ভালবাসার দিন

||তৃণময় সেন||
-- ভাইয়া...ভাইয়া.. একঠো গুলাব লিজিয়ে না! দিদি...দিদি!
কোনওমতে রাধিকাকে পাশ কাটিয়ে এস্কেলেটরে পা রেখে উপরদিকে চলে যায় একজোড়া ছেলেমেয়ে। সমবয়েসী ছেলেমেয়ে একসাথে দেখলে বেশি করে অনুরোধ করার জন্য বুঝিয়ে বলা হয়েছে আট বছরের রাধিকাকে। তাই প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী দেখলে হামলে পরে রাধিকা। হালকা ধমক না খাওয়া অবধি পিছু হটে না। তার ওপর আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে, তাই টার্গেট অনুযায়ী বেশি করে গোলাপ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে অনিমা-রাধিকাদেরকে। নয়ডা সেক্টর আঠেরো মেট্রো স্টেশনের বাইরে চাতকের চোখে গ্রাহক খুঁজে চলে রাধিকা। অদূরে গাছের নিচে বসে ছোট ভাইকে স্তন্যপান করাচ্ছে ওর মা সুমিত্রা। ওর পরনের কমলা রঙের ঘাগরা আর সফেদ ওড়না ধুলো-মাটি মেখে নাম না জানা কোনো এক রঙে পরিণত হয়েছে। নাকে রুপালি নথ, দুহাতে কয়েকগাছা করে রঙ্গিন চুড়ি ,পুরো কান ঘিরে আছে ছোট ছোট দুল। ছিপ্-ছিপে সুমিত্রার সারা গায়ে যেন লেপ্টে আছে রাজস্থানের আলওয়ারের ছাপ। যদিও জীবনের যাঁতাকলে পিষে সেই উজ্জ্বল ভাবটা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। রঙের উৎসব হোলিতে জগনের ছোঁয়ায় ষোড়শী সুমির হৃদয়ে দুর্বার বসন্ত জেগেছিল সেবার। দিল্লিবাসী জগনের হাত ধরে চলে এসেছিল ধোঁয়াশার শহরে। দিন যত গেছে ততই অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে সুমিত্রার ভবিষ্যৎ। দ্বিতীয় সন্তান আসার চার মাসের মাথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে জগন।
খালি হাতে ভিক্ষা করার দিন গেছে, তাই হালফিলে কলম-গোলাপ-ধূপকাঠি বিক্রি থেকে শুরু করে গাড়ি মুছে দেওয়া এসব ভিক্ষুকদের জগতে নতুন আমদানি হয়েছে। যদিও বাচ্চা কোলে নিয়ে হাত পাতলে একেবারে নিরাশ হতে হয় না সুমিত্রাকে। অন্যদের খুব সকালে বিক্রয়ের জন্য পণ্য ধরিয়ে দেওয়া হয় আর দিনের আলো ম্লান হবার সাথে সাথে এজেন্টের কাছে হিসাব করে টাকা এবং অবিক্রিত বস্তুগুলো ফিরিয়ে দিতে হয় সবাইকে। কমিশন আসে তার পরের দিন। কখনো বা দিন দুয়েক পরে। কলম বা গোলাপ রাধিকার হাতে তুলে দিলেও এজেন্টদের কাছ থেকে হিসাবটা বুঝে নিতে হয় সুমিত্রাকেই। যদিও এজেন্টের সামনে যেতে মোটেই ইচ্ছে হয় না। দুচোখে তার সারা শরীর জরিপ করতে থাকে এজেন্টগুলো.. ওড়না দিয়ে বাচ্চাসহ যতটুকু সম্ভব বুকের আশপাশের অনাবৃত অংশ ঢেকে রাখার চেষ্টা করে সুমিত্রা। মেয়েকে দিয়ে কাজ না করালেও উপায় নেই। শুধু পেট ভরার জন্য রোজগার করলেই তো চলবে না, মাসের শেষে থানার বাবুরা আসলে ওদের হাতেও কমবেশি কিছু একটা ধরিয়ে দিতে হয়। গত সপ্তাহে দমকা হাওয়া সহ শিলাবৃষ্টি হওয়াতে শীতকাল এবার বসন্তের ঘাড়ে চেপে বসেছে। নীলাকাশে সূর্যের প্রখরতায় খামতি না থাকলেও মাঝবেলার বাতাস বেশ কনকনে ঠান্ডা। গেইট নম্বর দুইয়ের বাইরে একটা ল্যাম্পপোষ্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাধিকা। তার ধুলোমাখা লালচে চুল হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। হাতের মুঠোয় গোলাপগুচ্ছ সকাল থেকে ধকল সামলে অনেকটা মলিন হয়ে পড়েছে। প্রেমিকজোড়ারা মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে শপিং মল- কেএফসি-ম্যাকডোনাল্ডে ঢুকে যাচ্ছে। সামনে থেকে ফতুয়া পরে কাঁধে ঝোলা সহ দুলকি চালে এগিয়ে আসছে নওশাদ বুড়ো। আপাতদৃষ্টিতে দেখে করুণা হলেও, আসলে পাজির পা-ঝাড়া এই নওশাদ... ময়লা ফতুয়ার আড়ালে ওর আসল চেহারা ঝুপড়ির প্রতিটা মহিলা চেনে। বুড়োকে আসতে দেখে হেলান দেওয়া ছেড়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ায় রাধিকা। রাতের আঁধারে বেশ কয়েকবার খসখসে হাতে ওর বুক চেপে ধরেছে নওশাদ। মাকে জানালে উল্টো গালে সপাটে চড় জুটেছে তার। অশুভ ছোঁয়ার হাতেখড়ি বুড়োর হাতে হলেও আজকাল পুরুষের চাহনি দেখে অশনি সংকেত আঁচ করার মত পাকা মেয়ে হয়ে উঠেছে রাধিকা। কই রাজকুমার চাচাকে তো দেখে এরকম কিছু মনে হয় না! কুড়া ভরা গম্বুজাকৃতির ঠেলাগাড়ি খালি করে ফেরার পথে ঝুপড়ির বাচ্চাদের জন্য রোজ কিছু না কিছু নিয়েই আসে রাজকুমার চাচা। গন্ধে ভরা মানুষটির হাত থেকে পিৎজা, সমোসা, শুকনো পাউরুটি নিয়ে গোগ্রাসে গেলে বাচ্চারা। রাজকুমারের ঠোঁটে খেলে প্রশান্তির মুচকি হাসি। বয়স সাতাশ-আটাশের বেশি না হলেও মাথার চুল প্রায় অর্ধেক পেকে গেছে রাজকুমারের। ভাগাড়ে কুড়ার গাড়ি খালি করতে গিয়েই নাকি রাজকুমারকে কুড়িয়ে পেয়েছিল ওর দাদাজি গোপালচান্দ। বুড়ো মারা যাবার পর থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কুড়াওয়ালার কাজ ধরে রেখেছে রাজকুমার। আজকে বেশ বড় একটুকরো কেক নিয়ে এসেছে সে। সাতটা বাচ্চাকে সমানভাবে ভাগ করে দিয়ে দিয়েছে কেকটুকু। অদূরে সুমিত্রাকে দেখতে পেয়ে মনটা উসখুশ করে ওঠে তার। চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় সুমিত্রা। লজ্জায় মাথা হেঁট করে অযথাই ঠেলাগাড়িতে কিছু একটা খুঁজে চলে রাজকুমার। এমনিতে মানুষটাকে ভাল লাগলেও পুরুষমানুষকে আর কোনদিনই বিশ্বাস করবে না বলে ঠিক করেছে সুমিত্রা। ভালো তো জগনও ছিল...কিন্তু কোথায় উবে গেল সেই ভালবাসা! সুমিত্রাকে না হোক, অন্ততঃ বাচ্চা দুটোর কথা কি একবারও মনে পড়েনা তার!
দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে শেষ বিকেলে ভিক্কির চাউমিন-মোমোর দোকানে হাত লাগাবার জন্য বেরিয়ে পড়ে রাজকুমার। বড় ডেকচিতে চাউমিন সেদ্ধ করা থেকে শুরু করে প্লেট ধোয়ার কাজে রাজকুমারের জুড়ি নেই। নিজের এরকম একটা ছোট দোকান হবে, একটু ভাল খাবে, ভাল জায়গায় থাকবে তার চেয়ে বেশি স্বপ্ন নেই রাজকুমারের চোখে। কুড়াওয়ালার জীবনটা ভীষণ কষ্টকর.. দিওয়ালি-হোলি যা'ই হোক না কেন একটা দিনের জন্য ছুটি করতে পারে না। কোনো কারণে একদিন না যেতে পারলে পরের দিন লোকের কথা শোনা ছাড়াও সোসাইটিতে দু-চক্কর মারতে হয়। চার-পাঁচ তলার বাসিন্দারা তো উপর থেকেই ঠেলাগাড়ি লক্ষ্য করে বড় বড় ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে। দু-একবার তো রাজকুমারের গায়েও এসে পড়েছে। লিফট ধরে নিচে নামার সময়টুকু নেই, এখানে এতটাই ব্যস্ত থাকে সবাই। বিয়ে-শাদি নিয়ে খুব একটা না ভাবলেও, বিষয়টা মাথায় আসলে সুমিত্রার মলিন মুখখানাই উজ্জ্বল হয়ে ভাসে তার মনে।
শরীরটা আজকে বেশি সুবিধের লাগছে না...কেমন একটা জ্বর জ্বর ভাব সকাল থেকেই, তাই একসাথে বেশি করে চাউমিন সেদ্ধ করে, বাঁধাকপি-পেঁয়াজ কেটে, বোতলে সস ভরে দিয়ে ভিক্কির কাছে বিদায় নেয় রাজকুমার। অন্ধকার নামার সাথে সাথে সক্রিয় হয়ে উঠছে স্ট্রিটলাইটগুলো। বাইক-গাড়ি হুশহাশ করে পেরিয়ে যাচ্ছে তাকে। মাথার টুপিটা টেনে কানদুটো ঢেকে নেয় রাজকুমার। ঐতো সামান্য দূরেই শেডের নিচে রাধিকাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু আজকে এতো লোকের জটলা কেন! কয়েক পা বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায় রাজকুমার। ষন্ডামার্কা দুজন লোকের সামনে দাঁড়িয়ে সশব্দে কেঁদে যাচ্ছে রাধিকা। শক্ত হাতে ওর কাঠির মতো হাতটাকে ধরে রাখা লোকটা সপাটে চড় মেরে চেঁচিয়ে উঠল --"বোল..বাকি প্যায়সে কাহাঁ গয়ে!!" উত্তর না দিয়ে আরও জোরে জোরে কেঁদে উঠে রাধিকা। অপরাধীর মত এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা সুমিত্রা মেয়েকে বাচাঁতে গেলে এক ধাক্কায় ওকে দূরে সরিয়ে দেয় অন্যজন। --"চল হট্ ইঁহা সে, সালি রেন্ডি!" আশপাশের সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখছে। ভিড় ঠেলে লোকদুটোর সামনে চলে যায় রাজকুমার। সকালে ধরিয়ে দিয়ে যাওয়া ফুল বা টাকা কিছুরই হিসাব এই এজেন্টদের কাছে দিতে পারছে না মা-বেটি। ওদের খাতাতে লেখা হিসাবমতে পঁচাশি টাকা শার্টের পকেট থেকে বার করে দেয় রাজকুমার। পিছন ফিরে দেখায় মাথা নত করে এক এক করে ভেঙে যায় লোকজনের ভিড়। হতভম্বের মত মাটিতে পড়ে থাকা সুমিত্রার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দেয় রাজকুমার। ওর কোমরের কাছে লেপ্টে থাকা রাধিকা থেমে থেমেই ফুঁপিয়ে উঠছে। এরকম আগে কোনোদিনও হয়নি। সনপাপড়ি দেখে লোভ সামলাতে না পারায় এই অবস্থা, তাছাড়াও সঙ্গীসাথীদের সাথে খেলতে গিয়ে ধাক্কা লেগে কয়েকটা গোলাপের ঘাড় ভেঙে যাওয়ায় বিক্রি হয়নি। মাথায় বোঁচকা আর পিঠে বাচ্চাকে বেঁধে রাজকুমারের হাত ধরে সুমিত্রা। নিজের করা প্রতিজ্ঞা আজ নিজের কাছেই আত্মসমর্পন করেছে। কাঁপা ঠোঁটে কোনও কথা নেই...দু চোখের কূল ভরে উঠেছে তার। ভালবাসার দিনের সন্ধ্যেটা আজ হৃদয়ের আলতো ছোঁয়ায় স্বর্ণালী হয়ে উঠেছে। আসলে ভালবাসার কোনও নির্দিষ্ট দিন হয় না। ভালবাসা তো সেই মুহূর্তের নাম যে মুহূর্তে সেই মানুষটাকেই নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। তার দোষ-গুণ, ভাল-মন্দ বিচার করতে অস্বীকার করে মগজ। চোখের ভাষা চিনতে গেলে শিখতে হয় না কোনো বর্ণমালা। রাধিকার হাত ধরে ফুটপাথে হেঁটে চলে রাজকুমার..তার পিছন পিছন চলছে সুমিত্রা। জীবনটা আবার ওকে নিয়ে চলছে অজানা কোনো বাঁকে। পথের জমা জল পায়ে লাগলে এক অদ্ভুত শিরশিরানি অনুভব করে শরীর থেকে মনে। অনেক বছর পরে তার কানে যেন বাজে কুমার শানুর প্রিয় গানখানি। সেই গান, যে গান একদিন জগনের হাত ধরেও শুনেছিল। "দো দিল মিল রহে হ্যাঁয়..মগর চুপকে চুপকে..."

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন