বাইরের
আলোটা দেখে একবারও মনে
হয়নি যে জায়গার পরিবর্তনে
মাত্র একদিনের মধ্যেই এরকম অবস্থায় পড়তে
হবে। কংক্রিটের জঙ্গলে থেকে থেকে খোলা
আকাশ বাতাসের স্বাদ যে অনেকদিন থেকেই
পায়নি তা রানওয়ের চারপাশটা
থেকে উপলব্দি করতে পারছিল অতনু।
যে সূর্যদেব বিকেলশেষে পশ্চিমাকাশে রক্তজবা রঙের ওড়না বিছিয়ে
ব্যস্ত শহরটাকে রোমান্টিক বানানোর বৃথা চেষ্টা করে
ঘুমে গেছিলেন আজকের পাহাড়ি দেশে তার দেখাই
নাই। গুয়াহাটি থেকে বাসে করেই
যেতে পারতো বাড়ি কিন্তু ফ্লাইট
ল্যান্ডিং করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে
রাত হয়ে গেছিলো তার
ওপরে প্রথমবার ব্রডগেজে যাওয়ার লোভ সামলাতে না
পারায় আজকে এই অকুস্থলে
নিরুপায় হয়ে মেজাজটা তেতো
হয়ে যায় অতনুর।
--ধুর!
কোনও দরকার ছিল না ট্রেনে
আসার।
অগত্যা
কানে হেডফোন আর গালে হাত
দিয়ে হোটেলের বাইরে লোহার চেয়ারে বসেছিল। বৃষ্টির সূক্ষ্ম কণা হালকা হাওয়ায়
ভেসে শরীরের অনাবৃত জায়গায় বিঁধতেই যেন একটা শিহরণ
দৌড়ে যাচ্ছিল সারা শরীর বেয়ে..শীত শীত ভাবটা
ক্রমেই ছড়াচ্ছিল কানের লতি, নাকের ডগা
হয়ে পায়ের আঙ্গুল অব্দি। এদিক ওদিক ঘুরঘুর
করার পর আনমনা চোখদুটো
স্টেশনের ওপারে চলে যাওয়ায় হঠাৎ
তাকে দেখা। মেয়েটা কি সত্যিই শ্যামলী!
হতে
পারে চোখের ভুল! তবে কাজ
ছাড়া চশমা না পরা
অতনুর বয়স এতোটাও হয়নি
যে চিনতে
ভুল হবে। লহমায় বহু
বছর আগের সেই ফোন
কল কানে বাজতে থাকে।
ওপারে বন্ধু শমীক।
-- ভাই
শ্যামলীর বিয়ে ঠিক হয়ে
গেছে রে.. মা বাবার
একমাত্র ছেলে হাফলংয়ে ভাল
ব্যবসায়ী।
তারপরে
মুঠোফোনটা ঠিক কতক্ষণ ধরে
দাঁড়িয়েছিল বা শমীক তারপরে
কি বলেছিল কিছুই শুনতে পায় নি। আসলে
এরকম কিছু শোনার জন্য
মনটাকে হাতুড়ি মেরে অনেক আগে
থেকেই শক্ত করে রেখেছিল
সে। শুধু টিউশন করে
তো আর সারা জীবন
চলা যায় না! অনেক
চেষ্টা চরিত্র করে একটা চাকরি
জোগাড় করতে না পেরে
মাস্টার্স ইন ইংলিশ অতনু
কয়েকবছর পরে বাধ্য হয়ে
চলে এসেছিল দূরদেশে। 'ট্যাকনিকেলি সাউন্ড' ছিল না বলে
তাড়াতাড়ি কোন কাজের ব্যবস্থা
করা সম্ভব হয়নি সেই দিনগুলোতে।
মুখে কোনোদিন প্রকাশ না করলেও বার
বার নোটস নেবার জন্য
শ্যামলীর আসা, বাসের ভিড়
ঠেলে অতনুর পাশে দাঁড়ানো, মাঝে
মাঝে কথা বলতে শ্যামলীর
গালে অকাল বসন্তের রক্তিম
আভার ছটা দুজনের পক্ষেই
সবকিছু বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল।
শুধু মুখেই প্রকাশ হয়নি।
দৌঁড়ে
ফ্লাইওভার পেরিয়ে সোজা শ্যামলীর সামনে
গিয়ে দাঁড়িয়েছিল অতনু।
--আরে
তুমি! কতদিন পর দেখলাম তোমায়!
তা হঠাৎ এখানে!
দু-তিনটা ছোট ছোট প্রশ্নবাণ
অতনুর দিকে ধেয়ে আসলেও
অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে শ্যামলীর পানে
চেয়ে রইল অতনু। মুখের
সেই উজ্জ্বল ভাবটা আর নেই। কাজল-কালো চোখের নিচে
কালি পড়েছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, পরনে রংচটা
সিন্থেটিক শাড়ি। শ্যামলীর এই অবস্থা দেখে
মনটা একটু খারাপ হয়ে
আবার যেন কেমন একটা
তৃপ্তিপূর্ণ দীপ্ততা ওর চোখমুখে খেলে
গেল। এটাই বুঝি মানব
মনের দুই দিক... মনের
আয়নাতে নিজেরই হিংসুটে প্রতিবিম্বটা স্পষ্ট দেখতে পেল অতনু। যেমন
তেমন করে ঠোঁটের কোণে
তির্যক হাসিটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হল। আরও কটা
দিন অপেক্ষা করলেও তো পারতো শ্যামলী।
বিয়ের যে দিনক্ষণ ঠিক
হয়ে গেছে তা একবার
জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি। কেন!
এতটুকুও বিশ্বাস রাখতে পারেনি ওর উপর, এতগুলো
বছরে অতনুকে এতোটাই চিনতে পারলো!
-- মা,
বাড়ি যাব।
শ্যামলীর
হাতের একটা আঙ্গুল ধরে
সাদা-সবুজ রঙের স্কুলড্রেস
পরে পাঁচ-ছয় বছরের
বাচ্চা। চোখ আর নাকের
দিকটা দিকটা অবিকল শ্যামলীর মতন ।
--তোমার
নাম কি বাবু?
শ্যামলীর
প্রশ্নগুলোকে একরকম উপেক্ষা করেই বাচ্চাটার দিকে
হাঁটু ভাঁজ করে ঝুঁকে
জিজ্ঞেস করে অতনু। অপরিচিত
মানুষ দেখে লজ্জা পায়
বাচ্চাটা। মায়ের পিছনে মুখ লুকায়।
--আঙ্কেলকে
নাম বল বাবা। ভাল
ছেলেরা এরকম করে না।
-- ওর
নাম অভ্র, অভ্রজিৎ কর। ছেলের মাথায়
সস্নেহে হাত বুলিয়ে নিজেই
উত্তর দেয় শ্যামলী।
--তারপর
বল, চাকরিবাকরি কেমন চলছে তোমার?
--ভালোই।
--বাড়ি
যাচ্ছ? বৌকে সাথে আননি?
--না
ওকে আনিনি, পুজোতে আসবে। একটু কাজে এই
অসময়ে আসা আমার। তা
তোমার কেমন চলছে বল।
করবাবু কেমন আছে?
-- বিজন
নেই। দেড় বছর হল
মারা গেছে।
বলেই
মুখটা ডানদিকে ঘোরাল শ্যামলী। গত ক'বছরে
অনেক কিছু সহ্য করতে
হয়েছে বলে নিজেকে যেকোনও
পরিস্থিতিতে সামলে নেওয়া এখন কোনো ব্যাপারই
নয় ওর কাছে।
-- চল
আমাদের সাথে, এই তো ডানদিকের
রেলিংটার ওপারেই আমাদের বাড়ি।
নিমিষেই
চোখের জল গিলে নিয়ে
অতনুকে হাসিমুখে বলল শ্যামলী। কোন
উত্তর না দিয়ে শ্যামলীর
দু'পা পিছন পিছন
রোবটের মতন চলল অতনু।
বৃষ্টিটা কিছুক্ষণের জন্য থেমেছে। জায়গায়
জায়গায় জমা জল, গাছের
পাতা থেকে এখনও বড়
বড় ফোঁটায় জল ঝরে যাচ্ছে।
ছোট একটা গলি হয়ে
ডানপাশে বাঁশের গেটের সামনে দাঁড়ালো শ্যামলী। গেট পেরোনোর তিন-চার হাত পরেই
দরজা। দরজাটা
ছোট, তাই মাথা নিচু
করে ঢুকতে হয়। ঘরের ভিতরে
ঢুকে সমস্ত রাগ-অভিমান জল
হয়ে গেল অতনুর ।
একটাই কামরা, তার গাঘেঁষে ছোট্ট
রান্নাঘর। বাথরুম বাইরে, আরও দুটো পরিবারের
সাথে ভাগ করতে হয়।
একটা বিছানা তাতে বইপত্র ছড়িয়ে
আছে, এককোনে একটা সেলাই মেশিন..
তার পাশে চেয়ারে কাপড়জামার
স্তূপ দেখলে বোঝা যায় নিয়মিত
সেলাই করা হয় এতে।
--চা
খাও?
-হুম।
শ্যামলীকে
জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে,
বিজন মারা যাবার পর
তুতো ভাই-বোনদের প্ররোচনায়
শ্বশুড়বাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না
পেরে প্রায় আট মাস থেকে
এই ভাড়াবাড়িতে আছে। ওকে বিয়ে
দেওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই
বাবা মারা যান। বাবার
শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে আলাপ
আসার সপ্তাহদিনের মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল শ্যামলীর।
পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যে
সবকিছু জানানো সম্ভব হয়নি। মা তো অনেক
আগেই গত হয়েছে। আজকে
ওর আর কোথাও যাবার
জায়গা নেই। আয় বলতে
সকাল-বিকেল টিউশন আর একটু আধটু
সেলাইয়ের কাজ। গ্র্যাজুয়েট হলেও
চেনা-পরিচিত কেউ না থাকায়
যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো কাজের জোগাড়
করা সম্ভব হয়নি। এতদিন পর আপনজনকে কাছে
পেয়ে শ্যামলীর চোখ বাঁধ ভাঙে।
-- তুমি
কি এখনো আমার উপর
রেগে আছ?
চায়ের
কাপটা ধরিয়ে দিয়ে চোখ মুছে
জিজ্ঞেস করল শ্যামলী। প্রথমে
ওকে দেখার পর অনেককিছু শোনানোর
ইচ্ছে থাকলেও অতনু বিহ্বলতা কাটিয়ে
উঠতে পারে না। শুধু
মাথা নেড়ে মানা করে।
শ্যামলীকে এভাবে যে একদিন দেখবে,
এতো বড় অভিশাপ তো
সে দেয়নি কোনওদিন। যার উপরে আজ
রাগ অভিমান করবে, সে যে নিজে
সব কিছু হারিয়ে দেউলিয়া
হয়ে বসে আছে। চায়ের
কাপে চুমুক দিয়ে যেন একটু
ধাতস্ত হয়। শ্যামলীর ছেলেটাকে
কোলে তুলে নেয়।
-- কোন
ক্লাসে পড় বাবা?
-- টু..
আর লজ্জা করে না অভ্র,
দু আঙুলে ভিক্টরি সাইন দেখিয়ে বলে।
অতনু
এবার ধীরে ধীরে উঠে
দাঁড়ায়। মাথার মধ্যে অনেক পরিকল্পনা ঘুরপাক
খাচ্ছে। কাঁধে যে অনেক দায়িত্ব,
শুধু ব্যক্তিগত না মানবিকও.. ট্রেনের
লেট্ করাটা আজ আশীর্বাদসম মনে
হয়। ওদের তিন বন্ধুর
অংশীদারিত্বে বদরপুর-করিমগঞ্জ রোডে তিল তিল
করে গড়ে উঠছে "দি
টিনি সিড" নামের প্রাইভেট স্কুল। রেজিস্ট্রেশনের কাজ শেষ। স্কুলের
কাজেই তড়িঘড়ি করে এই অসময়ে
বাড়িমুখো যাত্রা। আগামী বছরের শুরুতেই খুলতে যাচ্ছে ওদের স্কুল। নানা
বিভাগে লোক নেওয়া শুরু
হয়ে গেছে।
-- বাড়ি
যেতে ইচ্ছে হয় না শ্যামলী?
শ্যামলী
জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে দেখে
অতনুর মুখে হালকা হাসির
ছাপ। ফোন বের করে
নম্বর ডায়াল করে অতনু। ওপাশে
ময়ূখ, কনফারেন্সে শমিককেও নেয়। ওর কথাতে
সায় দেয় ময়ূখরা। হাসিমুখে
ফোনটা রেখে এবার পিঠের
ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ খুলে
অতনু।
-- নামের
শেষে কি লিখ.. কর
না দেব?
-- কর...
বিয়ের পরে এটাই লিখি।
সঠিক
ঠিকানাটা নিয়ে অতনু লেটারহেডে
এবার টাইপ করা শুরু
করে "ইট ইজ উইথ
প্লেজার দ্যাট উই আর অফারিং
ইউ..."
ওর ভিতরের হিংসুটে লোকটা ততক্ষণে পালিয়েছে। মনের আয়নাতে নিজেকে
বেশ হাসিমুখে খুঁজে পায় অতনু। জমা
মেঘ ধুয়ে আকাশটাও সাফ
হয়ে গেছে... দুপুরশেষের প্রৌঢ় রোদের ছোঁয়া ওকে আরও
দৃঢ় করে তোলে, তাড়াতাড়ি এগোনোর রসদ যোগায়।
Comments
Post a Comment