টান
।। তৃণময় সেন ।।
এতোদিন থেকে মনের চিলেকোঠায় সযত্নে লালিত ইচ্ছেটুকু পূরণ হওয়াতে আজকে কত আনন্দ হওয়ার কথা ছিল, অথচ ভাবলেশহীন মুখে সটান দাঁড়িয়ে আছে স্বপন। এপথ সেপথ ঘুরে যখন নিজের ভিটেমাটিতে পোঁছলো, তখন সে বেশ ক্লান্ত। মা-বাবার মুখে শোনা ব্যথামাখা ছেঁড়া গল্পগুলোর যোগফল ঠিক হলে, এটাই ওদের সেই ভিটে যা ছেড়ে অনেক বছর আগে সবাইকে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছিলেন ওর বাবা বাবুলাল রায়। তখন স্বপনের বয়স বড়জোর আট-নয় হবে। সরকারবাড়ির কালোদিঘি, তেমাথার মণ্ডপ, কুপি টাঙানো হরেন মুদির দোকান ছাড়া স্বভূমের জমাপুঁজি স্বপনের কাছে খুব একটা নেই। ওদের ভিটেতে শক্তপোক্ত দোতলা ঘরখানি যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে। একতলার ভিতর থেকে অনবরত মেশিনের শব্দ ভেসে আসায় উঁকি দেয় স্বপন। বেশ কয়েকজন সারিবেঁধে বসে তুলনায় বড় মাপের সেলাই মেশিন চালাচ্ছে। একজন লোক সিঁড়ি বেয়ে এসে সেলাই হয়ে যাওয়া কাপড়গুলোর বড় পোঁটলা বেঁধে নিয়ে উপরে চলে গেলো। ওখান থেকে বেরিয়ে বিল্ডিংটার পেছনদিকে পা বাড়াল স্বপন। আগাছা আর কচুবন অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। হালকা হাওয়ায় হাতির কানের মতো দুলিয়ে উঠছে বড় কচুপাতাগুলো। এক-একটা গাছের গোড়ায় প্রচুর পরিমাণে লতি দেখে জ্বলজ্বল করে ওঠে স্বপনের চোখ। কচুর লতি ওর খুব প্রিয়। ছোটবেলায় মা আমসি দিয়ে ঝাল করে কচুর লতি রান্না করতো। ওটা হলে একথালা মোটা চালের ভাত নিমেষেই শেষ করার ক্ষমতা রাখতো স্বপন।
পথের মোড়ে বিশাল অমলতাস পাতার ফাঁকে গাঢ় নীল দেখে বোঝার উপায় নেই সকালবেলায় অঝোরে ঝরেছে আকাশ। এমনকি গত দু-তিনদিন ধরেই চলছিল সাদা-ধূসর মেঘের আস্ফালন। পৈতৃক ভিটে দেখতে গিয়ে অনেকটা সময় খরচ করে নিয়েছে স্বপন। খুঁজে পেতে এত্তো সময় লেগে যাবে জানলে হয়তো... যাইহোক এখনও কয়েক ঘন্টা হাতে আছে। একটু এগোতেই বাজার কমিটির কালীপুজোর বিশাল প্যান্ডেল চোখ-ধাঁধানো সাজে সেজে উঠেছে। প্যান্ডেলের একপাশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-অর্কেস্ট্রার জন্য স্টেজ বানানো হয়েছে। কয়েকমিনিট দাঁড়িয়ে দেখে মাড়োয়ারীবাবুর বাগানের পাশ দিয়ে শিউলির গন্ধ গায়ে মেখে এবড়োখেবড়ো পথ ধরে স্বপন। দশ মিনিট সোজা হাঁটলেই ওদের বস্তি শুরু হয়ে যাবে। তবে আজকে এতোটা সময় লাগবে না ওর। কার্তিকের বিকেলের রোদ শীতকালের মতো কোমল না হলেও বেশ মায়াময় হলুদ বর্ণের। শান্ত সুপারি গাছের গা ঘেসে পুকুরে ঝলমল করছে। বাসের মাচা বাঁধানো ঘাটে বাদামি-কমলা রঙের শাড়ি গায়ে মহিলাকে দেখে চিনতে পারে না স্বপন। একটু সামনে এগিয়ে গেলে চোখ ছলছল করে ওঠে তার। একমাত্র প্রিয় মেয়েটা এতোটাই শুকিয়ে গেছে যে দূর থেকে দেখলে চেনা দায়। শাখা-সিঁদুর তো আছে, কিন্তু মুখখানা বড়ই মলিন। একমাথা লাল চুলে অনেকদিন থেকে তেল-সাবান কিছু পড়েনি। চাল ধোয়ার বাঁশের ধুচুন হাতে নিয়ে স্বপনকে পাশ কাটিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে যায় সে। একটু ইতস্ততঃ করে তার পিছন ধরে স্বপন। ঘরটা ডানদিকে হেলে গেছে, বর্ষা আসার আগে খুঁটিগুলো না বদলালে নির্ঘাত ভেঙে পড়বে। আলনার পাশে মা-দুর্গার ফটোটা ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। খুক-খুক করে কেশে মশারি সরিয়ে বিছানা থেকে পা রাখলো আশু। নিজের বড় ছেলেকে আপাদমস্তক দেখতে থাকলো স্বপন। কদমছাট মাথার চুল, কোমরের উপর দিকটা সামনের দিকে বেঁকিয়ে গেছে, গায়ের উজ্জ্বল কালো রঙ যেন তামাটে হয়ে গেছে.. ছোট ছেলে বিশুটা কোথায় আছে কে জানে!
চায়ের জন্য বোনকে হাঁক পাড়ে আশু, মা সন্ধ্যের আগে আসবে না.. পুজোর দিনে লোকের বাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই কাজকর্ম বেশি থাকবে। ভাইয়ের কথায় নিজের জন্য এককাপ জল বেশি ঢালে অলি। আজ আর মায়ের সাথে চা খাওয়া হবে না।
স্বপনের কষ্ট হচ্ছে, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে... হাতে আর বেশি সময় নেই। আরও একটি বছরের অপেক্ষা, বৌকে বোধহয় এইবার আর চোখে দেখা হবে না। আস্তে আস্তে বাড়ির সীমানা পার হয় স্বপন রায়। পথের ধারে সজল চোখে ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছে অপেন, আদিল, মালতি, হাবুলরা। এটা স্বপনের প্রথম বছর, অভ্যেস হতে সময় লাগবে। তাই তার প্রতি সবাই সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ভূত-চতুর্দশী শেষের পথে, ক্যাম্পের চারদেয়ালের ভিতরের বন্দি জীবনে আবার ওদের ফিরে যেতে হবে। নিজেকে স্বদেশী প্রমাণের যুদ্ধে ডিটেনশন ক্যাম্পে ওদের মৃত্যু হয়েছে। ওরা সবাই অতৃপ্ত, শ্রাদ্ধ-পিণ্ডদানেও ওদের মুক্তি নেই যে! ওরা হারেনি, জেতেওনি; কিন্তু স্বপ্ন দেখে জেতার.. নিজের পরিচয়টুকু উদ্ধার করার। প্রতি ভূত-চতুর্দশীতে ওরা বেরিয়ে আসে আপনজনের টানে, ভিটেমাটির টানে।
Comments
Post a Comment