বিজয়িনী

।।বিজয়িনী।।
তৃণময় সেন
কালো কোট গায়ে জড়ানোর আগে নিজের প্রথম উপার্জনে কেনা বেগুনি শাড়িটা পরে আয়নার সামনে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে জয়ি। মা কে সাথে নিয়ে গিয়ে ফ্যান্সিবাজারের একটা দোকান থেকে শাড়িটা কিনেছিলো ও। যদিও মায়ের ততটা পছন্দ হয়নি। মা বলছিলো তোর গায়ের রংটা এমনিতেই শ্যামলা তার মধ্যে আবার বেগুনি শাড়ি কিনবি! ততটা অসুন্দরী না হয়েও মায়ের কাছ থেকে প্রায়ই গায়ের রং নিয়ে কথা শুনতে ভাল্লাগেনা জয়ির। বলে কালো মানুষের কি বেগুনি রংটা পছন্দ হতে নেই! ঘরে এসে শাড়ি পরেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলো জয়ি। গাল বেয়ে ঝরে পড়েছিল আনন্দ-বিষাদ। বিষাদটা এই বিশেষ দিনে বাবাকে সাথে না পাওয়ার আর আনন্দ এতো প্রতিকুলতার মধ্যে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছার।
রুমাল দিয়ে হাতঘড়ির ডায়ালটা মুছে জয়ি। ঠিক একমাস পর আজ কোর্টে যাবার সাহস করতে পেরেছে ও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে আসে গত এক মাসের ছবি। আক্ষরিক অর্থে উইমেন এম্পাওয়ারমেন্টের যুগে হ্যোয়াটসেপে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও সত্যাসত্য যাচাই করার আগেই জয়ির সারাজীবনের 'আদর্শ মেয়ে' তকমাটা মুছে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। নামটা জয়ি হলেও কোর্টে জমি অধিগ্রহণ কেসে সুরিন্দরবাবুর বিরুদ্ধে লড়ার আগেই হেরে গেছিল সে। ১৭ই আগস্ট অফিস থেকে ফিরার আগেই ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছিল। একটা অপরিচিত ছেলের সাথে নিজের মেয়ের অন্তরঙ্গ ভিডিও দেখে থপ করে মাটিতে বসে পড়েছিলেন ওর মা। যদিও মেয়ের প্রতি বিশ্বাসে মোটেই খামতি ছিল না তবুও সেই সময়ের জন্য যেন হাঁমুখ বোবা হয়ে গেছিলেন। ঘরে পুরুষমানুষ বলতে ক্লাস ১১ এ পড়া জয়ির ছোটভাই সোম। জয়ি এলএলবি ফাইনাল ইয়ারে ছিল তখনই ক্যান্সারে মারা যান গরিবের উকিল বলে খ্যাত জয়ন্তবাবু। তিন দিন আগে বিকেলে কেস ফাইল করে বাড়ি ফেরার ফেরার পথে "নমস্কার ম্যাডাম" শুনে ধীরেনপাড়া পুরানো বটগাছের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্ল্যাক গাড়িতে ব্যাকব্রাশ করা চুল আর কুমিরের মত হিম করা চোখওয়ালা মানুষটিকে দেখেছিলো জয়ি। নিজেই বললো "হাম সুরিন্দর সুরানা, নাম তো সুনা হোগা আপনে। চলিয়ে ঘর ছোড় দিতে হ্যায় আপকো।" "আমি নিজেই যেতে পারবো" বলে তাড়াড়াটি পা চালিয়েছিল জয়ি। সুরিন্দর মানুষটাকে আগে কোনোদিন দেখেনি, নাম শুনেছে কাজের লোক ঝিনুমাসীর কাছে। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল ঝিনুমাসী। "দিদিভাই, আমাগো পনের দিনের মদ্যে জায়গা খালি কইরা দিতে কইসে, কই যামু কন!" মানবিক কারণেই কেসটা হাতে নিয়েছিল জয়ি, ওর বাবার বলতেন "ভূপেনদার গান মানুষ মানুষের জন্য শুধু শুনেই হবে না, জীবনেও তা ফুটিয়ে তুলতে হবে, বুজলি বাবু!
পরদিন সকালে কেসটা উইথড্র করাবার জন্য ওর চেম্বারে এসেছিলো সুরিন্দর। "মে আই কাম ইন ম্যাডাম" বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভিতরে চলে এসেছিলো। "বলুন" ওর দিকে না দেখেই বললো জয়ি। "দেখিয়ে ইয়ে ধীরেনপাড়া ওয়ান বিএচকে মে কব্ তাক রাহেঙ্গি! হ্যাম দিলাতে হে আপকো ঘর থ্রি বিএচকে উও ভি গৌহাটিকে প্রাইম লোকেশন পর। আপ বাস ইয়ে সড়কছাপ গরিবো কা সাথ ছোড়িয়ে" বাজখাঁই গলায় এই কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেছিলো জয়ির। ও বলেছিলো "দেখুন, প্রথমত টাকা পয়সার ভয় আমি করি না। করলে এইরকম কেস লড়তাম না, সেকেন্ডলি কারো ধমকাবার ভয়ে থেমে যাবার মেয়ে আমি নই। আর মরার ভয়! তা আমার নেই। আপনার কথা শেষ হলে আপনি যেতে পারেন।" ঐদিন যাবার সময় সুরিন্দরের হাসিটার সঠিক অর্থ ধরতে পারেনি জয়ি। দুদিন পর সারা গৌহাটি জুড়ে ইউটিউব-হ্যোয়াটসএপে ছড়িয়ে পড়েছিল ধীরেনপাড়ার যুবতী উকিলের অশ্লীল ভিডিও। বাড়িতে এসে সোমের মুখে কথাটা শোনামাত্রই পাথর হয়ে গিয়েছিলো জয়ি। কতক্ষন যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল ওর মনে নেই। নিজেকে বন্দি করে নিয়েছিলো চারদেয়ালের ভিতর। সপ্তাহদিন বাদে ছোট ভাইয়ের আব্দারে গলির সামনে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে মোমো খেতে গিয়ে বাইকওয়ালা ছেলেদের শীষ আর ওকে শুনিয়ে অশ্রাব্য কথাবার্তা সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে এসে সশব্দে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো। ওই রাতে ফ্যানের ব্লেডে ওড়না লাগালেও বাবার মুখ মনে পড়ে যাওয়ায় ঝুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয় জয়ি।
"ভাতটা মেখে রেখেছি মা, আয় খেয়ে নে" মায়ের গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরে পায় জয়ি। "তুমিই খাইয়ে দাও দু গ্রাস".. বলে মায়ের পা ছোঁয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বেরিয়ে পড়ে জয়ি। গতকাল নিঝুম রাতের বৃষ্টি আকাশটা সাফ করার সাথে সাথে ওর মনের ধূসর আকাশ থেকেও সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছিলো। সবকিছু যেন আজকে বেশিই সবুজ লাগে জয়ির। একমাস পেরিয়ে গেলেও রাস্তার লোক এমনভাবে ড্যাবড্যাবিয়ে দেখছে, যেন খালি চোখেই ওকে গিলে ফেলবে। কিন্তু আজ কিছু গায়ে মাখে না জয়ি, গত একমাসে এরকম অনেক দেখেছে ও। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। হঠাৎ পিছন থেকে বাজখাঁই গলায় শুনতে পায় "কাহাঁ চলি ম্যাডাম! ওয়সে ভিডিও বড়িয়া থা আপকা" ধীর গতিতে পিছন ফিরে দেখে জয়ি। ওর ঠোঁটে আলতো হাসি দেখে সুরিন্দরের আজ যেন গলা শুকিয়ে আসে। "টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, ধমক বা মৃত্যু ভয় তো ছিল না। বাকি ছিল ইজ্জত বা সম্মানের ভয়, তা তো আপনি কাটিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ! কোর্টে যাচ্ছি, আশা করি তাড়াতাড়িই দেখা হবে".. পিছন ফিরে অটো ধরে জয়ি। কেস শুরু হবার আগেই আজ জয়ি যেন বিজয়িনী।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন