সহচরী
#সহচরী
।।তৃণময় সেন।।
।।তৃণময় সেন।।
আকাশপানে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে বায়ুমন্ডলে বৃষ্টির সূক্ষ্ম ফোঁটা আবিষ্কার করলো পৌলমী। ব্যাগ থেকে সাদা-গোলাপি ছাতা টাঙিয়ে নির্ধারিত সময়ের ঘন্টা দুয়েক আগেই বেরিয়ে গেল দপ্তর থেকে। বছরখানেকের লম্বা মাতৃত্বকালীন বিরতির পরে প্রায় মাসখানেক হল অফিস জয়েন করেছে রেলবিভাগে কর্মরতা পৌলমী দত্ত। সদ্য হামাগুড়ি দিতে শিখেছে মেয়ে তুয়া। পাহাড়ি এলাকা থাকায় বেশ সহজেই দেখাশুনা করার জন্য কমবয়েসি একটা পরিচারিকা পেয়ে গেছে পৌলমী। স্টেশন থেকে আধা কিলোমিটার দূরে সবুজে ঘেরা রেলের কোয়ার্টার, অটোরিকশা পাওয়া গেলেও রোজ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে পছন্দ করে পৌলমী। বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে কাজের মেয়েটার বড়সড় কোনো খুঁত চোখে না পড়ায় কিছুটা হলেও নিশ্চিন্তে দিন কাটছে তার। স্বামী অমল বেসরকারি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, প্রতি শনিবার-রবিবার করে বাড়ি আসে। বিগত দিনগুলোতে অনেক ছুটি নিয়ে নেওয়ায় কাজের চাপ বেশ বেড়ে গেছে তার। দুদিনের জন্য এসে মেয়েকে ছেড়ে যেতে মন চায় না।
বৃষ্টির ফোঁটা বেশ ঘন হয়ে এসেছে। জল-কাঁদা মেপে মেপে পা ফেলে বাড়ি আসতে কয়েকমিনিট বেশি লেগে যায় পৌলমীর। পর্দা সরিয়ে ঘরে পা ফেলতেই আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে সে। ঘরের মাঝামাঝি কুচকুচে কালো লম্বা একটা সাপ উল্টে পড়ে আছে। তার মাথার চারপাশে লাল ছোপ দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ পাথর মেরে মাথাটা থেঁতলে দিয়েছে। একহাত মাত্র দূরে আপনমনে খেলে যাচ্ছে তুয়া, মা এসেছে সেদিকে মোটেই আগ্রহ নেই তার। বিহ্বলতা কাটলে দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে চেপে ধরে পৌলমী। ভিতরের ঘরে কানে হেডফোন লাগিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে কাজের মেয়েটি। আসলে দিদি বেরিয়ে গেলে খুকিকে ফিডিং বোতল মুখে ধরিয়ে দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে রোজ প্রেমালাপে হারিয়ে যায় সে। ঘন্টার পর ঘন্টা চলতে থাকে কথাবার্তা। তার মাঝে খুকিকে ব্যাস একবার স্নান করিয়ে দিলেই হলো। আজকে মেঘলা দিনে একটু ঘুমঘুম ভাব আসায় নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিল সে, তাছাড়া দিদি তো এতো তাড়াতাড়ি আসেও না। দিনটা যে শনিবার তা মোটেই মাথায় ছিল না তার। মেয়েকে কোলে নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে পৌলমী। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে জানলার পানে তাকিয়ে আপনমনেই হেসে-খেলে যাচ্ছে তুয়া। লোহার রডের ওপারে দাঁড়িয়ে নানা রকমের মুখভঙ্গি করে তুয়াকে আরও হাসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে ফুলমনি। বেশ মায়া হয়ে গেছে ওর বাচ্চাটার প্রতি। রোজ কয়েকঘন্টা কাটানোর সুযোগটা ওর কাছে হাতে আকাশ পাওয়ার মতো। খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো খুব যত্ন করে সে। মাঝে মাঝে তুয়াকে কোলে নিয়ে বেশ আবেগিক হয়ে পড়ে ফুলমনি। নিজের বাচ্চাটাও হয়তো এরকম হতো দেখতে! আজকে হটাৎ করে বিষধরটাকে তেড়ে আসছে দেখে একটা আস্ত ইঁট ছুঁড়ে মাথা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে সে। তুয়াও ভীষণ পছন্দ করে ওকে। তুয়া ছাড়া আর কেউ ওকে দেখতে পায় না যে! ওই জানালার অদূরে ঘন জঙ্গলের মাঝে অনেক বছর আগে এক অন্ধকার রাতে খুব সন্তর্পনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল ওকে। গর্ভবতী হবার পর বিয়ে নিয়ে ওর জোরাজোরিতে কোয়ার্টারের এই ঘরটিতে ঐদিন বিকেলে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল রেল আপিসের বাবুটি। মা-বাপু অনেক খোঁজাখোঁজির পর পুলিশে রিপোর্ট লেখালেও খুঁজে পাওয়া যায়নি ফুলমনি রিয়াংকে। বিকেলে অমল ফিরলে ওকে সবকিছু বিশদে বলে পৌলোমী। কাজের মেয়েটিকে তৎক্ষণাৎ বকেয়া টাকা হিসেব করে দিয়ে বের করে দিয়েছে পৌলমী। ভেবে ভেবে সারা রাতেও এই রহস্যের কূল-কিনারা পায় না সে। ওদিকে মন খারাপ করে বসে আছে ফুলমনি। একান্তে আর দেখা হবে না বুঝি বাচ্চাটির সাথে।
Comments
Post a Comment