পরকীয়া

।।তৃণময় সেন।।
-- তুমি কি আমায় মেট্রো স্টেশন অব্দি পৌঁছে দেবে...না আমি ক্যাব বুক করব! তাড়াতাড়ি বল।
-- গ্যারেন্টি দিয়ে বলছি, দিলীপ আজও রাত আটটার আগে ফিরবে না। আরেকটু আমার কাছে থাকো না কলি...প্লিজ!!
সোহমের নিবিড় আলিঙ্গনে প্রৌঢ় ঋতুতে বেশ শীত বোধ হল কাজলির। এই উষ্ণতা ছেড়ে যেতে মন চাইছে না, কিন্তু যেতে তো হবে। অন্তত যতদিন পর্যন্ত এই কাগুজে সম্পর্কটা টিকে আছে ততদিন.. না হলে মনে বা শরীরে কোথাও আজকাল দিলীপকে খুঁজে পায় না কাজলি। অফিস-সিগারেট আর একগুঁয়েমির কাছে কাজলির অস্তিত্বটা দিলীপের কাছে চাল ধোয়া জলের মতোই ঘোলাটে। গত নয় বছরে চাওয়া-পাওয়ার হিসাবের খাতা সেই ঘোলা জলে ভিজে অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সোহমের পরিচিত এক উকিলের সাথে কথা বলে সব কিছু জানা হয়ে গেছে অনেকদিন হলো, কিন্তু কেন জানি কথাটা দিলীপের কাছে পাড়তে পারছে না কাজলি। তীব্র বাক্যবিনিময়ের মাঝে দু-একবার বললেও দিলীপ কোনোদিন সিরিয়াসলি নিয়েছে বলে মনে হয়না।
মাঘের আকাশটা আজ গোমড়ামুখো হয়ে আছে। মাঘকে মেঘ শুধু দেখা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। সক্কাল সক্কাল উত্তম মধ্যম ঝরেই ছেড়েছে। বেলা ন'টার রোদের মিষ্টি মোলায়েম ভাবটা হালকা কর্কশ হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই গা-জ্বলে যাচ্ছে অথচ সরে যাবার পরে ঠান্ডাও লাগছে। কি মুশকিল! চেয়ার ছেড়ে ঘরে ঢুকেই সিগারেটের প্যাকেট হাতে নেয় দিলীপ। অনেক চেষ্টা করেও কম করতে পারছে না সিগারেটটা। হাই-ব্লাডপ্রেসারের রুগী দিলীপকে স্মোক এবং ড্রিংক দুটোই করতে মানা করেছেন ডাক্তার। আপাতদৃষ্টিতে তেমন অসুস্থ মনে না হলেও প্রেসারটা বেশ বিপদজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে। একদিকে কাজের চাপ অন্যদিকে পারিবারিক অশান্তিতে দিনের পর দিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে জীবনটা। কথা বলার চেয়ে আজকাল চুপ থাকতেই পছন্দ করে কাজলি। মুখ খুললেই তো ছোট ছোট কথায় শুরু হয়ে যায় ঝগড়া.. অশান্তি। তাই আর নিজেও যেচে কথা বলতে যায়না দিলীপ। সাধারণ পাঁচজন নিঃসন্তান দম্পতির মত অনেক বৈদ্য-কবিরাজ থেকে শুরু করে ঝাড়ফুঁকের সাহায্য নিলেও নিরাশা ছাড়া কিছুই হাতে লাগেনি ওদের।
উইকএন্ড পার্টিতে মার্কেটিং টিম লিডার দিলীপের আমন্ত্রণে টিমের সবার সাথে প্রথমবার ঘরে এসেছিল সোহম। পার্টিতে বয়েসে সবার থেকে ছোট ছাড়াও সোহমের আরেকটি বিশেষত্ব ছিল যে ও ড্রিংক করেনা। কাজলির হাতের রান্নার ঢালাও প্রশংসা করেছিল সেদিন। তারপর ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানো থেকে শুরু করে হোয়াটসএপে নম্বর বিনিময়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কাছে আসতে শুরু করেছিল ওরা দুজন। মেয়েদের কি বললে তারা খুশি হয় তা সোহম থেকে ভাল বুঝতে পারা পুরুষের সংখ্যা নিতান্তই আঙুলে গোনা.. অন্তত কাজলি তাই বিশ্বাস করে। নেলপালিশ থেকে শুরু করে হোয়াটসএপে কাজলির পাঠানো গানগুলোর প্রশংসা করতে কখনো ভুলে না সোহম। তাই হয়তো আয়নার সামনে বসে অনেকক্ষণ সাজগোজ করতে মোটেই বিরক্তি বোধ হয় না কাজলির। স্কুল ছুটির পরে আইলাইনার লাগিয়ে নিজেকে ঝালিয়ে নেয় বারবার। ঢাকতে চেষ্টা করে বাড়ন্ত বয়েসের অবাধ্যতাকে। আসলে বয়সকে দোষ দিলে ভুল হবে। ওর কলিগ নিনা, অলকারা তো ওরই বয়েসি হবে কিন্তু ওদের চেহারার উজ্জ্বল ভাবটা তো ওর মতো ক্ষয়ে যায়নি! বাড়িতে আসতে দেরি হয়ে যাবার খবর দেওয়া ছাড়া মাঝেমাঝে লাঞ্চ টাইমে ফোন করে দিলীপ। কথা অসম্পূর্ন রেখে কেটেও দেয় আবার.. এরকম করার হলে কি দরকারই বা ছিল ফোন করার! চোখমুখ থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ে কাজলির। যদিও সোহমের সাথে পরিচয়ের পর থেকে দিলীপের ব্যবহার খুব একটা গায়ে মাখে না সে। গেল বছরই ভাল অফার পেয়ে নতুন কোম্পানি জয়েন করেছে সোহম। পুরোনো বস বা কলিগদের সাথে মেলামেশাটা প্রায় বন্ধ থাকায় ব্যাপারটা জানাজানি হবার ভয় অনেকটা কম।
তুমুল বাকবিতন্ডার মাঝে সজোরে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছে কাজলি। এক ছাদের নিচে থাকা সম্ভব নয় আর। গটগট করে সিঁড়ি পেরিয়ে চলে এসেছে মাঝ রাস্তায়। গেঞ্জি-ট্রাউজার্স গায়ে দিলীপ ছুটে যাচ্ছে পিছন পিছন। পথের ধারের বুটপোলিশওয়ালা ছেলেটা দুচোখে গিলে যাচ্ছে সম্পূর্ণ ঘটনাটা। খোলা চুল আর বেগুনি নাইটি হাওয়ার বিপরীতে চলা কাজলিকে ছেড়ে উড়ে যেতে চাইছে। সহসা তীব্র ব্রেক কষার শব্দ আর চিৎকারে পিছন ফিরে দেখে কাজলি। রক্তাক্ত অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দিলীপ হাতদুটো পিছন দিকে উল্টে গেছে। দৌঁড়ে যেতে চাইলে মোটেই এগোতে পারে না সে। পাড়ার লোক থেকে শুরু করে কাজের মাসি রানুদি সবাই দিলীপকে তুলে নিয়ে এসেছে ওর কাছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রানুদির হাতে চারকোণে ভাঁজওয়ালা একটা কাগজ। এই ভাঁজটা খুব চেনা কাজলির। ডিভোর্সের আবেদনপত্রটি রানুদি পেল কোথা থেকে! টুকরো-টুকরো ছিড়ে ওর মুখের উপর ছুঁড়ে দেয় রানুদি। কাঁদতে চাইলে কান্না আসছে না। সবাই গোল হয়ে ঘিরে ধরেছে ওকে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে কাজলির। দূরে কোথা থেকে পরিচিত শব্দ ভেসে আসছে। একলাফে বিছানা থেকে ওঠে বসে পরে কাজলি। কি দুঃস্বপ্নই না ছিল! গলার সাথে মাফলারের মতন ঝুলছে ব্ল্যাঙ্কেট। সাড়ে-ছটার আল্যার্ম বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ে সে। কয়েক সেকেন্ড পরে উঠে ব্যাগ খুলে ডিভোর্সের আবেদনপত্র খানা দেখে নেয়। অনেকদিন হল একই ভাঁজে পড়ে আছে কাজলির ভ্যানিটি ব্যাগে। তাতে নাম-বয়স-সাক্ষর নিজের দিকের সবকিছু আগেভাগেই করে রেখেছে সে। স্কুলে নতুন এডমিশন চলছে তাই আজকাল সময়ের বাঁধাধরা একটু কম। ছয় বাই ছয় বিছানার মাঝে কোলবালিশ। তার ওপারে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে দিলীপ। রাতে ল্যাপটপে ঝুঁকে কাজ করছিল দিলীপ.. ঘুম নামার আগের এতটুকুই মনে আছে কাজলির । গত পরশুদিন জন্মদিন ছিল তার। নিজে থেকেই তাড়াতাড়ি চলে আসার কথা দিয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফিরেছে দিলীপ। ওর চোখে চোখ রাখলে ভুল স্বীকার করার ভাষা পড়তে পারলেও মুখে কোনো উত্তর করেনি কাজলি। দরজা খুলে দিয়ে একপলক দেখেই চলে গেছিলো কিচেনে। হুড়োহুড়ি করে সোহমের কাছ থেকে না আসলেই পারতো। ঠিকই তো বলছিল সোহম, তার চেয়েও বরং দুঘন্টা দেরি করে এসেছিল দিলীপ। এই লোকটা কি কোনদিনও বদলাবে না! টেবিলের উপরে রঙিন মোড়কে ঢাকা বাক্সটিতে দিলীপ যেভাবে রেখেছিল সেভাবেই পড়ে আছে দুদিন থেকে... একবার ছুঁয়েও দেখেনি কাজলি।
ঘুম ভাঙতেই তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য রেডি হয়ে গেছিলো দিলীপ। কদিন থেকে রানুদিই লাঞ্চবক্স প্যাক করে দিচ্ছে। চাপ কম থাকায় ইচ্ছে করেই দেরি করে ওঠে কাজলি। দিলীপের সাথে ঠিক উল্টোটা হচ্ছে আজকাল। এ মাসের টার্গেটটা মেট করতে পারবে না বোধহয়, জানুয়ারি তো শেষ হতে চললো। দুমাস পরে ইয়ারলি ইনক্রিমেন্ট হবে। তার আগে এরকম বাজে পারফর্মেন্স ইনক্রিমেন্টে যে প্রভাব ফেলবে তা ঠিক জানে দিলীপ। ব্রেকফাস্ট সেরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে। ট্রাফিক জ্যাম না থাকলে ঠিক পঁচিশ মিনিটে পৌঁছে যাবে। গাড়িতে বসে এফএম চালিয়ে দেয়।
কিচেন থেকে রানুদির বাসন ধোওয়ার ঠুংঠাং শব্দে দিলীপ যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানা ছেড়েছিল কাজলি। শাওয়ারে নিজেকে ধুয়ে সোহমের দেওয়া পারফিউম গায়ে মাখে সে। চোখ বন্ধ করে কাছে অনুভব করতে চায় সোহমকে। আগামী ক'দিন আর দেখা করা সম্ভব হবে না, সোহম নিজেই মানা করে রেখেছে। নতুন প্রোডাক্ট প্রোমোশনের কাজে আজকাল বেশ ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সোহমকে। প্রায় সাড়ে দোষটা নাগাদ স্কুলে পৌঁছে যায় কাজলি।আজকে বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করার প্ল্যান থাকায় বাড়ি থেকে লাঞ্চের জন্য কিছু না নিয়ে স্কুলে এসেছে। ওর ব্যক্তিগত জীবনটা নিজের অবর্তমানে কলিগদের আলোচনার একটা আলোচ্য বিষয় সেটা ভালোই ঠাহর করতে পারে কাজলি। ওর সাজগোজ দেখে সামনে কিছু না বললেও কৌতূহলী চোখ সহজেই নজরে আসে কাজলির। কমনরুমের কথাবার্তার ফাঁকে ফোন বেজে উঠলো। আজকে অফিসের ল্যান্ডলাইন থেকে কেন ফোন করছে দিলীপ! কমনরুমের বাইরে এসে কল রিসিভ করে কাজলি। অপরিচিত গলা ভেসে আসে ওপর থেকে। হটাৎ পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছে দিলীপের। তড়িঘড়ি করে অফিসের অদূরে একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে..তাড়াতাড়ি যেতে হবে কাজলিকে।
দিগভ্রান্তের মত এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি করে দিলীপের কেবিনের কাছে পৌঁছায় কাজলি। ওকে দেখে চেয়ারে বসে থাকা দুজন পুরুষ উঠে নিজেদের পরিচয় দেয়। ঘটনাটি যখন ঘটে ওদের মধ্যে একজন পাশেই ছিল। বাথরুম থেকে এসে কেমন লাগছে বলে ধড়াস করে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলো দিলীপ। ওয়ালেট আর মোবাইল ফোন কাজলির হাতে তুলে দেয় ওরা। মিনিট দশেক পরে ডাক্তার আসলে সব কিছু জানতে পারে কাজলি। বড় বিপদ কেটে গেছে কিন্তু শরীরের ডানদিকে প্যারালাইসিসের লক্ষণ দেখা গেছে। জ্ঞান না ফিরলে সিওর হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
রোজকার জীবনে যে মানুষটার উপস্থিতি অসহ্য হয়ে উঠেছে তাকে হাসপাতালের বিছানায় দেখে হাসবে না কাঁদবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না কাজলি। সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে নিজের ও দিলীপের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছে ব্যাপারটা। দেরাদুন থেকে ওরা আসতে আসতে কাল সকাল হয়ে যাবে। এই মহানগরে পাশে থাকার মতন কেউ নেই কাজলিদের। রাতে থাকতে হবে জেনে, নার্সদের কাছে একটু খেয়াল রাখার অনুরোধ করে ধীরপায়ে হাসপাতালের বাইরে বের হয় সে। প্রথমে সোহমের কাছে যাবে তারপর বেরিয়ে বাড়ি থেকে রাত কাটানোর জন্য তৈরী হয়ে আসতে হবে। কাজলির অপেক্ষায় দরজা খোলাই রেখেছিল সোহম। আধাঘন্টা হল বাড়ি ফিরেছে। হোয়াটসএপে সবকিছু আগে থেকে জানিয়ে রাখায় কিছুটা আগেই চলে এসেছে আজকে। দরজা খুলে সোফার উপর বসে পড়ে কাজলি। কয়েকহাত দূরে ড্রেসিংটেবিলের আয়নাতে ও দেখতে পাচ্ছে নিজেকে। ধুলোমাখা হাওয়ায় ঝাপটায় চুলগুলো উস্কখুস্ক আর লালচে হয়ে পড়েছে। আধশোয়া অবস্থা থেকে ওঠে বসে সোহম। হালকা হাসিতে স্বাগত জানায় কাজলিকে।
-- ভালোই তো হয়েছে কলি! যাকে আমাদের পথ থেকে সরাতে চাইছিলাম সে নিজেই...
সোহমের ঠোঁটের হাসি ধীরে ধীরে তীক্ষ্ন হয়ে ওঠে। অদ্ভুত একটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে তার মন। কাজলিকে নিরুত্তর দেখে সোফার হাতলে দুহাত দিয়ে সামনে থেকে কাজলির চোখে চোখ রাখে সোহম। ফুঁ দিয়ে কাজলির গলার পাশে সরে আসা অগোছালো চুলগুলোকে সরিয়ে ডুবে যেতে চায় সে। মুহূর্তেই প্রায় দুহাত দূরে নিজেকে খুঁজে পায় সোহম। আরেকটু হলে ড্রেসিংটেবিলে মাথা ঠুকতে গেছিলো। সহসা ঝটকায় সোহমকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে কাজলি। দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসে যাচ্ছে সমানে। ভ্যানেটি তুলে তীব্র বেগে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সজোরে বন্ধ হওয়া দরজার বিশ্রী শব্দ কয়েকমিনিট ধরে কানে বাজতে থাকে সোহমের।
বাড়ি ফিরে বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানার কোণে বসে আছে কাজলি। অনেক ধকল গেছে সারা দিনে। শরীর-মন দুটোই ক্লান্তির গ্রাসে আচ্ছন্ন। অশান্ত ঘড়ির কাঁটার শব্দ বড় তীব্রভাবে কানে লাগছে। দিলীপকে ছেড়ে সোহমের সাথে ঘর বাঁধতে তো সে নিজেই চেয়েছিল কিন্তু এই অবস্থায় অকল্যাণ কামনা করার মতন ঘৃণা দিলীপকে করত না সে। দুই বাড়ির মতামতে ঠিক হওয়া বিয়েটা তাড়াতাড়ি করিয়ে নেবার ক্ষেত্রে কাজলির পরিবার চাইলেও তাতে বাধ সেধেছিল দিলীপ। পরস্পরকে জানার জন্য সময় নিয়েছিল বছরখানেকের। মানুষটা যে এরকমই তা তো আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল কাজলি কিন্তু বিয়ের জন্য মানা তো করেনি! ছয়-সাত মাস পরে কোনো সন্ধ্যায় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সলজ্জ আঁখির নিঃশব্দতা উত্তর দিয়েছিল না বলা কথার। বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে টেবিলে পড়ে থাকা দিলীপের উপহারের বাক্সটি তুলে নেয় কাজলি। জন্মদিনের রাত থেকে ঠিক সেভাবেই পড়ে আছে যেভাবে রেখেছিল দিলীপ। রঙিন মোড়কের ভিতরে শক্ত কাগজের বাক্সটা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলে সে। চারকোণা ভাঁজ করে রাখা একটা কাগজ, দেখতে কাজলির ভ্যানিটি ব্যাগের কাগজটার মত হলেও ভাঁজটা বেশ নতুন। কাগজ হাতে নিয়ে খোলার আগে ভিতরে রাখা খেলনা গাড়ি চোখে পড়ে কাজলির… সাথে প্লাস্টিকের একটা ফুটবল। মানুষটার মাথা খারাপ হয়ে গেছলো নাকি! বৌকে কেউ এসব উপহার দেয়! দেরি হয়ে যাওয়ায় যা হাতের সামনে পেয়েছে তাই নিয়ে এসেছে হয়তো! এবার কাগজের ভাঁজ খুলে পড়তে নেয় কাজলি। উপরে বড় হরফে লেখা আছে শহরের নামকরা একটি অনাথালয়ের নাম। আবেদনপত্রে নিজের সাথে কাজলিরটুকুও ভরে রেখেছে দিলীপ বাকি আছে শুধু কাজলির সাক্ষরটুকুর।
সূর্য উঠতে বাকি আছে আরো কিছুক্ষণ। নতুন দিনের পূর্বাভাসে সাহসী পাখিরা ত্যাগ করছে নিজ নিজ নীড়। কিছু পরেই কুয়াশার চাদর ভেদ করে রবির আলোকচ্ছটা ধুয়ে দেবে পৃথিবীর বুক। সারা রাত জেগে কাটিয়ে দিলেও চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই কাজলির। কালকে ওই আবেদনপত্রখানি ভ্যানেটি ব্যাগে ঢুকিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে এসে হাসপাতালের জন্য অটো নিয়েছিল সে। একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে দিলীপের। মুখের একটা দিক বেঁকে গেছে সামান্য, একটা চোখ বেঁকে ছোট হয়ে গেছে। শিয়রের পাশে হাত ধরে বসে থাকা কাজলির অবাধ্য চোখ ঝরে পরে দিলীপের গায়ে। দিলীপের হাত দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে কাজলি। ডাক্তার বলেছে ভয়ের তেমন কিছু নেই। সময়মত ঔষধপত্রের সাথে সেবা শুশ্রূষায় তাড়াতড়ি সুস্থতা সম্ভব। আত্মীয়স্বজনরাও চলে এসেছেন বাড়ি থেকে। আস্তে আস্তে দিলীপের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কাজলি। বাথরুমের দিকে যাওয়ার পথে এক হাতে ভ্যানিটি তুলে নেয় সে। সন্তর্পনে বার করে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়তে বসা কাগজখানি। শক্ত হাতের মুঠোয় কাগজটা মুচড়ে গোলাকার হয়ে পড়েছে। কমোডে ফেলে দিয়ে ফ্লাশ বটন জোরে চেপে ধরে কাজলি। কৃত্রিম জলের তোড়ে ভেসে যায় মনের সব গ্নানি।

Comments

Popular posts from this blog

তবু আগমনী বাজে..

#সর্বভুক

শারদ সুজন