স্বাদ-হীনতা
স্বাদ-হীনতা
||তৃণময় সেন||
সাদা ফুলহাতা শার্ট, ধূসর প্যান্ট, একমুখ কাঁচাপাকা দাঁড়ি নিয়ে মার্চের শেষ দুপুরে পাগলের মত ছুটে বেরিয়েছিল সজল। সাড়ে ছয় বছরের নাতনিটাকে নিয়ে ছেলে সতু এই সময়েই তো বাড়ি ফিরে। তারপরে টিফিন সেরে আধঘন্টার মধ্যেই আবার চলে যায় ফ্যাক্টরিতে। সেই সময়টা পেরিয়ে গিয়ে আরও পনের-কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে.. সতুর নম্বরে অনেকবার ফোন করেছে সজল, কিন্তু বার বার ওপার থেকে একই জবাব আসে... " দ্যা নাম্বার ইউ আর ট্রাইং টু কল, ইজ সুইচড অফ রাইট নাও"!
পাশের বাড়ির স্কুল ফেরত অমিত চিৎকার করে করে বিবেকানন্দ ফ্লাইওভার ধ্বসে যাওয়ার খবর দিচ্ছিল। অকুস্থলে পৌঁছতেই চারদিকে ভীষণ কোলাহল, লোক ভয়ে স্ত্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে, পুলিশের গাড়ির আওয়াজ, ধুলোময় পথঘাট - সবমিলিয়ে বেশ একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। হন্তদন্ত হয়ে ছেলে-নাতনিকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে চলে সজল। বেশি এগোতে চাইলে পুলিশ দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ভাঙা ফ্লাইওভারের নিচে নাকি এখনও অনেক লোক চাপা পড়ে রয়েছে। বৌ মরা সজলের এই দুনিয়ায় আপন বলতে এই একমাত্র ছেলে আর নাতনি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, তারপর রাত হয়। পথের ধারে ঠায় বসে থাকে সজল। পরেরদিন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ উদ্ধারকর্মীরা সতু আর তার মেয়ের প্রাণহীন শরীর উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। বাজেভাবে থেঁতলে গেছে সতুর দেহটা। সেই তুলনায় বাচ্চা মেয়েটার শরীরে তেমন চোটের দাগ নেই। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে হয়তো... ঐদিনের পর সজল আর বাড়ি ফেরা হয় নি। ন্যায়বিচারের আশায় পথ অবরোধ, মিছিল, সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের সামনে ধর্না আর শোকসভার ভিড়ের অংশ হয়ে দিন কাটিয়েছে। দীর্ঘদিন ঔষধপত্র বন্ধ থাকায় ব্যামোটা ওর মাথায় স্থায়ীভাবে আস্তানা গেড়ে নিয়েছিল।
তারপর আড়াই বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক আলোছায়া কাটিয়ে সজলের শার্টের রং এখন হালকা বাদামি হয়ে গেছে। কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা কালো দুর্গন্ধে ভরা প্যান্টের একটা পা পাতা থেকে হাঁটু অবধি ছেঁড়া, মুখভর্তি দাঁড়ি, আর ধুলোমাখা একমাথা চুল। পিঠে ইয়া বড়ো একটা বোঁচকা নিয়ে ওকে আজকাল কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায়। আজ ষোলোই আগস্ট, পুরসভার অযত্নে পথের মোড়ে একটা জায়গায় দুনিয়ার জঞ্জাল জমা হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়ায় সজল। জঞ্জালের স্তূপের পাশ থেকে কুকুরগুলোকে ঢিল ছুঁড়ে তাড়িয়ে নিজেই বসে পড়ে। গতকাল রাতের বৃষ্টিতে মাটির সাথে সেঁটে যাওয়া ছোট ছোট তিরঙ্গাগুলোকে সযত্নে উঠিয়ে বোঁচকার ভিতরে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। পিছন থেকে দুটো নেড়ি কুকুর ওকে দেখে অনবরত ঘেউ-ঘেউ করতে থাকে। সজলের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, ধীরপায়ে সফরটা জারি রাখে সজল। স্বাদহীন জীবনে গন্তব্য অজানাই থেকে যায় সজলের কাছে।
Comments
Post a Comment