প্রত্যক্ষদর্শী
। । তৃণময় সেন । ।
নির্জন পথে নাইটসুপার থেকে যখন নামলাম, তখন খুব ভোরের বদলে শেষ রাত বললেই ঠিক হবে হয়ত। ঘড়িতে চারটে বাজে। বাবা আগে বলেছিল যে, গুয়াহাটি-শিলচর রাস্তা আগের থেকে এখন অনেকটাই ভালো। তাই বলে যে এই শেষ রাতে পৌঁছে যাব সেটা ভাবিনি, জানলে হয়তো আরেকটু পরের গাড়ি ধরতাম। তাছাড়া ট্রেনের অপশনটাও তো হাতে ছিল। নাইটসুপারগুলো আমার বাড়ির আধামাইল দূরের বাজার হয়ে শিলচর যায়, তাই সুপারে এলে শিলচর অবধি না গিয়ে এই তেমাথাতে নেমে যাওয়া বরাবরের অভ্যেস আমার। অন্ধকারের দেশে একমাত্র প্রহরী রাস্তার ওপারের বাল্বটা দেখতে বেশ উজ্জ্বল হলেও, কুয়াশার চাদর ভেদ করে তার আলো আমায় হালকাভাবে ছুঁয়েছে মাত্র। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক। পাঁচটার আগে আলো ফুটবে বলে মনে হয়না, এমতাবস্থায় কি যে করি! দাঁড়িয়ে একঘন্টা কাটানো কি আর সহজ কথা! বছর ঘুরে বাড়ি আসার আনন্দে মন খুশিতে ভরে থাকলেও, শরীরটা বেশ ক্লান্ত আমার। গাড়িতে ঘুমাতে পারি নি একটুও। চোখ বুজলেই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠ, পথ, মায়ের মুখ। হৃদয়ে সযত্নে লালিত স্মৃতিগুলো রোমন্থন করছিলাম একে একে। গতবছর পৌষ সংক্রান্তির নগর কীর্তনে যাওয়া হয়নি, এবছর যাবই। ঠান্ডাটা এবছর এখানেও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। পাশের ছোট দোকানের চালে জমা কুয়াশার টুপটাপ শব্দ। বিশ হাত দূরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেও স্পষ্ট দেখা যাবে না। হালকা ভয় যে হচ্ছেনা তা নয়, কিন্তু এই অকুস্থলে কিছু করার নেই। সবমিলিয়ে সতের দিনের ছুটি মঞ্জুর হয়েছে আমার। ফেব্রুয়ারির তিন তারিখ গুয়াহাটি থেকে রিটার্ন ফ্লাইট। প্রতিবারের মতো এবারও দেখতে দেখতে কেটে যাবে দিনগুলো। তারপর আবার সেই গতানুগতিক জীবন। ট্রলিব্যাগটাতে একহাত রেখে মাথা এদিকওদিক ঘুরিয়ে চিরপরিচিত জায়গাগুলোর পরিবর্তন দেখার চেষ্টা করছি। পুরোনো বাঁশ-বেতের ঘরের জায়গায় ছাদ-ঢালাই বা শক্তপোক্ত আসাম টাইপের দোকানঘর।
--সন্তু নাকি রে, কখন এলি?
ডানদিকে বেশ দূরে আবছা মানুষটার গলা চিনতে অসুবিধা হল না আমার। এই কুয়াশাতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু নিপুদা এতটা দূর থেকে আমায় চিনল কেমন করে! আওয়াজ দিয়েও এগোচ্ছে না দেখে আমিই ট্রলিটা ঘষে নিয়ে এগোলাম। নির্জনে ট্রলির চাকার ঘড়ঘড় শব্দে যেন পথ কেঁপে উঠছে।
--আলো ফুটতে বাকি আছে, তারচে চল হেঁটে হেঁটেই যাওয়া যাক। অপেক্ষা করতে থাকলে ঠান্ডায় জমে যাবি।
আমাকে আট দশ হাত পিছনে রেখেই বাড়িমুখো হলো নিপুদা। আমি চললাম তার পেছন পেছন। এই সোজা পথ ধরে মিনিট পনেরো হাঁটলেই আমার বাড়ি। দু’বাড়ি ছেড়ে নিপুদারা থাকে। এই ঠান্ডার শেষরাতে কি যে করছিল এখানে! মদের আড্ডাফাড্ডা বসেছিল হয়তো, যাইহোক আমার তো ভালোই হলো, না হলে জমে যেতাম মাইরি। চাদরমুড়ি দিয়ে হেটে চলছে নিপুদা। আমার পিঠে ব্যাগপ্যাক, হাতে ট্রলি…নিপুদাকে একটা ধরার অনুরোধ করব নাকি! এতটা রাস্তা একা টেনে নিয়ে যেতে পারবো বলে তো মনে হয় না।
-- আস্তে আস্তেই আয়। গতকাল দরজা বন্ধ করতে গিয়ে বামহাতের আঙ্গুলগুলো দরজার ফাঁকে পড়ে যাওয়ায় ভীষণ ব্যাথা, না হলে তোকে সাহায্য করতে পারতাম ভাই।
-- না না থাক, আমি পারবো নিপুদা।
আমার মনের কথা সহজেই বুঝে গেলো। একসময় বাঁহাতি বোলার হিসেবে খুব নাম ছিল নিপুদার। ব্যাটিংটাও বেশ ভাল করত। টুর্নামেন্টে অন্য গ্রাম থেকে ওকে ডাকলে শ-পঞ্চাশেক টাকা তো দিতেই হতো। সেই সুঠামদেহের অধিকারী লোকটাকে গতবার দেখে চিনতেই পারিনি। টেকো বেষ্টনী ধুলোমাখা লালচুল, কাঁচাপাকা দাঁড়ি, দিনদুপুরে সস্তা মদের গন্ধ সারা শরীর জুড়ে। গত কয়েকবছর থেকে গ্রামের লোক ওকে পুরোদস্তুর মাতাল বলে চেনে। বিয়ে-থাও তো করেছিল, বৌ নাকি ছেড়ে চলে গেছে। মাতালের সাথে কে'ই বা ঘর করতে চায়!
--খুব ভাল হলো তুই এসেছিস। এই বিপদে তুই’ই সাহায্য করতে পারবি আমায়।
--কি যা তা বলছো! সাহায্য তো আমার হলো তুমি থাকায়। না হলে কি যে করতাম এতক্ষন...
তার বেশি বলতে গেলাম না। নেশাগ্রস্ত মানুষের কথার জবাব দিয়ে কি করব! এ আবার টাকা-পয়সা খোঁজার কথা ভাবছে না তো! চাইলে কিছু করার নেই, টাকা পঞ্চাশটা দিয়েই দেওয়া যাবে না হয়।
-- হ্যাঁরে, বলছি ওখানে কি ক্রিকেট খেলার সময় পাস্? তোর ঘরের আশেপাশে কি কোনো খেলার মাঠ আছে?
--না নিপুদা, মাঠ তো আছে কিন্তু সময় কোথায়! নয়-দশ ঘন্টা তো অফিসে থাকি। দিনের শেষে বাড়ি ফিরলে মনে, শরীরে ততটা জোর আর থাকে না যে খেলতে যাব।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস যেন আমাদের দুজনকেই ছুঁয়ে গেল। সেই দিনগুলোর স্মৃতি তাজা হয়ে উঠলো। সময়ে-অসময়ে এই ক্রিকেট খেলার জন্য বাড়িতে মার পর্যন্ত খেয়েছি। কথায় কথায় অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। এই তো রেললাইন দেখা যাচ্ছে, এখান থেকে বড়জোর দুশো মিটার আমার বাড়ি।
--তুই এখানে একটু দাঁড়া, আমি আসছি।
আমাকে পথের ধারে দাঁড় করিয়ে রেখে ডানপাশে হারিয়ে গেল নিপুদা। বেশ তো দিনের আলো ফুটে উঠছিল হঠাৎ করে আবার অন্ধকার হয়ে গেল কেমন করে! বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে চাঁদের আলো অথচ এতক্ষন এই চাঁদ তো আমার চোখেই পড়েনি। কাকভোরের পাখির কলকাকলি নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে। কিছুই বুঝতে পারার আগে বেশ কাছে থেকেই ট্রেনের কানফাটা শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি। ঢিলছোঁড়া দূরত্বে লাইনের আশপাশ ট্রেনের হেডলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। লাইনের গা-ঘেঁষে একটা লোকের সাথে দাঁড়িয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে কি যেন বলছে নিপুদা। লোকটার চেহারা বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে কিন্তু নামটা ঠিক মনে আসছে না। কিন্তু এ কি ট্রেন আসছে এটা কি লক্ষ্য করছে না দুজন! এতটা কাছে দাঁড়ানো তো ঠিক নয়। ট্রেনের শব্দে এদের কথা কিছুই কানে আসছে না আমার, কিন্তু কিছু একটা নিয়ে যে কাজিয়া লেগেছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। ট্রেনটা ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে। লোকটা হঠাৎ করে নিপুদাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল লাইনের উপরে। নিমিষেই নিপুদার শরীর বেয়ে পেরিয়ে গেল ট্রেনটা। আমি চিৎকার করে উঠলাম "নিপুদা. অা.. আ.." দৌড়ে যেতে চাইলে কয়েকপা পেরোতেই পিঠের ব্যাগপ্যাকের ভার সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে গেলে পিছন থেকে কে যেন ধরে ফেললো আমায়। এটা কি কারো হাতের মুঠো না লোহার শেকল! পেছন ফিরে দেখি নিপুদা সোজা দাঁড়িয়ে আছে। পাদুটো কি মাটিতে লেগে নেই! দমকা হাওয়ায় ওর চাদর খসে পড়তেই শিউরে উঠলাম আমি। ডানপাশের কাঁধ থেকে ধরে পা পর্যন্ত অর্ধেক নেই। মাথার থেঁতলে যাওয়া দিকটায় একটা চোখ যেন ঝুলছে। "আমি তোকে কিছু করব না সন্তু, আমার কথা শোন.." আতঙ্কে গোঙানো ছাড়া কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না আমার গলা দিয়ে। কোনোমতে উঠে দৌড়তে লাগলাম। পিছন থেকে নিপুদার আকুতিমাখা আওয়াজ "তোর কোনোও ক্ষতি করব না ভাই...শোননা সন্তু " ঘামেভেজা শরীরে প্রানপন দৌড়ে যাচ্ছি আমি। সামনে থেকে কয়েকটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। ছোটকার চেহারা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম তারপরে আর কিছু মনে নেই আমার।
যখন চোখ খুললাম তখন আমাকে ঘিরে বসে আছে ভাই-বোন সবাই। মা দৌড়ে চলে এসেছে, দুচোখ ভিজে আছে জলে। খুব ভোরে কালীবাড়ি শ্মশান থেকে আসার সময় ছোটকারা আমার পাগলের মত দৌড়ে আসতে দেখেছে। ওরা কাছে আসতেই আমি নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। গতকাল রাতে নাকি নিপুদা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে। কখন মরল কেউ জানেনা, গ্রামের পাহারাদাররা রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে বেরোলে রেললাইনের উপরে ওর লাশ দেখতে পায়। কেটে গিয়ে ভীষণ বীভৎস নাকি হয়ে গেছিল দেখতে। শরীরের ডানদিকটা তো ছিলই না। মদ খেয়ে ওখানেই পড়ে আছিল হয়তো! গ্রামের এই মাতালকে সবাই চিনত| তাছাড়া পুলিশের সহযোগিতা থাকায় পোস্টমর্টেম করতে হয়নি। তবুও শ্মশানে নিতে নিতে মাঝরাত পেরিয়ে গেছিলো। ছোট বোন ততক্ষণে চা নিয়ে এসেছে। সবাই আমার কাছে জানতে চাইছে যে কি হয়েছিল। ওদের কথা উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি চা খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি। এক্ষুনি বেরোতে হবে, নিপুদা মদ খেয়ে পড়ে মরেনি, ওকে মারা হয়েছে। যদিও আমার কথায় কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু ওই লোকটার চেহারাটা এখনও ঠিক মনে আছে আমার। সতের দিন সময় আছে আমার কাছে, নিপুদার খুনিকে ধরিয়ে দিতে হবে। ছোটভাইয়ের একটা টি-শার্ট পরে হনহন করে বেরিয়ে পড়লাম আমি, গন্তব্য আপাতত পুলিশ স্টেশন।
Comments
Post a Comment