স্খলন
||তৃণময় সেন||
--ঠাম্মি কবে আসবে মাম্মা!
আলিয়ার গলায় মনখারাপের সুর! যদিও স্কুল, পড়াশুনার পাশাপাশি ড্যান্স, আর্ট, বিকেলবেলায় হোমটাস্ক সবকিছু মিলিয়ে আলিয়ার রোজকার ব্যস্ত রুটিনে নিজের জন্য সময় প্রায় নেই বললেই চলে, তবুও মাসদুয়েক থেকে ঠাম্মি আশালতাদেবীর অনুপস্থিতি যেন আর সহ্য হচ্ছে না বছর আটের আলিয়ার। রোজ ডিনার করার আগে আধঘন্টা মতন সময় ঠাম্মির সাথে কাটানোর সুযোগ পেত আলিয়া। ঠাম্মির কোলে শুয়ে শুয়ে 'শিলচর' নামের ছোট শহরটাকে কল্পনার তুলিতে আঁকত। তারাপুর, স্টেশন, দাদুর স্কুল, সিঁদল চাটনি, ফেরিওলিয়ার গল্প ঠাকুমার সিলেটি কথায় শুনতে বেশ লাগত আলিয়ার। মাঝে মাঝে দু-একটা শব্দের অর্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করত ঠাম্মিকে।
-- ঠাম্মি, 'আড়ুয়া' মানে কি গো?
ঠাম্মির মুখে শুনে শুনে একবার মায়ের সাথে সিলেটিতে কথা বলতে নিয়ে ভীষণ বকা খেয়েছিল আলিয়া। পাশের ঘর থেকে সব স্পষ্ট শুনতে পেয়ে মদনমোহনের সামনে অপরাধীর মতন হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন আশালতাদেবী। চোখের জল সরীসৃপের মত নিঃশব্দে গাল বেয়ে নামছিল। আবছা চশমাটা খুলে সাদা আঁচল দিয়ে তাড়াতাড়ি হৃদয়গলা নোনা জল মুছে নিয়েছিলেন মৃদুভাষী বৃদ্ধা। নিজের ছোট শহরটা ছেড়ে অনেকবছর হয়ে গেল বন্দি হয়ে আছেন এই কংক্রিটের জঙ্গলে। বৃষ্টি, নদী, আতপচালের পিঠে, মাটির সোঁদা গন্ধ, উঠোনকোনায় শরতের শিউলি আরও অনেককিছুই তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই জীবনে.. এই মহানগরে থেকে শুধু আয়ু ক্ষয় হয়, ইঁদুরদৌড়ের জীবনে প্রানখুলে বাঁচার মতন সুযোগ মানুষ কমই পায়। এতগুলো বছর কাটানোর পর কাউকে বলার বা শোনানোর মতন কিছুই থাকে না। ছোট নাতনিটার সাথে স্মৃতি রোমন্থন করে জীবন সায়াহ্নের শেষ দিনগুলো গুনছিলেন আশালতাদেবী, তাও বুঝি আর হয়ে উঠবে না! ওই দিনের পর অনেক কাকুতি-মিনতি করলেও আলিয়াকে আর গল্প শোনাননি তিনি। আজকে আবার ঠাম্মির কথা জিজ্ঞেস করতেই বকা খেয়েছে আলিয়া।
--বললাম তো আসবে! রোজ রোজ একটা কথাই জিজ্ঞেস করতে হয় তোমাকে! হ্যাভ ইউ প্র্যাকটিসড দৌজ ড্যান্স স্টেপস, ফর ইউর এন্যুয়াল প্রোগ্রাম? দুবার থেকেই তো সেকেন্ড আসছ, এবার কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে তোমাকে। নাও গো এন্ড স্টার্ট প্র্যাকটিস।
ড্যাড, অজিতেশ ভীষণ ব্যস্ত মানুষ, উইকেন্ডে ওনার কাছে একটু আধটু সময় থাকলেও তখন আলিয়া হয়তো আর্ট বা ড্যান্সের ক্লাসে ব্যস্ত থাকে। লাস্ট বার্থডে-তে ড্যাডের কাছ থেকে একটি ট্যাব গিফ্ট পেলেও তা ঠাম্মিকে ভুলানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। দিল্লির নামকরা রিয়েলএস্টেট কোম্পানিতে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার পদে চাকরি করেন অজিতেশ। ট্রেনি ইঞ্জিনিয়ার পদ থেকে কর্পোরেট জগতে পা রেখে একের পর এক সফলতার সিঁড়ি চড়েই চলেছেন তিনি। এনসিআর-এ দু-দুটো ফ্ল্যাট রয়েছে, যদিও প্রতিমাসের পাঁচ তারিখে অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অঙ্কের ই-এম-আই কাটা যায়। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে রাজনগর এক্সটেনশনের এই বিল্ডিঙের ফোর্টিন্থ ফ্লোরে থাকেন তিনি। যদিও আজকাল দিল্লি এনসিআর-এ রিয়েলএস্টেট ব্যবসায় মন্দা চলছে, কিন্তু তাতে অজিতেশের খুব একটা অসুবিধা পোহাতে হচ্ছে না উল্টে কোম্পানির ট্যাক্স সেভিংয়ের জন্য নয়া একটা কার্যসূচী হাতে নেওয়ায় মোটা অঙ্কের বোনাস পেয়েছেন এবছর। সরকারের নজর এড়াতে নতুন একটা এনজিও শুরু করেছে ওনার কোম্পানি। যেহেতু আইডিয়াটা অজিতেশবাবুর, তাই এনজিওটার চাবিকাঠি ওনার হাতেই অর্পণ করা হয়েছে। বাড়তি দায়িত্বের সাথে সাথে উপার্জনটাও বাড়ন্ত, কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যস্ততা এতটাই বেড়ে গেছে যে ল্যাপটপটা আজকাল দিনে আঠেরো ঘন্টা থেকে বেশি সময় খুলে রাখতে হয়।
কালকেই স্কুলে অ্যান্যুয়াল প্রোগ্রাম, খুব টেনশনে আছে আলিয়া। বিকেলে মাম্মার সাথে গিয়ে শিপ্রা মল থেকে ড্যান্সের জন্য কস্টিউম নিয়ে এসেছে। আয়নার সামনে নিজেকে আরও দুএকবার ঝালিয়ে নেয়। কালকের প্রোগ্রামে নাকি ড্যাডও আসবে অনেক লোকজন নিয়ে। আলিয়ারা ওদের সাথে দেখা করে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবে। যেমন করেই হোক পার্ফমেন্সটা খুব ভাল হতেই হবে, প্রত্যাশার চাপে রাতে ঘুম আসে না আলিয়ার। রোজকারের মতন সকাল সকাল বাস করে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে আলিয়া। স্কুল পৌঁছার কিছুক্ষণের মধ্যেই কস্টিউম আর সাজগোজের সব সামগ্রী নিয়ে মাম্মা আসবে। আজকের দিনে ঠাম্মির কথা খুব মনে পড়ছে আলিয়ার। আজকে ওর পারফর্ম্যান্স দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি হত ঠাম্মি। হয়তো বলতো "আমার সোনামণিরে খুব সুন্দর লাগের দেখতে"।
ড্যান্সে খুব ভাল পারফর্ম করেছে আলিয়া। স্টেজের চারদিকে সবাই জোরে জোরে হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানিয়েছে আলিয়াকে। স্টেজ থেকে নামতেই মাম্মা এসে সবার সামনে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে। ওর ড্যান্সটিচার পিয়ালী ম্যামও ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন "হোয়াট আ পার্ফমেন্স আলিয়া, প্রাউড অফ ইউ।" আহ্লাদে আটখানা হয়ে রয়েছে আলিয়া, আজকের দিনটা নিঃসন্দেহে ওর জীবনে একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। এবার অনুষ্ঠানের শেষ পালা.. আলিয়াদের হাতে রংচঙে মোড়কে আবৃত এক-একটা বাক্স ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ড্যাডের এনজিও থেকে আসা লোকদের হাতে এই উপহারগুলো তুলে দিতে হবে। লাইন ধরে আলিয়ারা এগিয়ে এসে চেয়ারে স্তূপের মতো বসে থাকা বৃদ্ধ মানুষগুলোকে উপহারের বাক্স দিতে থাকে। দু’নম্বর লাইনের একজন বৃদ্ধার সামনে আসতেই হাতের বাক্স মাটিতে পড়ে যায় আলিয়ার। হাত ফস্কে পড়ে গেছে ভেবে স্কুলের পিয়ন দীনেশভাইয়া বাক্সটা তুলে আবার আলিয়ার হাত ধরাতে চেষ্টা করে, কিন্তু আলিয়ার অসাড় আঙ্গুলগুলো ধরে রাখতে পারে না উপহারের বাক্স, কারণ সামনেই বসে আছে ওর আদরের ঠাম্মি। অযত্নে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে ঠাম্মির। গালের চামড়াতে আগে এতটাও বলিরেখা আর শুষ্কতা ছিল না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আলিয়া, প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে লেপ্টে যায় ঠাম্মির বুকে। বাম হাতটা আলিয়ার মাথায় আর ডান হাত দিয়ে পিঠ বুলিয়ে দিতে থাকেন আশালতাদেবী, তার চোখেও যেন আজ আষাঢ়ের বরাক। আশপাশের সবাই হঠাৎ করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। স্টেজে যে কি হচ্ছে তার মাথামুন্ডু কেউই বুঝতে পারে না। মেয়েকে থামাতে দর্শকাসনে বসে থাকা অনিমা তাড়াতাড়ি ছুটে যান স্টেজের দিকে। অতিথির আসনে বসে থাকা অজিতেশবাবুও কি করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না। হটাৎ ফোন বেজে উঠায়, স্টেজের আড়ালে গিয়ে ফোন রিসিভ করেন অজিতেশ। দিল্লি পুলিশ থেকে ফোন, সেন্ট্রাল এজেন্সি থেকে একটা ইন্টারনাল অডিটে ওনার এনজিও-র নিগেটিভ রিপোর্ট এসেছে। এনজিও-র অধীনে থাকা ওল্ড এজ হোমে নাকি নূন্যতম ব্যবস্থাও প্রদান করা হচ্ছে না। বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অনেকদিন থেকে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয় নি, তাছাড়াও বিশুদ্ধ পানীয় জলের কোন ব্যবস্থা নেই ওই ওল্ড এজ হোমে। অডিট ডিপার্টমেন্ট ওনাকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠাচ্ছে। সপ্তাহদিনের মধ্যেই সব কাগজপত্র জমা করতে হবে। স্টেজের পিছনের সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়েন অজিতেশ। স্টেজের সামনে অনেক চেষ্টা করেও আলিয়াকে ঠাম্মি থেকে আলাদা করতে পারেন না অনিমা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই থাকে আলিয়া, ওর চোখের জলে কাঁধ ভিজে যায় আশালতাদেবীর।
Comments
Post a Comment